সম্পাদকীয়
আজ দেশ চলছে মুণ্ডুহীন প্রজাদের নির্বাচিত
প্রতিনিধি মুণ্ডুহীন শাসকের দ্বারা। সেখানে সার্বিক মানুষের প্রত্যাশা লাঞ্ছিত হবে
এটাই স্বাভাবিক। হারাবে শিক্ষার মান। টাকার কাছে যখন শিক্ষার মানদণ্ড ল্যাজ নড়ায় তখন
সেই সমাজ থেকে ভাল কিছু চাওয়ার অর্থ হল মরীচিকার পিছুনে মানুষের ছুটতে থাকা। সেখানে
চিকিৎসকের কাছ থেকে সঠিক চিকিৎসা দাবি করতে পারি না। বিশ্বজুড়ে যেখানে টেকনোলোজির এতো
মহোৎসব চলছে, মানুষের মানসিকতার অভূত পরিবর্তন চলছে সেই সময়ে দাঁড়িয়েও আমরা আমাদের
মানসিকতার তেমন পরিবর্তন করতে পারছি না। শাসকের ললিপপের উপহার চুষতে চুষতে পিছুনের
দিকে হাঁটছি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এটা বলাই যেতে পারে, কোন সম্প্রদায় বা জাতিকে নষ্ট
করতে গেলে কোন কিছু না, কেবল ধর্মের অন্তরালে হিংসা আর বিদ্বেষের বিষ মাথায় ঢুকিয়ে
দাও আর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে দাও। ব্যাস! আর কিচ্ছু না... প্রগতির চাকা পিছুন
দিকে ছুটবেই।
বিশ্বনাগরিক
সেলিম শাহরিয়ার
বিধ্বংসী গান
আজিজুল হাকিম
ড্রাগন সিংহাসনে
বসে কি খেলায় মেতে উঠেছ
হে স্বর্ণালী সম্রাট?
অবোধ শিশুর মতোই
চিকন চাকু হাতে
মানচিত্রের বুকে
মেতে উঠেছ আঁকিবুঁকি খেলায়
শোণিত ফিনকির ধারা
দিগন্ত ছুঁয়ে যায়
সীমান্ত নদী আঁকে
বরাবর।
তুমি কি ভুলে গেছ
ইতিহাসের ভাষা
সেদিনের সেই চেঙ্গিস
খেলায় থরথর কম্পমান পৃথিবীর কথা
অথচ পৃথিবীর নীরব
উল্লাসে তার সমাধি নিশ্চিহ্নতার গান গায়
বেনামি ঝিঁঝিঁদের
পাড়ায় - শুনেছ কি সেই সুর
সোনার সুতোই বোনা
কিবতিকাস
আজ সেদিকে তাকালেই
দেখি
বিশাল আকাশের বুকে
কেবলই দীর্ঘশ্বাস।
কত মতবাদ এসেছিল
এই পৃথিবীকে করতে আবাদ
জ্বলে উঠেছিল তারা
নক্ষত্রের মতো,
ধ্রুব তারার মতো
দেখিয়েছিল দিশা
আর আজ -
সময়ের নিখুঁত ঘর্ষণে
তারা সব অ্যাবলিস।
তবে কেন গেয়ে যাও
ক্ষণস্থায়ী জীবনে অমরত্বের গান?
সে কি মূর্খতা নয়?
কেন পায়রার মুখে
তুলে দাও আফিম সারাব?
কেন তার ঠোঁট কেটে
বসিয়ে দাও শকুনের ঠোঁট?
কেন তার পায়ের নখে
সেঁটে দাও ঈগলের নখ?
কেন ধর্মান্ধতার
চাষ কর স্কুল আর কলেজ পাড়ায়?
বসন্ত বাতাসের বুকে
কেন ছড়িয়ে দাও হিংসার আগুন?
দেখে নিও,
তোমার এই পাগলামিতে
ঈশ্বরও উঠবে হেসে
এক সময় গেয়ে যাবে
বিধ্বংসী গান।
~~~~~~~
রোজ পুড়ছি
নরেশ মণ্ডল
রোজ সভ্যতার আগুনে পুড়ছি
পুড়ছি আমরা পুড়ছে পৃথিবী
কতটা সভ্য হলে এভাবে পোড়ে মানুষ
বনাঞ্চল পুড়ছে পুড়ছে বসতবাড়ি
শ্রদ্ধা প্রেম ভালোবাসাও পুড়ছে
শিক্ষক রাজপথে ছাত্র ঝাঁপ দিয়ে
সভ্যতার আগুনে নগ্ন মণিপুর
নগ্ন রাজ্যও কম নয়
তবুও বিজ্ঞাপনের ঢাকে কাঠি
শহরে গরিবি ঢাকতে আপ্রাণ চেষ্টায়
জি ২০ তে বেতাজ বাদশা
খায় না মাথায় দেয়় জানে না ওরা
তবুও বিজ্ঞাপনের ঢাক বাজাতেই হয়
মসনদ যে মস্ত বালাই
কতটা সভ্য হলে এভাবে পোড়ে মানুষ
পুড়ছি আমরা পুড়ছে পৃথিবী বীভৎস সভ্যতা
~~~~~~~
মোঃ নূরুন্নবী মন্ডল-এর দুটি কবিতা
কেন থামি ওখানে?
পৃথিবীর সব রূপ কেন
থেমে ওখানে?
প্রতিদিন আমার সূর্য
কেন ওখানেই ওঠে?
ওই ঠোঁটের প্রভাতে।
আমার ঘড়ির সব সময়টুকু
কেন বন্দি ওখানে?
কেনই বা ওই দরজায়
আমায় থামতে হয় অনন্তবার?
যখন মানুষ পায়না
‘কিছু’
ওই কিছুতেই যেন বুঁদ
হয়ে রয়।
এই অনুভূতি, এই আবেগ
- হয়তো
এই হিসেবী পৃথিবীর
কাছে কিছুই নয়।
মানুষ কতটা ব্যাকুল
হলে -
রাজ্য ছাড়ে, প্রাসাদ
ছাড়ে, মুকুট ছাড়ে
ছাড়ে আরো কত কিছু
......
সৃষ্টি ছেড়ে হাটে
প্রলয়ের পিছু!
বৃক্ষের আর্তনাদ
একদিন তোমাদেরও পিঠে-ছুঁচালো
পেরেক বিঁধে
সাইনবোর্ড এঁটে দেবো।
আর
রক্তমাখা বর্ণমালায়
লিখে দিবো – “আমারো ভীষণ কষ্ট হয়!”
