NARI O PRITHIBI/নারী ও পৃথিবী - আজিজুল হাকিম


 

নারী ও পৃথিবী

আজিজুল হাকিম

~~~~~~~~~~ 

তারপর আমি নির্বাসিত । কোন এক নির্জন দ্বীপে । অথবা দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে । এক জগত থেকে অন্য জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছি । নির্মম একাকীত্বের হাত ধরে । আমি যেন একটি বিচ্যুতময় ধূমকেতু বা উল্কাপিণ্ড । আমার কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়েছি কখন । আপন খেয়ালে । কিন্তু কোথায় ! জানিনা । বিচ্ছেদের বেথায় বেদনাতুর বুক । কখনও মনে হয়, শিমূলের পাখড়া খসা উড়ন্ত পেঁজা তুলোর মতোই নিয়তির ভেলায় ভেসে চলছি তো চলছিই । বুকের মাঝে একটি ভীরু বীজ । আশ্রয় চায় । একটি ছোট্ট আশ্রয় । একটি নারীর বুকে---একটি পৃথিবীর বুকে । হৃদয়ের অতল তল আর আমার চারিপাশ বাসন্তিক রাতের স্বপ্নে বিভোর । বড়ো অস্থির । অধীর, চঞ্চল । 

পৃথিবীও কি একটি নারী ! হয়ত তাই । নারীর মতোই তারও বুকে তো আগুন আছে । শ্যামলীমা মায়াবি সৌন্দর্য আছে । নারীর মতোই তার বুকেও তো ফুল ফোটে । ফল হয় । পৃথিবী কি নারীর মতোই কামনীয় ! নারীর মাঝে কি নেই তা পৃথিবীর বুকে আছে ? নারীর ওই দুটি ক্ষুদ্র চোখের মাঝে কি পৃথিবীর মহাসাগর হারিয়ে যাবে না ? পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, সমভূমি সবই তো নারীর দেহে বিচরণ করছে ।

আমাকে তো ভাবতে ভালই লাগে --- পৃথিবী একটি নারী । আর নারী একটি পৃথিবী । এই ভাবনা আমার মধ্যে নিহিত থাকলেও প্রকাশ পায়নি । সেদিন মুন্নি আমার এই ভাবনাকে আরও গঠনমূলক, আরও দৃঢ় করেছিল ।

সেদিন কলেজ পথে চলতে চলতে মুন্নি আর আমার মাঝে কোন একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছিল । ওই বিতর্কের মাঝেই সে বলেছিল--- জানিস, আমরা, নারীরা পৃথিবীর জাত ? আমরা না থাকলে তোদের অস্তিত্ব অসম্ভব । আমাদেরকে উর্বর করতে পারলে আমরা উৎপাদন করতে পারি । আমরা জীবনকে লালন করি । জীবনের জন্ম আমরাই দিই । আমরা আছি তাই তোরা আছিস । আমাদের মাঝে পৃথিবীর সব গুণ পাবি । 

ওর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম--- তোরা যদি পৃথিবীর জাত হোস, তাহলে আমরা, ছেলেরা মেঘেদের জাত । মেঘ পৃথিবীর ওপর ভেসে বেড়ায় । তেমনি আমরাও তোদের বুকের ওপরে । আমাদের বৃষ্টির ধারায় তোদের দেহটা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠে । আমাদের অভাবে তোদের বুকটা সাহারা মরুভূমি । অবশ্য পৃথিবীর গাছপালা যেমন পৃথিবীর সৌন্দর্য বাড়ায়, মেঘেদের আকর্ষণ করে, তেমনি তোদের সৌন্দর্য আমাদেরকে আকৃষ্ট করে । বৃষ্টির পরে যেমন মেঘেদের কোন অস্তিত্ব থাকে না, পৃথিবীর মাঝে লীন হয়ে যায়; তেমনি আমরাও তোদের মাঝে হারিয়ে যাই । মেঘেদের মতো আমাদেরও মৃত্যু নেই । পরিবর্তন হই মাত্র ।

