২. মিথ্যে প্রচার ও ঘৃণার রাজনীতি
মিথ্যে প্রচার ও ঘৃণার রাজনীতি সংখ্যালঘুদের জন্য এক ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত। এই
সব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম
মিথ্যে গুজব, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়িয়ে নিজেদের যেমন ঐক্যবদ্ধ করে
তেমনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনের মধ্যে একটা ভয়, আতঙ্ক সঞ্চার করে। সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার এইগুলি ভয়ঙ্কর হাতিয়ার। ঘৃণার
রাজনীতি প্রায়ই ক্ষমতা অর্জন বা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। সেখানে সংখ্যালঘুদের
‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন আদায় করা হয়। কখনও কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাঝে ভয়,
বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংহতি বাড়ানোর
একটি কৌশল অবলম্বন করে। এটি অনেক সময়ই ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী বা শাসকদলের হাতিয়ার
হয়ে ওঠে। ঘৃণার রাজনীতি অনেক সময় ভোট-ভিত্তিক রাজনীতির
অংশ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের
ভোট নিশ্চিত করার চেষ্টাও ইতিহাসে দেখা গেছে। কখনও কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিক শোষক বা সামাজিক হুমকি হিসেবে উপস্থাপন
করা হয় আবার সমাজে ‘আমরা বনাম ওরা’ মানসিকতা তৈরি করে সাম্প্রদায়িক ও জাতীয় ঐক্য ধ্বংস
করা হয়। বর্তমানে
বিজেপি সরকার এমনই এক নীতি অবলম্বন করেছে। এমতবস্থায় ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজন
তৈরি করা হয়; যা ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্ম দেয়। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়
এবং কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়। প্রশাসন হয় নিরব থাকে, নয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ
অবলম্বন করে।
এক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। সংবাদপত্র, রেডিও,
টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘৃণার বার্তা ছড়িয়ে দিতে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।
ইতিহাসে দেখা যায় নাৎসি দল, অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে, ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা
চালায়। তারা ইহুদিদের অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব এবং সামাজিক সমস্যার জন্য দায়ী করে।
প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের নেতৃত্বে পত্রিকা, রেডিও, চলচ্চিত্র এবং পোস্টারের
মাধ্যমে ইহুদিদের ‘জাতীয় শত্রু’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। পরবর্তীতে গণহত্যার
(Holocaust) পথ প্রশস্ত করে, যেখানে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়।
রুয়ান্ডার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমরা একই অবস্থা দেখতে
পাই। সেখানেও ইতিহাস হাহাকার করে উঠে। ১৯৯৪
সালে তুৎসিদের বিরুদ্ধে হুতু সম্প্রদায়ের ঘৃণামূলক রেডিও প্রচার, যা গণহত্যায় রূপ নেয়। রুয়ান্ডায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু গোষ্ঠী তুৎসি সংখ্যালঘুদের
বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রচার চালায়। ‘রেডিও টেলিভিশন লিব্রে দেস মিলে কোলিনেস’ (RTLM) নামক
রেডিও স্টেশন তুৎসিদের ‘তেলাপোকা’ (cockroaches) হিসেবে অভিহিত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে
সহিংসতার আহ্বান জানায়। হুতু নেতারা তুৎসিদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য
দায়ী করে এবং হুতু জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়। এটি ১৯৯৪ সালে মাত্র ১০০ দিনে
প্রায় ৮ লাখ তুৎসি ও মধ্যপন্থী হুতুর নৃশংস গণহত্যার দিকে নিয়ে যায়। এই গণহত্যা
রুয়ান্ডার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় হিন্দু, মুসলিম ও শিখ সম্প্রদায়ের
মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণা ছড়ানোর জন্য রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় গোষ্ঠী প্রচারণা
চালায়। পত্রিকা, পুস্তিকা ও গুজবের মাধ্যমে এক সম্প্রদায়কে অপরের জন্য ‘হুমকি’ হিসেবে
উপস্থাপন করা হয়। এই ঘৃণার রাজনীতি ভারত ও পাকিস্তানের (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) মধ্যে
দীর্ঘমেয়াদী শত্রুতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বৈষম্যের প্রভাব ফেলে। এমনকি
১৯৮৪-তে যে শিখ বিরোধী দাঙ্গা হয়,
সেটিও রাজনৈতিক প্রচার ও মদদে গণহত্যার রূপ নেয়।
অনেক সময় শাসক গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃত করে বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি করে তাদেরকে রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখায়। এমন কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক অবদান ও ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। তাদের স্মৃতিসৌধ, সমাধি, দুর্গ ও উপাসনালয়কে হয় গুড়িয়ে দেয়, নয়তো সে সবের নাম নিজেদের মতো করে রাখা হয়। কখনও কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক সরিয়ে দেওয়া হয়। আবার কখনও কখনও তাদেরকে অত্যাচারী, আক্রমণকারী শাসক হিসেবে দেখানো। সমস্ত স্কুল কলেজে মিথ্যে ইতিহাসের হাট বসে। অলৌকিক চরিত্রগুলো ইতিহাসের নায়কে রূপান্তরিত হয়। এ ধরনের প্রচার সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সহিংসতাকে উস্কে দেয়। যা এক সময় মানবতা ভুলণ্ঠিত হয়। চারিদিকে শোনা যায় বুটের শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসে নারীদের ইজ্জৎ হরণের চিৎকার, পোড়া মাংসের দুর্গন্ধে বাতাস ভারি হয় আর ঘোলা আকাশের বুকে ঘুরপাক খায় শকুনের ঝাঁক।
(চলবে)