আদুরে মাংসে মামুলি
ক্ষত যখন আর্তনাদে বাতাস ভারী করবে
তখন বুঝবে - কি যে
ভীষণ কষ্ট হত আমার!
~~~~~~~
অপেক্ষা
মালবিকা দাস
অপেক্ষা অনন্ত যত,
ততই নাকি মধুর,
তবু সময় টুকু মাঝে
তার বিরহ বিধুর।
সময় জানি নদীর স্রোত,
নেই কোনো বিরাম,
বহমান নদীর মতো তার
গতি অবিরাম।
তবুও সেই অনন্ত স্রোত
যেন হারায় তার গতি -
অপেক্ষার প্রহর যেন,
প্রতিটি দিশাহারা রাতি।
নির্লিপ্ত এই জীবন
এগোয় সময়ের ছন্দে,
চঞ্চলতা, উদ্বেগ
আর বিষাদভরা দ্বন্দ্বে।
অবশেষে উপনীত হয়
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,
বিরহ-মিলনের চির
কাঙ্খিত এক মধুর সন্ধিক্ষণ।।
~~~~~~~
সমস্ত অপেক্ষা ভুলে
তীর্থঙ্কর সুমিত
সমস্ত অপেক্ষা ভুলে,
যাবতীয় অন্ধকার উঠে আসে তোমার চুলে
উদাসীনতা কত দূর যেতে পারে?
ফাঁকা জমিতে এখন হোগলা পাতা
ক্রমশঃ...
এই অবেলা ঘুমের মধ্যে জেগে থাকে সময়
উঠোনে পিপুলের চারা বেড়ে উঠছে।
~~~~~~~
স্মৃতিকথা
মীর সাহেব হক
সেই দিনের স্মৃতি
জেগে উঠলে
ভেঙে যায় বুকের
মানচিত্র।
হৃদয়ে যে নদী বয়ে
চলে
সেই ঢেউয়ের চূড়ায়
তুমি খেলা করো বারোমাস।
আমার এই বুকে
কান পেতে শুনে নিও
যেখানে শব্দরা ভিজে
কথা হয়
আর নির্জনে ছবি আঁকে
তোমারই।
তোমার ফেলে যাওয়া
মৃগনাভি, ইলিশ মারির
মাঠ
আমাকে হতবাক করে
গৃহে প্রাচীর তোলে
কেড়ে নেয় রাতের
ঘুম।
যেভাবে সকালে যুদ্ধ
বন্দী
সৈনিকের পাশে পড়ে
থাকে অস্ত্র
আমি তার পাশ দিয়ে
হেটে যাই
যে পথ ধরে তুমি গেয়েছিলে
গান।
~~~~~~~
জিভ
গোবিন্দ মোদক
আবারও বলছি ধর্মাবতার
—
আমার আস্তিনে কোনও
ছোরা
লুকানো নেই
লুকানো নেই রক্তপিপাসু
কোনও অস্ত্র
আমি কোনও ল্যাবরেটরি
থেকে
সংগ্রহ করে আনিনি
কোনও সেঁকো বিষের
ভাণ্ডার
অথবা নিশ্চিত মৃত্যুর
কোনও পরোয়ানা
আমি লিখিনি
হেমলক বিষয়ক কোনও
কবিতা
কিংবা কোনও ক্ষুদিরামের
অন্তর্দহন
নাথুরাম গডসে-কে
সমর্থন করে
কোনও খোলা চিঠিও
আমি লিখিনি ধর্মাবতার
আমি কোনও রণক্ষেত্র
প্রত্যক্ষ করিনি
আমি কোনও নির্ভয়া-কে
ধর্ষণ করিনি
কোনও ছ’বছরের শিশুযোনী
ছিন্নভিন্ন করতেও আমাকে দেখা যায়নি
আমি বা আমার পূর্বপুরুষ
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের
সঙ্গেও
এতোটুকুও জড়িত নয়
প্রকাশ্য রাস্তায়
মদ্যপান করে
কোনওরকম বেলাল্লাপনাও
আমি করিনি
মাননীয় ধর্মাবতার
—
তবে কোন অপরাধে আমাকে
….
কি বলছেন?
চোপ! আরেকটি কথা
বললে
আমার জিভ টেনে ছিঁড়ে
ফেলা হবে?
তবে তাই হোক ধর্মাবতার!
যে জিভ কোনও সত্য
কথা
বলতে পারবে না
তা রেখে আমার কোনও
লাভ নেই!
~~~~~~~
সকাল
অমিত কাশ্যপ
প্রতি সকালই কেমন
অন্যরকম লাগে
জগাদার মা যেদিন
মারা গেলেন
যেদিন কাগজের হকার
অনেক দেরি করে এল
যেদিন বিছানা ছেড়ে
উঠতে উঠতে মনে হল
আজ রবিবার, শীত সকালের
মতো অলসতা
চারিপাশে ঘোলাটে
কুয়াশা, বন্ধ চায়ের দোকান
কেমন এই ভাবনার মধ্যে
স্ত্রীর পরম যত্নে
খুলে গেল জানালা,
ভোরের আলো ঘরময়
আজ রবিবার নয় জানিয়ে
সরে গেলেন
নিকুঞ্জর চায়ের দোকান
থেকে ধোঁয়া উঠছে
চারিপাশ পরিষ্কার
করতে করতে নিকুঞ্জ ভাবে
আর ক’দিন, বুকটায়
টান ধরে কেমন
ছোট্ট একটা নাম জীবন,
বন্ধুত্ব তার মাঝে সেতু
বিশ্বাস কখন এসে
দাঁড়ায়, বল, কেমন? ভাল?
