তালেবানের উত্থান, পতন এবং পুনরুত্থান
আজিজুল হাকিম
~~~~~~~~~~~~~~
তালেবানের নাম শুনলেই মনের মাঝে একটা আতঙ্ক
কাজ করে । ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে শিহরণ দেখা যায় । তালিবান মানেই একটা সমাজ ও দেশের বিধ্বস্ত
ছবি হৃদয়ের মাঝে ভেসে উঠে । সেই তালিবানের উত্থান, পতন ও পুনরুত্থানের কাহিনীতে আসছি
।
আফগানিস্থানের পশতু বা পাস্তু ভাষায় তালিবান
শব্দের উৎস । যার বাংলায় মানে দাঁড়ায় ছাত্র । ১৯৯০ সালে এই তালিবান আন্দলনের উৎপত্তি
বা জন্ম । এই আন্দোলনের প্রথমে মূলত পশতুন অর্থাৎ পশতুভাষীদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা
যায়। ধারণা করা হয়, এই এলাকার মাদ্রাসাগুলোতে প্রথমে এরা সংগঠিত হয়। এই মাদ্রাসাগুলো
পরিচালিত হতো সৌদি অর্থে - এবং সেখানে খুবই কট্টর সুন্নী মতাদর্শের ইসলামই প্রচার করা
হতো।
পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান - এই দুই দেশের
সীমান্তের দু'দিকেই আছে বিস্তীর্ণ পশতুন অধ্যূষিত অঞ্চল। তালেবান এসব অঞ্চলে খুব দ্রুতই
প্রভাবশালী হয়ে উঠে। এরপর এরা আফগানিস্থান ও পাকিস্থানের সীমান্তবর্তী এলাকা দখল করে
নেয় । তারপর তালেবান নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় এলে তারা দেশের মাঝে শান্তি
এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে এবং কঠোর শরিয়া শাসন জারি করবে । তারপর কান্দাহার শহরটিও
অধিকার করে নেয় । তারপর কয়েক বছর যেতে না যেতেই ১৯৯৬ সালে কাবুল অধিকার করে আফগানিস্থানের
কমিউনিস্ট পার্টির শেষ প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ আহমেদজাইকে প্রকাশ্য জনসভায় ফাঁসি দিয়ে
হত্যা করে ।
তারও আগে অস্থির আফগানিস্থানে কমিউনিস্ট শাসনের
হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইসলামিক মুজাহিদিন বাহিনী শাসনের দায়িত্ব দখল করে । আর এই মুজাহিদিন
বাহিনীর সঙ্গে ১৯৮০ সাল থেকে তালিবানের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে
আসছিল । তখন আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চরমভাবে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে । এই ঠাণ্ডা
লড়াইয়ে আমেরিকা জয়ী হওয়ার জন্যে সকল কৌশল অবলম্বন করে । ফলে এই মুজাহিদিন বাহিনীকে
আমেরিকা প্রচুর পরিমানে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে । আমেরিকার সহযোগিতায় মুজাহিদিন
বাহিনী বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে । তারপর ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করলে সোভিয়েত
ইউনিয়ন আফগানিস্থান থেকে সরে যায় ।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই দেশের মাঝে চরম
অরাজকতার সৃষ্টি হয় । সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মুজাহিদীনদের
মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্ব শুরু হয়। তাদের বাড়াবাড়িও আর লোকে পছন্দ করছিল না। এরকম অবস্থায়
তালেবান যখন প্রথম দৃশ্যপটে আসে, তখন আফগানিস্তানের মানুষ সাধারণভাবে তাদের স্বাগত
জানিয়েছিল।
তারা প্রেসিডেন্ট
বুরহানউদ্দীন রাব্বানির সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
বুরহানউদ্দীন রাব্বানি
ছিলেন আফগান মুজাহিদীন বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৮০-র দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত
বাহিনীর বিরুদ্ধে এই আফগান মুজাহিদীনরা প্রতিরোধ সংগঠিত করেছিলেন।
১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৮
সাল নাগাদ তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
