একটি ছোট্ট দুর্ঘটনা মাত্র
- আজিজুল হাকিম
সুজন একদম দিশেহারা
হয়ে গেল । সমস্ত অবলম্বন হারিয়ে গেলে যেমন হয়; তেমনি অসহায়ভাবে সুবিস্তৃত মাঠের মধ্যে
একাকি বসে আছে । চোখের সামনে সুন্দর মাঠ তার সবুজ হাসি নিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে । বাতাসের
অদৃশ্য ছোঁয়ায় সবুজ ফসলগুলো তাদের মাথায় সুন্দর ঢেউ তুলতে তুলতে দিগন্তের ওপারে গিয়ে
হারিয়ে যাচ্ছে । তবুও তার হৃদয়ে কোন রকম রেখাপাত করতে পারছে না । উদাসী মন কোথায় যেন
হারিয়ে গেছে । তার মনের মাঠখানি মরুভূমির শূন্যতায় ভরে আছে ।
আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা । সুজন তার
বর্তমান স্ত্রী স্নিগ্ধাকে পাশে রেখে সবিতা নামের একটি আইবুড়ো মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়
। তার স্ত্রীর একটাই দোষ ছিল, তা হল সে শ্যামা বর্ণের । যদিও স্বামীর চাওয়া-পাওয়া,
সংসারের দায়দায়িত্ব যথাযথ পালন করে যাচ্ছিল । অপর দিকে সবিতার একটিই গুন ছিল, তা হল
সে দেখতে সুন্দরী ।
একদিন সুজন স্নিগ্ধাকে রেখে সবিতাকে নিয়ে পালিয়ে
গেল । মামনি পড়ে রইল শ্বশুর বাড়িতে । কিন্তু দু-এক মাস যেতে না যেতেই শ্বশুর শ্বাশুড়ির
গুঞ্জনা, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিন বছরের ছেলেটিকে নিয়ে চোখের জলে নাক, মুখ,
বুক ভিজিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল ।
শ্বশুর
বাড়ি থেকে মামনির বিদায়ের দুমাস পরেই সুজন সবিতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল । শ্বশুর শ্বাশুড়ি
সাদরে নতুন বউকে বরণ করে নিল ।
তারপর
সুজনের দাম্পত্য জীবন নির্ঝঞ্ঝাটেই কেটে যাচ্ছিল । মাস পেরিয়ে বছর, বছর পেরিয়ে বছর;
এভাবেই তিনটি বছর কেটে গেল । এর মধ্যেই তাদের সংসারে একটি ফুটফুটে ছেলের আবির্ভাব ঘটল
। যার বর্তমান বয়স দুবছর ।
বসন্ত
কাল । কদিন থেকে পাশের পাড়ার মাঠে মেলা বসেছে । একদিন রাতে সুজন সেই মেলায় বেড়াতে যায়
। যদিও সবিতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে অনেক পিড়াপীড়ি করেছিল । কিন্তু শরীর খারপ করছে
জানিয়ে কোনভাবেই সুজনের সঙ্গে গেল না ।
তারপর
যখন সুজন মেলায় থেকে বাড়ি ফিরল তখন বাড়িতে ও বাড়ির বাইরের লোকের সমাগম ও ভিড় দেখে অজানা
সংশয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল । যখন সে ভিড় ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করল তখনই বিষয়টি দিনের আলোর
মতই পরিষ্কার হয়ে গেল । জানতে পারল, সবিতা পাড়ার একটি আইবুড়ো ছেলেকে নিয়ে ঘরের ভিতর
ফুর্তি মারছে । বিষয়টি কয়েক জনের নজরে আসায় তারা উভয়কে তালা বন্দী করে রেখেছে ।
সুজন
অবর্ণনীয় লজ্জা আর ঘৃণায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল । যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন জানতে পারল সবিতা
আর রতনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে । কিন্তু থানায় নিয়ে গিয়েও কারো কোন রকম বিচার হয়নি;
কারণ দেশের আইন বলছে, পরকীয়া প্রেম নিষ্পাপ সঙ্গম ছাড়া আর কিছুই নয় । ফলে দুদিন পরেই
সবিতা আর রতন পরস্পরের বাড়িতে ফিরে আসে । সুজন ওর বাড়িতে তুলতে না চাইলেও জেলের ঘানি
টানা জুজুর ভয়ে এসব মেনে নিতে বাধ্য হল ।
তারপর
কয়েকদিন যেতে না যেতেই রতন সবিতার কাছে প্রকাশ্যে চলে আসতে থাকে । সুজনের অবর্তমানে
সবিতার সঙ্গে এক ঘরে থাকে । এতে সুজন সব কিছু জেনেও কোন প্রতিবাদ করতে পারেনা । কেবল
তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে । বাড়তে থাকে ঘৃণা আর সামাজিক অপমানবোধ । এক অনিঃশেষ
অদৃশ্য ঘূর্ণি ঝড়ে মন, মানসিকতা, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে । ধীরেধীরে দেহে নানান আসুখ
বাসা বাঁধতে থাকে ।
তবুও
এভাবেই চলে যাচ্ছিল । কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই সুজন ভোর বেলায় উঠে দেখল, সবিতা
বিছানায় নেই । এমনকি তাদের কোলের ছেলেটিও নেই । চারিদিকে খুঁজাখুঁজি চলল । সারা পাড়ায়
খবরটি ছরিয়ে পড়ল, সবিতা রতনের সঙ্গে পালিয়ে গেছে । পরের দিন সকালে খবর এল একটি বাচ্চা
ছেলের ক্ষতবিক্ষত লাশ মাঠের মধ্যে পড়ে আছে ।
তারপর
নানান দুশ্চিন্তায় সুজনের নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত হতে লাগল । এমন দিশেহারা নিঃসঙ্গ জীবন
সময়ের অশরীরী হাতের ছোঁয়ায় প্রবাহিত হতে লাগল । সময়ের তালেতালে দিনের পর মাস, মাসের
পর বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল ।
এর মধ্যে
খবর এসেছিল, পুলিশ মুম্বাই থেকে রতন ও সবিতাকে গ্রেফতার করেছে । খুনের দায়ে উভয়ের জেল
হয়েছে ।
এসব ঘটনার প্রায় এক বছর পর সকলকে অবাক করে দিয়ে একদিন সাঁঝ রাতে সুজন হঠাৎ মামনির বাড়ি গিয়ে উঠল । বাড়ির উপস্থিত সকলেই এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ল । চাপা গুঞ্জন শুনে মামনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই সুজন ছুটে গিয়ে মামনির পায়ে পড়ল । বুকের সঙ্গে পা জড়িয়ে ধরে একটি শিশুর মতই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল । মামনির মুখ থেকেও কোন কথা বেরিয়ে এল না । তারও চোখ ফেটে গাল বেয়ে আশ্রু ঝরে পড়তে লাগল । বিদ্যুতের আলোয় মামনির গালের অশ্রুবিন্দুগুলি স্বর্ণের দানার মতই তখন জ্বলজ্বল করছিল ।