~~~~~~~
প্রবাসীদের পরীক্ষা
আবদুস সালাম
রাতের প্রহর বাড়লে
ঝাপসা হয় উঠোন
দিনের স্বরলিপি ভাসে
অন্ধকারের বন্যায়
ছায়ারা দীর্ঘ হয়
রাতের ব্যালকনি জুড়ে
উদাসীন নৃত্য নাট্য
বাড়ি ফেরা মানুষেদের
চোখে উদাসী প্রচ্ছদ
সব বাড়িগুলো ছুটছে
বিপদ সীমার কাছাকাছি
কবে প্যাঁক প্যাঁক
করে ডানা মেলে ছিলাম মনে নেই
উৎসবের হাত ধরে বাড়িতে
ফেরা
আতঙ্ক তাড়া করে
অজানা অভিযান
অবাস্তবের ডাঙ্গায়
কোন মাটি নেই
শূন্য হাতে নেমে
পড়েছি অসম যুদ্ধের ময়দানে
বিজয়ী না বিজিত
পরীক্ষা দিব এখন
থরথর করে কাঁপছি
পিকআপ ভ্যানে ঠাসাঠাসি
সব স্বপ্ন
ঢুলুঢুলু চোখ
তেল চিটচিটে গামছায়
ভ্যাপসা গন্ধ মাখা
যাপনের দলিলে লেখা
অন্ধকারের চিত্রনাট্য
অজানা অভিমান ঘিরে
জেগে ওঠে বসতি মিশে আছে নিত্য সমাস
রাতের চাতালে আসর
পেতেছে উৎসব
সব পথ সরু হয়ে আসছে
আতঙ্কের সীমায় বন্দী
হয়ে আছে একচিলতে প্রাণ
ধর্মগুরু বাজায়
ঘন্টা
এক্ষুনি শুরু হবে
পরীক্ষা
~~~~~~~
প্রান্তরে প্রান্তরে
মহম্মদ মফিজুল ইসলাম
এ কেমন দেশ?
রাজা থেকেও যেন কোথাও
রাজা নেই।
রাজপথে বিপ্লব নেই।
প্রতিবাদী মিছিল
নেই।
শহর কাঁপানো স্লোগান
নেই।
অথচ আকাশে মেঘের
ঘনঘটা।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের
স্পষ্ট ইঙ্গিত।
নব উচ্ছ্বাসে মাঠে
মাঠে চাষার
বলদের আনাগোনা কই?
বাংলার প্রান্তরে
প্রান্তরে যেন শ্মশানের নীরবতা।
তপ্ত গ্রীষ্মে মাঠে
ফাটল।
নেই কোথাও মৌমাছির
আনাগোনা।
পড়ে আছে শুধু বিবর্ণ
ঘাস।
নদীর খাঁড়িতে শুকনো
বালুকার ঢিবি।
পড়ন্ত বিকেলে উঁকি
মারে লম্বু গাছের ছায়া।
ঘনিয়ে নেমে আসে
গাঢ় অন্ধকার।
বলতে পারো, ওদিকে
মমির গহ্বরে
কীসের ফিসফিস শোনা
যায়?
~~~~~~~
স্বপ্ন না
হামিদুল ইসলাম
স্বপ্ন না ভাবনা
না। কল্পনাও না
তবু স্বপ্নের মতো
মনে হয় সেই মুহুর্তটুকু
অজস্র হাওয়া
ঝরে পড়ছে গাছের পাতা
ছেঁড়া ছেঁড়া দুঃখগুলো
জোড়া দিই। জোড়া লাগে না
এদিনই তো তোমার সাথে
দেখা হয়েছিলো
আমি ব্যালকনির উপর
তুমি নীচে হেঁটে
যাচ্ছো ধীর পায়ে
তোমাকে ডাকলাম বারবার।
তুমি শুনতে পেলে না
আমি ব্যালকনি থেকে
নেমে এলাম
দেখি তুমি অনেক দূর
চলে গেছো
তোমাকে ডাকলাম। তুমি
শুনতে পেলে না
আমি প্রাণপণে দে
ছুট
তোমার কাছে আসতেই
দেখি তুমি না অন্য কেউ
আমার সব ঝড় থেমে
গেলো মুহূর্তেই
নিঃসঙ্গতা উথলে উঠলো
বুক বরাবর
আমি পুড়ছি নিঃসঙ্গতায়
এ কষ্ট বোঝাই কাকে
কেউ বোঝে না আমার
পোড়া কষ্টের কথা
~~~~~~~
মূলত তিনি
শেখ আব্বাস উদ্দিন
কত কাল পরিচর্যা
করিনি তোমাকে,
তুমি তো আমার ত্বকে,
শ্বাসে-প্রশ্বাসে
রক্তরসে, পেটের রোগে,
মাথার ব্যথায়,
কুটনো কোটায়,
স্নানের জলে;
শুকিয়ে যাওয়া ফুলের
পাপড়িতে
তোমার স্পর্শে আমার
মায়ের
রান্না ভাতের রঙ
সাদা
তুমি আলো নাকি অন্ধকার,
নাকি দুটোই
অথবা কোনোটাই নয়!
তোমার পোক্ত শির
দাঁড়া
স্তব্ধ দিঘির বিষণ্ণ
জল
রোদ বিকোনো হাটে,
জোছনা ছড়ানো রাতে
হয়তো তুমি ক্লান্ত
শরীর।
তোমাকে পাই তীব্র
অবহেলায়,
অব্যক্ত কষ্টের ক্ষণে
ভেঙে পড়া মুচড়ে
যাওয়া বাবা নামের শরীরে
সূর্যের আঁকা কালশিটে
নিয়ে
অক্লান্ত দাঁড়িয়ে
আছে।
~~~~~~~
তোমাকে ভুলতে বলো না
এস এম মঈনুল হক
কেন আমাকে বারবার
তোমাকে ভুলতে বলো? একি বিরক্ত নয়?
কেন তখন- তোমার হৃদয়ের সূক্ষ্মকোণে
আমার আত্মাকে স্থান
দিয়েছিলে?
কেন বলেছিলে- তুমি শুধু আমার?
কতদিন গোধূলি লগ্নে
কেন আমাকে দেখিয়েছিলে
মুক্তার মত জ্বলজ্বলে
তোমার নয়ন যুগলের
অশ্রুবিন্দু?
কেন আকাশ পানে চেয়ে
বলেছিলে
ওই উজ্জ্বল সন্ধ্যা
তারা
আমাদের ভালোবাসার
সাক্ষ্য বহন করছে?
কেন তখন সদ্য ফোটা
গোলাপ
আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে?
সেই রাত্রীর কথা
কেন ভুলে গেলে
যে রাত্রে গভীর লগ্নে
আমার পদ যুগলে
দু ফোঁটা অশ্রু বিন্দু
ফেলে
আমার শূন্য বুকে
তোমার স্থান চেয়েছিলে?