করে।
তালেবানের প্রথম
দিকের জনপ্রিয়তার মূলে ছিল কয়েকটি বিষয়: তারা দুর্নীতি দমনে সাফল্যে দেখিয়েছিল,
আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিল, তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত রাস্তা দিয়ে এবং অঞ্চলে নিরাপদে
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছিল।
এমনকি আফগানিস্থানের
বুকে ঘটে যাওয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধ তালিবান চিরতরে বন্ধ করে দিতে সক্ষম
হয়েছিল ।
তবে তালেবান একই
সঙ্গে তাদের জারি করা কঠোর শরিয়া শাসনের অধীনে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো
শাস্তি চালু করে। অপরাধী কিংবা ব্যাভিচারীদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হতো, চুরির দায়ে
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হাত কেটে নেয়া হতো। আর পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের পুরো
শরীর ঢাকা বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হয়।
তারসঙ্গে তালেবান
টেলিভিশন, সঙ্গীত এবং সিনেমা নিষিদ্ধ করে। দশ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার
দরকার নেই বলে নিয়ম জারি করে।
তারপর ধীরেধীরে তালেবানের
বিরুদ্ধে বহু ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসের অভিযোগ উঠে। তাদের
সবচেয়ে ভয়াবহ কাণ্ড ছিল ২০০১ সালে মার্চ মাসে আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলে বিখ্যাত বামিয়ান
বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করা। আর এর বিরুদ্ধে তখন আন্তর্জাতিকভাবে চারিদিক থেকে নিন্দার
ঝড় উঠে।
এদিকে ৯/১১ আক্রমণে
আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস হলে আমেরিকা তথা বিশ্বের রাজনৈতিক মহল সন্দেহ করে এর পিছনে
লাদেনের দ্বারা সংগঠিত আল-কায়দার হাত আছে । আর এই আল কায়দার সঙ্গে তালিবানের গভীর সংযোগ
আছে । এই কারণে লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে আদেশ করা হলে তালিবান লাদেনকে
আমেরিকার হাতে তুলে দিতে অসম্মতি প্রদর্শন করে ।
এই কারণে ২০০১ সালের
৭ অক্টোবর আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ও তার ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্থান
আক্রমণ করে । এদিকে অবশ্য মুজাহিদিন বাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডার আব্দুল রব রাসুল আমেরিকাকে
আফগানিস্থান আক্রমণে আমন্ত্রণ জানায় । কয়েক মাসের যুদ্ধের পর তালেবান পরাজিত হয়ে তাদের
ক্ষমতা থেকে সরে যায় । ফলে আমেরিকার সহযোগিতায় হামিদ কারজাই ওই বছর ডিসেম্বর মসে সে
দেশের প্রেসিডেন্ট পদে স্থলাভিষিক্ত হন ।
দেশের মাঝে ফিরে
আসে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার যা ১৯৬০ সালের আগে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাহির শাহ-র
আমলে সেখানে সকলের সমানাধিকারের আইন বলবৎ ছিল ।
যাহোক, তালেবান তাদের
ক্ষমতা থেকে সরে এলেও আফগানিস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি টিকিয়ে
রেখেছিল । ফলে তারা তাদের যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে ন্যাটো জোট আর আফগান সরকারের বিরুদ্ধে
লড়াই অব্যাহত রেখেছিল । এর পিছনে আর একটা বড় কারণ ছিল, যেটি আফগানিস্থানের ভৌগোলিক
অবস্থা । আফগানিস্থানের প্রায় অঞ্চলই পাহাড়, পার্বত, গিরিখাতে পরিপূর্ণ । সে সব যায়গায়
লুকিয়ে যুদ্ধ করার কৌশল তাদের জানাছিল, যেটি আমেরিকা বা তার ন্যাটো জোটের কাছে একটি
বড় চ্যালেঞ্জ । সেখানে তালেবান তাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষমতা অর্জন