সেদিন মুন্নির সঙ্গে এই বিষয়ে আরও কত কি আলোচনা হয়েছিল । ও আমার চোখের মাঝে ওর চোখ দুটো আঁটকে রেখেছিল । মুখে ছিল অপার প্রসন্ন হাসি ।

তাই আজ পৃথিবীর মানচিত্র আর গ্লোবের ওপর চোখ পড়লেই একটি নারী আমার হৃদয়ের আয়নায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে । অসহায় নগ্ন যুবতী নারীর প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে । ওর অপরূপ রূপ অকল্পনীয়ভাবে সুন্দর । যার মাঝে অপার বিস্ময় সব সময় বিরাজ করছে । যার রূপ বিচিত্রময় । যৌবন অনন্ত । ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথের ‘অহল্যার প্রতি’ কবিতার ঝঙ্কার হৃদয়ের মাঝে বেজে উঠেঃ

অপূর্ব রহস্যময়ী মূর্তি বিবসন

নবীন শৈশবে স্নাত সম্পূর্ণ যৌবন

পূর্ণফুট পুষ্প যথা শ্যামপত্রপুটে

শৈশবে যৌবনে মিশে উঠিয়াছে ফুটে

এক বৃন্তে । বিস্মৃতি – সাগর নীলনীরে

প্রথম ঊষার মত উঠিয়াছে ধীরে ।………

তবুও এ উর্বশী রাতের গভীর অন্ধকারে হাতে হাতে বদল হয় । বোমের বিস্ফোরণে পুড়ে ক্ষতবিক্ষত, ছারখার হয়ে যায় । রক্তের প্লাবনে ভেসে যায় । বুকটা রক্তাক্ত হয় । তুষারের আঁচলে নির্বাকভাবে আর্টিক মহাসাগরে মুখ লুকায় । সময়ের ঝঞ্ঝায় ওর বুকে গড়ে উঠে গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র । একের পর এক সীমান্তের বেড়াজালে, সীমান্তের কাঁটায় জর্জরিত হয় ওর বুক । কেবল মাত্র রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়ে চলে । সকল তন্ত্রের লক্ষ্য একটা- শক্তিতন্ত্র । আপন শক্তিকে কায়েম রাখা ।

এ চিরযুবতী একালের নয় । যার বয়স সন্দেহাতীত । ডায়নোসার যুগেরও কয়েক লক্ষ বছর আগের কথা হয়ত । যখন মানুষ লেজ নিয়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াত । ঠিক তখনকার । এই মেয়ে । এরও লেজ আছে । লেজ ছিল । লেজ থাকবে ।

মকরক্রান্তি রেখার কিছুটা উত্তরাংশ নিয়ে । দক্ষিণ আমেরিকার সম্পূর্ণ দক্ষিণ অংশ-হর্ন অন্তরীপ পর্যন্ত ওই নারীর লেজ । অর্থাৎ ঐ মহাদেশের ব্রাজিলের সেরা ডা-মণ্টিকুইরা, সেরা ডোমার অঞ্চল এবং আটাকামা মরুভূমি থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ দিকে প্যাটাগোনিয়া পম্পাস হয়ে আরো দক্ষিণে ম্যাগেলান প্রণালী দিয়ে, টিয়েরা ডেল ফুয়েগো হয়ে হর্ণ অন্তরীপে এসে যার শেষ হয়েছে । গ্রান চাকো অঞ্চলও ওই লেজের মধ্যেই অবস্থিত ।

ওই কুমারীর নিতম্ব দুটি হল দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরের পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত । পূর্বে বার্বোরেমা মালভূমি এবং ব্রাজিলের উচ্চভূমি হল ডান নিতম্ব আর বাম নিতম্বটি হল পশ্চিমের আন্দিজ পর্বতশ্রেণী । পানামা হল ওর সুরু কমনীয় কোমর ।