আমাকে ভুলে গেলেও
তোমাকে দুঃখ দেব
না।
শুধু তোমাকে ভুলে
যেতে
আর আমাকে অপরাধী
করো না।
~~~~~~~
বৃষ্টি
পঙ্কজ মান্না
ক্যালেন্ডারের পাতায় বৃষ্টি-মাস
খেত ভাসছে, বকেরা মাঠে চরে
বর্ষা-দিনে কবিতাও বানভাসি
গামছা বেঁধে মেঘ এনেছি ঘরে
হাওয়া আপিস কখ্খনো বলছে না
বসার ঘরে বৃষ্টি ছিল আজ
তবু ছিঁচকাঁদুনে ক্যালেন্ডারে দেখি
শার্সিজুড়ে মেঘের কারুকাজ
~~~~~~~
সমাপতন
নজর উল ইসলাম
মুখোমুখি ভেসে যায়
সুনিপুণ আস্বাদন
ফুটন্ত জীবন সত্য
নীল চাহনির বেবাক উচ্ছ্বাস
আমরা দু'জনই ঘুমন্ত
পাখি— বিস্ময়কর
চোখের ওপর অনন্ত
বাস্তবতা উপুড় মেঘলা উল্লাস
সময়ের তীব্র উচ্চারণ
জাগে দৃঢ়তায় দেখি
সরল গদ্যের অপার
কাব্যের বাগান বিচিত্রতায়
সব দীক্ষা ভেঙে মাটিতে
গড়াগড়ি, অমোচনীয়
যেন আকাঙ্খার আঁচল
বাঁধনহীন স্বীকারোক্তির শিকার
নিয়মের জানলায়
ভোরের পাখিরা চুপিচুপি উধাও
নকশার প্রদর্শন সার্কাসে
রূপান্তরিত একবুক জলে
অচেনা পথিক পথহারা
রহস্যের জালে আবদ্ধ
শুধুই সন্ধ্যা জুড়ে
গোধূলির মাতাল সুষমায় হত...
~~~~~~~
হারিয়ে গেলাম
পিঙ্কি ঘোষ
আবার আমি হারিয়ে
গেলাম
অজস্র না পাওয়ার
আবদারের
কংক্রিটের সাজানো
কথামালায়,
সূর্যোদয়ের সাথে
সূর্যাস্তের
গোপন চুক্তিপত্রের
স্বাক্ষর থাকে
আধুনিক জ্যামিতিক
রূপরেখায়।
জোয়ারের ভয়ে মানচিত্র
আজ নদীর ঠিকানা।
~~~~~~~
অণুগল্প
বৃষ্টি আসবে বলে
আজিজুল হাকিম
দীর্ঘদিন
ধরেই ভীষণ খরা চলছিল। ওই খরার হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। অধিকাংশ
ঘরে হাহাকারের সুর কান্নার মতো বেজে চলছিল। মানুষ বাঁচতে চাইছিল। তাই তারা চায়ছিল
মেঘ আসুক আর মুষলধারায় বৃষ্টি হোক।
এভাবেই
অনেক সময় কেটে গেল। তারপর একটি বিধ্বংসী ঝড় এলো। উচুঁ উচুঁ ঘরবাড়ির মাথা উড়ে গেল।
অবশেষে একখন্ড বিশাল মেঘ এসে সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর একটুও নড়লো না। সবাই
সেই মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকল। ওরা প্রত্যেকেই আশাবাদী - এবার বৃষ্টি হবে। কিন্তু না,
বৃষ্টি হচ্ছে না!
মাঝে
মাঝে মেঘ গুড়গুড় করে যাচ্ছে। সময় পার হচ্ছে। মাস পার হচ্ছে। বছরের পর বছর পার হয়ে
যাচ্ছে। তবুও এক পশলা বৃষ্টির আশায় সকলেই মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদিকে তাকাতে তাকাতেই
কয়েকজন উপরে চলে গেল। মুখে একফোঁটাও বৃষ্টি এসে পরলো না।
দীর্ঘ
কয়েকটি বছর এভাবেই চলে গেল - বৃষ্টি হলো না। তারপর একদিন ওই মেঘখণ্ডটি অনেকক্ষণ ধরে
গুড়গুড় করল। মেঘ আরো কালো ঘুটঘুটে হল। সবাই আবার তাকাতে লাগল। সকলেই এ ওকে বলাবলি
করতে লাগল, এবার বৃষ্টি হবেই।
ওই
দলে একটি ছোট্ট ছেলে মেঘের দিকে তাকিয়ে হাসলো আর বলল, বৃষ্টি না ছাই হবে! আরও একটা
ঝড়ের দরকার।
~~~~~~
ছোটগল্প
মলাট
আবদুস সালাম
সালাম মীনার খীমাতে
ঢুকছে ।কামরেজ বলছে দ্যাখো দ্যাখো হজরত ঐ দ্যাখো সালাম ভাই এস্যাছে।
ওরা ভূত দেখছে যেন —---!