করেছিল । এর পিছনে আর একটা কারণ ছিল বলে ধারণা করা হয় – সেটি হল ধর্মীয় উন্মাদনা ।
যে যাই বলুক না কেন, সেটি ছিল তাদের কাছে ধর্ম যুদ্ধের সামিল । কারণ তারা ইসলামিক শারিয়া
আইন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল আর ইসলামিক মতে যারা ধর্ম কায়েম করতে গিয়ে শহীদ হবে তারা
মৃত্যুর পরে কোন হিসাব ছাড়ায় জান্নাতবাসী হবে; যেখানে অনন্তকাল শান্তিতে থাকবে । স্বাভাবিকভাবেই
তাদের কাছে জীবন উৎসর্গ কোন ব্যাপার বলে মনে হয়নি ।
এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের
ফলে সেখানে কোনভাবেই শান্তি ফিরে আসেনি । যার কারণে ৪০০০০ বেসামরিক নাগরিক, ৬৪০০০ সরকারী
সেনা এবং ৩৫০০ ন্যাটো জোটের সৈন্য মারা যায় । ওই সব যুদ্ধে, এমনকি আমেরিকার গুচ্ছবোমে
এবং ড্রোন হামলায় তালেবানের বহু নেতা মারা গেলেও তাদের মিশন চরমভাবে অব্যাহত রেখেছিল
। তাদের লক্ষ্য থেকে তারা এক পাও পিছিয়ে আসেনি । তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ কুড়ি
বছর ধরে তারা সরকার ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে এসেছে ।
এদিকে তালেবান যখন
আফগানিস্থানের একটি একটি করে প্রদেশ দখল করে তাদের অধিকারে নিয়ে আসছিল; সেই সময় অর্থাৎ
২০১১ সালে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার সম্মতিতে তলেবান কাতারের রাজধানী দোহাতে
তাদের অফিস আফগানিস্থন থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য হল কারজাই সরকার যেন তালেবানদের
সঙ্গে মুখোমুখি কোন আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে । এর পর ২০১৩ সালে তারা কাতারে তাদের স্থায়ী
অফিস খুলে বসে । অবশেষে ২০১৮ সালে আমেরিকার
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের নির্দেশে দোহাতে তালিবানের সঙ্গে আমেরিকার প্রশাসনিক
উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা সরাসরি শুরু হয় । পরে ২০২০ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্থান
থেকে আমেরিকার সঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এখানে লিখিত করা হয়,
২০২১ সালের ২রা মে-এর মধ্যে আমেরিকা ও তার ন্যাটো বাহিনী তাদের সমস্ত সৈন্য আফগানিস্থান
থেকে ফিরিয়ে নেবে । এই সময়ের মধ্যে তালেবান বা ন্যাটো বাহিনী কেউ কাউকে আক্রমণ করবে
না ।
এর ফলে সেখান থেকে
বিদেশী সেনা যতই সরে যেতে থাকে ততই তালেবান বাহিনী তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাত্রা
বাড়িয়ে একের পর একটি রাজ্য দখল করে নিতে থাকে । অবশেষে সকল বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে,
সমস্ত গোয়েন্দা সূত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে অতি দ্রুত ২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট তারা আফগানিস্থানের
রাজধানী কাবুল দখল করে নেয় ।
তবুও প্রশ্ন আসে
তালেবান কি আফগানিস্থানকে শান্তিতে রাখতে পারবে ? তাদের কট্টর ইসলামিক শারিয়া আইন চালু
করে নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার, তাদের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের
স্বাধীনতা, সাধারণ মানুষের শিক্ষার স্বাধীনতা, শান্তিতে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা ফিরে
পাবে? না রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলেই আফগানিস্থানের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে? এ প্রশ্নের
উত্তর একমাত্র কালের কণ্ঠেই বেজে উঠবে একদিন ।
আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম
ReplyDelete