তারপর পানামার উত্তর থেকে সুদূর কানাডা পর্যন্ত ওর পিছন দিক বিস্তৃত হয়ে চলে গেছে । ওর ডান বাহু উত্তর আমেরিকার পূর্বাঞ্চল । অর্থাৎ আপালেশিয়া পর্বতশ্রেণী হয়ে উত্তরপূর্বের ক্যানাডিয়ান শিল্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে । লরেন্স মালভূমিও ওই ডান বাহুর মধ্যেই অবস্থিত । তার আরও উত্তরে লাব্রাডার অঞ্চল ওই রমণীর দারুণ সুন্দর কাঁধ । ওর বাম কাঁধ উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতমালা, ওয়াচ পর্বতশ্রেণী এবং কোস্টরেঞ্জ পর্বতশ্রেণী । ওই মহাদেশেরই পশ্চিমাঞ্চল ---আলাস্কা পর্বতশ্রেণী, ব্রুক্স পর্বতশ্রেণী এবং ম্যাকেঞ্জি পর্বতশ্রেণীও ওর বাম কাঁধের মধ্যেই পড়ছে । বাম বাহুকে ঢেকে আছে আলাস্কা উপসাগর এবং বিউফোট সাগর । ওই যুবতীর গলার পিছন দিক হল ভিক্টোরিয়া, ব্যাকঙ্কিস, কুইন এলিজাবেথ, অ্যাক্সেল হাইবার্গ এলিস মিয়র দ্বীপ সমূহ । আর পিছনের মাথা হল চিরতুষারে আবৃত্ত গ্রীণল্যাণ্ড ।  

এ তো গেল পিছনের দিক । আর সামনের দিক হল এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মহাদেশ । শ্রীলঙ্কা হল ওই নগ্ন চির যুবতীর যোনিদ্বার । বিভিন্ন ধর্ম মতে যেখানে মানব জাতির প্রথম পুরুষ আদমের স্বর্গ থেকে মর্তে আবির্ভাব ! রমন ক্রিয়ার পূর্ব মুহূর্তে ওই নারী তার হাঁটু বগল অবধি তুলে যেন কার নীল সাগরের বিছানায় আছে শুয়ে আছে ! দক্ষিণ ও মধ্য ভারত এই লাবণ্যবতীর সুষমা-দীপ্ত পেট । ওর বাম ঊরু উত্তরপূর্ব ভারত । সেখান থেকে হাঁটু চলে গেছে চীন ও মঙ্গোলিয়ার উত্তরপূর্ব সীমা পর্যন্ত । ওর অতি সুন্দর বাম জাঙ্ঘটির মধ্যে বাংলাদেশ, উত্তর পূর্ব ভারতের সবুজ প্রান্তর, জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতমালা, হিমালয় পেরিয়ে, চীনের বিশাল গোবি মালভূমি আর মঙ্গোলিয়ার মালভূমি অবস্থান করছে । ওর হাঁটুর মধ্যে অবস্থিত ইয়াবোনোভি, বৃহৎ খিঙ্গান পর্বত । তার বাঁ পা নেমে এসেছে বৃহৎ চীন সমভূমি হয়ে আরো দক্ষিণে লাওস, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত । অবশ্য অস্ট্রেলিয়া তার পায়ের পাতা ।

ওর ডান ঊরু পশ্চিম ভারতের গুজরাট, রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চল এবং সিন্ধু নদীর সমভূমি থেকে শুরু হয়েছে । তারপর ইরানের মালভূমি, লবন মরুভূমি এবং আফগানিস্থানের পশিমাঞ্চল হয়ে ইউরোপ মহাদেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চল ওই ঊরুর মধ্যেই পড়ছে । আল্পস পর্বতশ্রেণী ওই যুবতীর ডান হাঁটু । সেখান থেকে দক্ষিণে নেমে আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমি পেরিয়ে আগুলহাস এবং জাইর আববাহিকা ওই ডান পায়ের মধ্যেই অবস্থিত ।