দুজনেরই চোখ ছানাবড়া। হতচকিত
হয়ে পড়েছে। ওরা চিন্তাই করতে পারেনি যে সালাম আবার ঘুরে আসবে। যে অবস্থায় ফেলে
এসেছিলো তাতে সালামের না বাঁচারই কথা, নয়তো কোনো হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা।
এখানে সে আসবে কেমন করে? হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারেনা হজরত ।অথচ
সেই লোকটা কি না ওদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে। সুন্দর
করে ,শান্ত ভাবে কথা বলছে।
হজরত বলছে আপনি বেঁচে ফিরেছেন এটাই তো আল্লাহর
কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। নয়তো আমি আপনার ছেলে মেয়েদের কি জবাব দিতাম। নিজের সাফাই
গাইতে বলতে লাগলো আপনার কাছে কামরেজ ভাই কে বললাম যেতে।ও বললে যেতে পারবে না।
হজরত নিজেই জানে সে একজন
অসহায় মেয়েকে কেমন অচেনা অজানা জায়গায় ফেলে এসেছে ।যে মেয়েটি বাংলা ছাড়া
অন্য কোনো ভাষা জানেনা। কোন যানবাহন পাওয়া যায় না। অসুস্থ স্বামী
যে দাঁড়াতে পারছে না।উল্টে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মতো অটো ,টোটো,রিক্সা,ট্যাক্সি
পাওয়া যায় না। এখানে ঐ লোকটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলো না। গরম চাটুর মতোধুলোময়
রাস্তায় উল্টে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। কোন দিকে খেয়ালই
নেই। যে মেয়েটাকে সে রাস্তার কুকুরের মতো ফেলে এলো ,সেই
মেয়েটি তার অসুস্থ স্ত্রীকে বোনের মতো মদিনা থেকে আগলে
আগলে রেখেছে। একবার ও তার মনে হয়নি যে
এই মেয়েটা না থাকলে আমার স্ত্রীর করণীয় কাজগুলো বেশিরভাগটায় করতে
পারতো না। ওকে নিয়ে আমার ও কোন জায়গায় সঠিক কাজ করা হতো না। কৃতঘ্ন মেয়েটাও বললো না যে একটু
থেমে যাও না।
সর্বক্ষণের পরিসেবা দেওয়া ডাক্তারবাবুরা এসে বরফের ব্যাগ
মাথায় চেপে ধরলো বেশ কিছু ক্ষণ। চোখে মুখে ঠান্ডা পানি ঘষতে
ঘষতে যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ডাক্তারবাবুগণ অন্য
রোগীদের সেবায় ছুটলেন গাড়ি নিয়ে।
হজরত আলী সালাম কে বসিয়ে ছুটলো তার স্ত্রী কে আনতে। যেখানে সালামের স্ত্রীও ছিল। ওরা তো এক সঙ্গেই ফিরছিলো
মুজদালিফা থেকে। ওর স্ত্রীকে কাছে বসিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলেন “সুস্থ হলে নিয়ে যাবেন।”
সালামের স্ত্রী হজরতের
হাতে পায়ে ধরে বলছে, “একটু থেমে যান ভাই।”
একটু সুস্থ হলেই
নিয়ে যাবো খীমাতে।
বিরক্তির সুরে হজরত বলে "আমার এখন রেস্টের দরকার।
এক মিনিটও দাঁড়াতে পারবো না। পরে ফোন করবেন।”
যতোই বলে আমার ফোনের চার্জ বসে গ্যাছে। ভাই ফোন
করতে পারবো না আর ওর নেট না থাকলে কথা বলা হয়না। ততোই বিরক্তির সুরে মুখ বিকৃত করে অবলীলায় ফেলে পালালো। যেন মনে মনে তার এটাই চাইছিল!
ঠিক হয়েছে ব্যাটার।
আমাদের কে টেক্কা দিয়ে সব কিছু আগে করতে যাওয়া। ঠিক ঠিক করে সময় মতো নামাজ পড়া,
সঠিক সময় তাওয়াফ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা না ঠিক ঠিক নামাজ পড়ছে, না কোন কাজ সঠিক
ভাবে করছে।
রাস্তার নিরাপত্তা
রক্ষায় যারা আছেন তারা রাস্তা যাতে করে জঞ্জাল না থাকে তার জন্য অবাঞ্ছিত কাউকে রাস্তায়
দেখতে পেলে সরিয়ে দিচ্ছেন ।কে মরছে কে বাঁচছে তাদের দেখে লাভ নেই। মাথায় পানি রগড়ে যখন মানুষ টি একটু সুস্থ হয়ে উঠবার চেষ্টা
করছেন, দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন তখনই আবার উল্টে পড়ছেন ।
কোন জ্ঞান থাকছে না। রীনা তখন হাউমাউ করে কাঁদছে আর নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে পায়ে
ধরছে, সাহায্য করার জন্য।
বহু কষ্টে বাঙলাকে একটু থেঁতলিয়ে হিন্দি
বলার চেষ্টা করছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর
লোকেরা আরবি , উর্দু অথবা ইংরেজি বললে বুঝতে পারছেন। অসুস্থ স্বামী কে কিভাবে সুস্থ করবে
,এটাই তার মাথায় ঘুরপাক
খাচ্ছে। দাঁত ভাঙা হিন্দীতে
বলছে, “হামার স্বামী ভীষণ অসুস্থ হ্যায়। উঠতে নাহি পারতা হ্যায়।” অঙ্গ ভঙ্গি করে
ওদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন আর হাঁউমাউ করে কাঁদছে। যতো দোয়া দরুদ জানা ছিলো সব পড়ছেন আর মাথায় পানি বুলিয়ে
দিচ্ছেন ।
এই উত্তপ্ত দিনে
খোলা আকাশের নীচে কি অসহায় অবস্থা
বলে বোঝানো যাবে না। চেষ্টা করছে যাতে ট্যাক্সি বা হুইল চেয়ার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা যায় ।
নিরাপত্তা রক্ষীদের
কোন সাহায্য তো দূরের কথা হটজা হাজ্জী, হটজা হাজ্জী বলে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ওরা সব পাথরের দেশের
লোক। তাদের অন্তরটা ও যেন পাথর হয়ে গ্যাছে। কোন অনুনয় বিনয় তাদের মন গলাতে পারছেন না।
দুই হাত আকাশে তুলে
আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। কিছুই যখন ভেবে সমাধান সূত্র বের করতে পারছেন না তখন হঠাৎ বিহার থেকে আসা কোনো এক ছেলে
মানুষ হাজী ঐ রাস্তা দিয়ে হোটেলে ফেরার জন্য ঐ পথ দিয়েই আসছিল।
ওরাই তাদের ফেরার ব্যবস্থা করে
দেয় ।
খীমার ভিতর হঠাৎ
ওয়াইফাই কানেক্ট হয়ে যায়। কোন এক হাজী সাহেবের ফোনে বেজে উঠে ভূপেন হাজারিকার সেই গানটি “মানুষ
মানুষের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ দিতে পারে না ও বন্ধু”---
~~~~~~
এক বসন্তের
গল্প
পাদক
আজ বসন্ত বিকালে একপশলা বৃষ্টি ঝরিয়ে নীলান্ত আকাশ শান্ত।
সোনালী রঙ মাখা বৃষ্টির ফোঁটা তখনও পালাশের ফুলের হৃদয় ছুঁয়ে মাটিতে টপ্..টপ্.. করে
ঝরে পড়ছে..। বৃষ্টি ভেজা কচি পাতায় নরম হাওয়ার উদাস ঝিরঝির গান। এমন সময় নীলাঞ্জন
জানালার পাশে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে সেই দিকে অপলক চেয়ে ভাবতে থাকে তার জীবনের
সেই বসন্ত রঙের কথা.....
হরি কাকা…? ও হরি কাকা…? দরজাটা খোল তাড়াতাড়ি…,ভিজেপুড়ে
একাকার হয়ে গেলাম যে…।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। তাই ঘরের ভিতর থেকে বাইরের এই ডাক হরি
কাকা শুনতে পাচ্ছে না ভেবে আবার ডাকে…
হরি কাকা…ও হরি কাকা…কি হল?দরজাটা খোল…,এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে
নির্ঘাত নিউমোনিয়ায় মরবো…।
হরি--আসছি দাদাবাবু…আসছি…।
নিশ্চয়ই আমার ডাক শুনতে পাওনি?
হরি-না,দাদাবাবু একদম শুনতে পাইনি।আমি রান্নাঘরে ছিলাম। তুমি
আসতে দেরি করছো বলে রান্নাটা চাপিয়েছি। তাই শুনতে পাইনি।
ঠিক আছে.. ঠিক আছে..।
হরি--তা,আজ এতো দেরি করলে..?দুপুর গড়িয়ে বিকেল …তার উপর ভিজেপুড়ে?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপরিচিতা মহিলা বলে উঠলেন…দেরি হবে
না!আজ আমি না থাকলে কি যে হত কেন জানে..! রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ছিলেন…
হরি দেওয়ালে ঝুলালো ঠাকুরের ক্যালেন্ডারের দু্র্গা ঠাকুরের
দিকে চেয়ে একবার প্রণাম করে...আমি কতবার বলেছি, দাদাবাবু তুমি এভাবে একা একা কলকাতায়
যাবে না। কে শোনে কার কথা…! আসুন দিদিমনি আসুন, ভিতরে আসুন…।
হ্যাঁ..হ্যাঁ.., হরি কাকা দিদিমনিকে আমার ঘরে নিয়ে যাও, আমি
জামা কাপড় ছেড়ে আসছি।
হরি--আচ্ছা ঠিক আছে।
হরি দিদিমনিকে দাদাবাবুর ঘরে নিয়ে বলে…দিদিমনি আপনি এখানে
বসুন। দাদাবাবু এখনি এসে যাবে। তার মধ্যে আমি একটু চা করে নিয়ে আসি…।
অপরিচিতা...তবে বেশি দেরি করবেন না কিন্তু…আমাকে আবার ফিরতে
হবে।
হরি--যাব আর আসব দিদিমনি..।
অপরিচিতা--আচ্ছা..।
খানিকবাদে নীলাঞ্জন জামাটা পরতে পরতে ঘরে প্রবেশ..একটু দেরি
করে ফেললাম বুঝি..?
অপরিচিতা--না না দেরি কেন!
বাঃ আপনার ঘরটা সাজানো গোছানো তো! কত বই! এতো দেখছি ছোটখাটো
লাইব্রেরী!
হ্যাঁ, তা হয়তো হবে!
অপরিচিতা ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে--আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
কাওকে তো দেখছি না?
আমি আর হরি কাকা।
অপরিচিতা একটু বিস্ময়ে.. আর সবাই কোথায় থাকেন?
জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলাঞ্জন বলে...ঐ নীল
আকাশে…।
অপরিচিতা--আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না!
এর মধ্যে হরি চা নিয়ে হাজির।
দিদিমনির মুখের কথা কেড়ে বলে..সে অনেক কথা দিদিমনি। চা নিন,বলছি……।
হরি সবাইকে চা দিয়ে খাটের এক কোণায় বসে বলে.. দাদাবাবুর বয়স
তখন আট। দাদাবাবু মা বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলেন পাহাড়ে। দুর্ভাগ্যবশত গাড়িটি
একটি খাদে পড়ে যায়। মা বাবা ওখানেই মারা যায়। দাদাবাবু প্রাণে বাঁচলেও পাথরের আঘাতে
দু'চোখের দৃষ্টি চলে যায়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও আর চোখের দৃষ্টি ফিরে আসেনি। তবে
ডাক্তারবাবু বলেছেন বিদেশে একবার চিকিৎসা করিয়ে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করলে দৃষ্টি
ফিরতে পারে। টাকার অভাবে সে আর হয়ে ওঠেনি...।
নীলাঞ্জন জামার বোতাম গুলো লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। তাই সে গুলো
লাগাতে লাগাতে হরির মুখে কথায় যোগ করে..বাড়ির সব কাজ কর্ম করে এসেছে। আমাকে খাওয়ানো
পড়ানো, বাড়ি ঘর দেখাশোনা,রান্নাবান্না সব.. সব..। আর এখনো করে যাচ্ছে। এই মানুষটি
না থাকলে আমি যে হারিয়ে যেতাম…।
হরি কিছুটা ইতস্তত হয়ে...আচ্ছা..,আচ্ছা.. বুঝেছি..। আর করতে
হবে না গুনকীর্ত্তন। তোমরা গল্প কর।আমি ততক্ষণে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসি ভাতটা কতদুর
হল…।
নীলাঞ্জন কৃতজ্ঞতা স্বরে বলে...আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করলেন।বাস
স্ট্যান্ড থেকে বাড়ি পৌছে দিলেন। অথচ এখনো আপনার পরিচয় টুকু জানা হল না!
অপরিচিতা ঠোঁটে মৃদু হাসি মিশিয়ে...আমি শ্রীনিকা। মধ্যমগ্রাম
থাকি। পরিবারে মা বাবা ভাই আর আমি। বড়ো পরিবার। সংসার চালাতে বাবা হিমসিম খাচ্ছেন।তার
উপর ভাই এর পড়ার খরচ। এম এ পাশ করে একটা ঔষধ কোম্পানীর চাকরি করি।
তা অবসর সময়ে কি করেন?
শ্রী--বই পড়ে সময় কাটাই। বই পড়তে আমার ভীষন ভালো লাগে। বিশেষ
করে নীলাঞ্জন মাইতির কবিতা। তার প্রতিটি কবিতার ভাষা যেন আমার একান্ত অন্তরের ভাষা…।
প্রসন্নতার হাসি নিয়ে নীলাঞ্জন...তাই নাকি!
শ্রী--হ্যাঁ, এই তো সেদিন “জোনাকিরা আজো জেগে” বইটি কিনলাম।
দারুন…দারুন…আপনি ওঁনার কোন লেখা পড়েননি?
সে উপায় আর আমার হল কোথায়!
শ্রী--মানেটা ঠিক বুঝলাম না?
ঘরের ভিতরে কিছু
একটা নিতে এসে হরি থমকে দাঁড়িয়ে বলে…দিদিমনি, টেবিলের উপর যে বই গুলো আছে দেখুন,
তাহলে মানেটা বুঝতে পারবেন।
হরির কথায় কৌতুহলী
শ্রীনিকা টেবিলের দিকে গিয়ে অবাক!প্রতিটি বই যে নীলাঞ্জন মাইতির! সম্মাননা পত্রগুলির
ছবি আর নাম যে নীলাঞ্জন মাইতির!