সব মহাসাগরগুলো ওই লাবণ্যবতী, সুন্দরী, রহস্যময়ী যুবতীর ছলছল কম্পমান নীল বেডকভার । আর ক্যাপ্সিয়ান সাগর, ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর এবং পূর্বে তিমির সাগর হল ওই কুমারীর ছিন্নবস্ত্র । যা পায়ে এখনো জড়িয়ে আছে । ওর পোষাক খুলে, ছিঁড়ে জড়ো হয়ে শুভ্র বস্ত্রের আস্তরণ রূপে পড়ে আছে । পায়ের তলায়, আন্টার্টিকা । ঊর্ণাটি ওই যুবতীর মুখটি ঢেকে সুমেরু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে অসম্ভব লজ্জার আঁচলে মুখ ঢেকে আছে ।

পামির মালভূমির পূর্বাঞ্চল এবং টাকলামাকান পর্বতমালার পশ্চিমাঞ্চল হল ওই যুবতীর চিরশুভ্র সুডৌল বুক । হিন্দুকুশ পর্বতমালা এবং হিমালয় পর্বতমালা ওই যুবতীর সুডৌল স্তন-জোড়া ।  পৃথিবীর কামনা প্রমত্ত, রতির অব্যক্ত উল্লাস শুভ্রতার জৌলসে জ্বলজ্বল করছে । সূর্য কিরণের সোনালি পরশে সেগুলি আরো রক্তাভ আরো ব্লাস্ফুল হয়ে উঠে ।

তবুও পৃথিবী অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভুগে । ওর স্তনচূড়া হতে চুয়ে পড়ে অমৃতধারা । সবসময় । নারীর স্তনের নীলাভ শিরার মতই পৃথিবীর স্তনে হিমবাহের ফলে দাগ হয়ে যায় । ওর স্তনের মধু ওর শরীরের চারিদিকে আবার প্রখর রোদে শুকিয়ে যায় । নারীর দুগ্ধবতী স্তনে দুধ গড়ে শুকিয়ে যাওয়ার মতো দাগ পৃথিবীর বুকে স্পষ্ট ।

তারপর আরো উত্তর দিকে ওর দুই বাহু সোভিয়েতের সাইবেরীয় অঞ্চল দিয়ে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত হয়েছে । গলাটা আর্টিক মহাসাগরের তলে হারিয়ে গেছে । তুষারের ঊর্ণা মুখে দিয়ে ওর লজ্জারুণ মুখমণ্ডল ঢেকে আছে সুমেরুর তলায় ।

আর এদিকে অর্থাৎ এই নারীর পায়ের তলায় নীল বিছানা-ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আন্টার্কটিকার তুষারের রূপে পবিত্র শুভ্র পোষাক বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে । ওই পোষাক হল ওই নারীর শাড়ি । আকুল আকাঙ্ক্ষায় ওর শাড়ির আঁচলে এক নির্বাক শিহরণ লেগে আছে । ওই শাড়ির আঁচলে সবসময় স্বপ্ন মর্মরিত হয় । কখন, কবে ঢাকতে পারবে ওই নারীর ক্ষয়ে পড়া ইজ্জত ?

গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে রাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের শিখড়ে আরোহণ করে এই বিশ্ব জগত । সকল তন্ত্রই শক্তির পদতলে আত্মহুতি দেয় । আর এই সব তন্ত্রের নায়কেরা শিয়াল, কুকুর আর শকুনের মতোই এর উপরে আধিপত্য নিয়ে একে টানাটানি করে । তবুও কালের স্রোতে এরা কোথায় হারিয়ে যায় আর এই যুবতী যৌবনের উল্লাসে হেসে উঠে । ঠিক তখন পথিক সবুজ পৃথিবীর অন্তহীন পথ ভেঙ্গে চলে সৌন্দর্যের পিপাসায় । পৃথিবীর বুকে স্বর্গ দেখে সে অভিভূত হয় । কোথায় যেন আঁটকে যায় তার চোখ, মন, হৃদয় । সে থমকে দাঁড়ায় ।

ঠিক একইভাবে আমি আঁটকে গেলাম । কোন এক পৃথিবীর বুকে, কোন এক নারীর বুকে । তার নাম খালেদা । আমার এক গভীর গোপন দুর্বলতা । এক নিষ্পাপ ভালোবাসা ।

Post a Comment

Previous Post Next Post