শ্রী--আপনি এতক্ষণ বলেননি কেন আপনি নীলাঞ্জন মাইতি?
বলার আর সুযোগ হল কই?তাছাড়া আমি এমন লিখি না, যা ঘটা করে বলার।মাঝে
মধ্যে একটু আধটু মনের ভাবনা হরি কাকাকে শুনাই,আর হরি কাকা লিখে দেয়..
শ্রীনিকা নীলাঞ্জনের কথা শেষ না হতে হতে বলে...না না একটু আধটু
নয়,আপনি ভীষন ভালো লেখেন।আজ আমার সৌভাগ্য হল আপনাকে এতো কাছ থেকে দেখার…।
সৌভাগ্য তো আমার।আপনি না থাকলে আজ আমার যে কি হতো!
শ্রী--থাক এসব কথা..।যা হয়নি তা নিয়ে আর কথা কেন.. ? আর যা
হয়েছে তা নিয়ে কথা বললে হয় না..?
কী কথা...?
শ্রীনিকা নীলাঞ্জনের মুখের কাছে মুখ রেখে বুকের গভীর থেকে একটা নিঃশ্বাসের
বাতাস ফেলে বলে...হৃদয়ের কথা..।
নীলাঞ্জন ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে..সে কথা আমা সাজে..?
শ্রীনিকা ঠোঁটের কাছে ঠোঁট রেখে-- কেন সাজে না ..? নীল আকাশ
তো মুক্ত..তবে ডানা মেলতে বারণ কোথায় কবি..? রাত হয়ে গেছে আজ তবে আসি..আবার আসবো।
আসবেন তো..?
শ্রী--আসবো কবি..আসবো..। আপনার লেখা যে আমার ভীষণ টানে...।
সেই টানে শ্রীনিকার প্রেমসমুদ্রের উথ্থলিত জলরাশি আছড়ে পড়ে
ছিল নীলাঞ্জনের উষ্ণ বালির মরুভূমিতে। নীলাঞ্জন তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে--এই প্রত্যয়
বুকে নিয়েএক সময় বাড়ির অমতে দৃষ্টিহীন নীলাঞ্জনের সাথে সাতপাকে বাঁধা পড়ে শ্রীনিকা।
বসন্তের আগমনে শীতের শেষে রুক্ষ্ম শুষ্ক প্রকৃতি যেমন সবুজে সেজে ওঠে, শ্রীনিকা নীলাঞ্জনের
একাকিত্বের সংসার নামক গাছকে তেমন সাজিয়ে তুলেছিল স্নেহ-মায়া-মমতা ও ভালোবাসায়।
পিতৃ-মাতৃ হীন নীলাঞ্জন পেয়েছিল অন্তরের মানুষ। কিন্তু তিন বছরের বিবাহিত জীবনের শেষ
দিকের কোন এক অবিশ্বাসের দূরতিক্রম্য ঝড়ো বাতাস সে গাছে ফল ফলতে দেইনি। দূরদৃষ্টি
সম্পন্না কর্মষ্ঠা শ্রীনিকার সহজ সরল সদাহাস্য মুখের মিষ্টি হাসি, গভীর শ্রদ্ধা প্রেম
সহানুভূতি নীলাঞ্জনের মনের সেই ঝড়ো হাওয়াকে আটকাতে পারেনি। বরং সেই ঝড়ো হাওয়া মাঝে
মাঝে ভয়ংকর কালবৈশাখী রূপে ওদের বাঁধনে টান মারলেও সে বাঁধন ছিঁড়তে পারেনি। প্রকৃতির
নিয়মের মতো ভালোবাসার নিয়মে সে সম্পর্ক আবার মজবুত হয়েছে। কিন্তু এবার...তা হয়নি।তাই
এখন এই জানালার কাছে চেয়ারে হেলান দিয়ে নীলাঞ্জন উদাসীন অপরাধীর মতো কি যেন ভাবে
সারাটাক্ষণ...। আজও সেই ভাবনায় ডুবে....।
এমন সময় হরি গলাটা কেশে ঘরে ঢুকে....দাদাবাবু
এখনো এমন করে অন্ধকারে বসে কেন! আলোটা জ্বালাবে তো..।
হরি ঘরের বাল্বটা
জ্বালিয়ে খাটে বসে কি যেন বলতে যাবে.. মুখের কথা থামিয়ে নীলাঞ্জন জিজ্ঞাসা করে...বৌমনি
কি বাড়ি এসেছে?
-না তো দাদাবাবু!বৌমনি তো এতো দেরি করে না! কি জানি কোথায়
আটকে গেল..।
নীলাঞ্জন মুখে বিরক্তি নিয়ে...আটকে আর যাবে কোথায়! গেলে ওই
কোম্পানির ম্যানেজার দীপকবাবুর কাছে...।
কিছুটা প্রতিবাদের স্বরে হরি...এমন কেন বলো দাদাবাবু।বৌমনি
তোমাকে কত ভালবাসে বলতো!অফিসে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বাড়ি এসে তোমার কতো খেয়াল করে..কতো
যত্ন নেয়..। হয়তো গাড়ি ঘোড়ার জ্যামে আটকে পড়েছে..।এই এসে পড়ল বলে..।
নীলাঞ্জন উত্তেজিত হয়ে..বিয়ের পরে আমি তো ওকে অফিসে চাকরি
করতে বারণ করেছি। শুনেছে আমার কথা!না ওর টাকার প্রয়োজন। এ টাকা ওর বাহানা।কি কাজে
লাগবে টাকা! চলে তো যাচ্ছে সংসার। আসল উদ্দেশ্য ওর দীপকবাবুর সঙ্গ দেওয়া। পুরানো প্রেমিক
বলে কথা..সেই জন্য চাকরিটা ছাড়েনি। এখন তো প্রায় রাত করে বাড়ী আসছে..। আসলে কি জান
হরিকাকা? এ সংসারে ও হাঁপিয়ে উঠেছে আমাকে নিয়ে। আমার মতো অন্ধের বোঝা আর কত দিন বওয়া
যায়! ও মুক্তি চাইছে হরি কাকা..ও মুক্তি চাইছে..।
হরি নরম স্বরে বলে..তুমি বৌমনিকে ভুল ভাবছ দাদাবাবু। বৌমনির
মুখখানা তুমি দেখতে পাওনা তাই একথা বলছো। যদি দেখতে বুঝতে ওই মুখে কতো মায়া মমতা ভালোবাসা
তোমার জন্যে..।
নীলাঞ্জন তেমনি গম্ভীর...হয়তো ছিল একটা সময় ..। এখন দীপকবাবুর
জন্য।এখন তো প্রতি রাতে ফোনে কথা..কতো হাসি..।সাবধানে যাবেন..শরীরের খেয়াল রাখবেন..
চিন্তা করবে না..কতো ..সোহাগ..।
হরি..তুমি যাই বলো দাদাবাবু তোমার ভাবনায় ভুল
হচ্ছে।তোমার এই অসহায়তার জন্য বৌমনি এখনো চোখের জল ফেলে। কাল রাতেই তো দুঃখ করে বলছিল
..”হরিকাকা,ওর চোখের দৃষ্টি থাকলে এ সুন্দর পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ মেখে ও আরো আরো লিখতে
পারতো..। আমাকে নিয়েও কত লিখতো..।আজ অন্ধকারে আমার কবি..!ওর কষ্ট যে আমি আর সহ্য করতে
পারছি না হরিকাকা..আমি যে অসহায় হয়ে পড়ছি..।”
নীলাঞ্জন তাচ্ছিল্যতা নিয়ে বলে...ওসব ওর মন গড়া মিথ্যে কথা..।
হরি--না..না... দাদাবাবু ..না..না..
হরির কথা শেষ হতে না হতে দরজায় টক্ টক্ শব্দ। হরি উল্লোসিত
হয়ে খাট থেকে তাড়াতাড়ি নামতে নামতে বলে..ওই বুঝি বৌমনি এসে
গেছে।তুমি বস আমি দেখছি..। এক প্রকার দৌঁড়ে হরি দরজা খুলে দিয়ে দেখে থানার ও সি সহ
কয়েক জন পুলিশ দাঁড়িয়ে। পুলিশ দেখে হরি হতভম্ব হয়ে যায়..।
আমরা থানা থেকে আসছি।এটা কি নীলাঞ্জন মাইতির বাড়ি?
-হ্যাঁ স্যার।কেন বলুন তো?
উনি কি বাড়িতে আছেন?ওনাকে একবার আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে
হবে।
ততক্ষণে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাঞ্জনকে দেখিয়ে হরি
বলে ইনি নীলাঞ্জনবাবু ।
-আপনি নীলাঞ্জনবাবু?
ভয়ে ভয়ে নীলাঞ্জন -হ্যাঁ।কেন বলুন তো!
আপনাকে যে একবার আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।
নীলাঞ্জন-কেন স্যার?
জামার পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে
নীলাঞ্জনকে দিয়ে একজন পুলিশ বললেন..আপনার স্ত্রীর নাম কি শ্রীনিকা? এই কাগজটা আমরা
রেল লাইনে পড়ে থাকা ব্যাগ থেকে পেয়েছি।
পুলিশের প্রশ্নের উত্তর নীলাঞ্জন ঘাড় নেড়ে জানায়..হ্যাঁ।
-দেখুন তো এই কাগজে কি লিখেছেন উনি।
নীলাঞ্জন দুরু দুরু বুকে কাঁপা কাঁপা হাত কাগজটা হাতে নিয়ে
পড়তে থাকে..
আমার প্রাণের কবি,
সেদিনের সেই পড়ন্ত
বিকালের বৃষ্টি ভেজা বসন্তে আমার হৃদয় যেমন করে তোমাকে ভালোবেসে অনুরণিত হয়েছিল,আজো
আমার হৃদয় তেমনি করে অনুরণিত কবি। পৃথিবীর সব পবিত্রতা আর বুকের সুধা দিয়ে তোমাকে
ভালোবাসেছি আমি।সেই পবিত্রতা আজ হারিয়েছি। বিদেশে নিয়ে তোমার চোখের পরীক্ষা করাবো
বলে টাকায় প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনে দীপকবাবুকে ধরে ওভার টাইমের কাজ শুরু করি।
তুমি কষ্ট পাবে বলে সে কথা তোমাকে জানাইনি। দুর্বলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ঐ দীপকবাবু
আমার শরীরটাকে আজ ছিঁবড়ে ছিঁবড়ে খেয়েছে। অপবিত্র করে দিয়েছে আপনাকে।
আলোকে অন্ধকারে ঢাকলে সে আলো নিজ শক্তিতে আবার ফিরে আসে কিন্তু
অন্ধকারকে অন্ধকার দিয়ে ঢাকলে সে তো আর আলোয় ফিরতে পারবে না। তোমার অন্ধকার জীবনে
আলো হতে এসে আমি যে আরো অন্ধকার হয়ে গেলাম।অবিশ্বাসী অপবিত্র অন্ধকারের চিহ্ন হয়ে
তোমার জীবনে থাকতে যে আমি পারবো না।তাই তোমাকে ছেড়ে থাকার কঠিন যন্ত্রণা বুকে চেপে
অনেক দূরে চলে গেলাম নীলাঞ্জন...।
তোমাকে ছেড়ে গেলেও আমার এই অশরীরী আত্মা তোমার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত
থাকবে কবি। তোমার রঙে রঙিন হয়ে যে বসন্ত আমার হৃদয়ে এসেছিল সেই বসন্ত নিয়ে আমি বিদায়
নিলাম...। পাথর বুকে একবার হাত রেখে দেখো এখনো বইছে সেই সুধার অন্তস্রোত যা তোমার জন্য
রেখেছি..।
আমাকে দেখার খুব ইচ্ছা তোমার না! তাই যাওয়ার আগে আমার এই চোখ
দুটো তোমাকে দিয়ে গেলাম।এই চোখ দিয়ে প্রান্তের সবুজ ঘাসের বুকে ছোট্ট ফুলে,নীল আকাশে
কোলে সাদা মেঘে, সাগরের তীরে ভেঙে পড়া কোন ঢেউয়ে আমাকে তুমি দেখো। তোমার কাছে শেষ
চাওয়া কবি..তোমার নতুন চোখ দিয়ে যখন তুমি বসন্ত পলাশের রক্তরাগে দিগন্তে হরিয়ে যাবে
তখন এই শ্রীনিকার জন্যে শুধু একটা..শুধু একটা... কবিতা লিখে ঐ নীল আকাশের বুকে উড়িয়ে
দিয়ো। সেই কবিতা খানি বুকে জড়িয়ে বলবো.. ”আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন তোমাতে করিব
বাস।”
~~~~~
আপনাদের সুচিন্তিত মতামত কামনা করছি
ReplyDelete