i ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-৫/আজিজুল হাকিম

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-৫/আজিজুল হাকিম

 

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা

অধ্যায় - ৫ 

জনসংখ্যা পরিবর্তন ও স্থানচ্যুতি


বিশ্ব ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতে জনসংখ্যার পরিবর্তন ও স্থানচ্যুতি একটি নীরব বিপর্যয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা কিংবা সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে নানা সময়ে বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়; যার পরিণতিতে তারা নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়া শুধু একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব ফেলে না বরং দীর্ঘমেয়াদে সমাজ ভারসাম্য ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার বড় হুমকি হয়ে উঠে। ইতিহাসের আলোকে এই ধরনের ঘটনাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

এই ঘটনাগুলোর প্রতিটিই প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং জাতিগত বিদ্বেষ যখন সীমা ছাড়ায়; তখন তার সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ সংখ্যালঘু মানুষ। এই ধরনের স্থানচ্যুতি ও নিপীড়নের ফলে দেশের ভৌগোলিক ও সামাজিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। একদিকে একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হ্রাস পায়, অন্যদিকে নতুন অঞ্চলে আগত শরণার্থীদের উপস্থিতি স্থানীয় জনসংখ্যার উপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে।

এছাড়া এই ধরনের জনসংখ্যা পরিবর্তন রাজনৈতিক শক্তি বিন্যাসেও পরিবর্তন আনে। সংখ্যালঘুদের এলাকা থেকে জোর করে সরিয়ে সংখ্যাগুরুদের বসতি স্থাপন করার ফলে তাদের অনুপস্থিতি কিংবা স্থানান্তর কোনও অঞ্চলের নির্বাচন, প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণে একচেটিয়া আধিপত্যের সুযোগ সৃষ্টি করে; যা দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমান বিশ্বে অভিবাসন, শরণার্থী সংকট এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাত একটি আলোচিত বিষয়। সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; বিশেষত সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীলতা, সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা হল রাষ্ট্রের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই বিষয়ে সচেতন করা ভীষণভাবে জরুরি। ইতিহাসের আলোকে এই ঘটনাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করলে আমরা বুঝতে পারি— ন্যায়, মানবতা ও সমতার ভিত্তিতে একটি টেকসই সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলা কতটা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব সর্বাগ্রে থাকা উচিত। তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করা কেবল তাদের জন্যই নয়, বরং একটি বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধশালী সমাজ গঠনের জন্যও অপরিহার্য।

এবার একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যাক। আর প্রথমেই যে দেশটির উপরে চোখ পড়ে তার নাম অখণ্ড ভারতবর্ষ। বিশেষ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তি চরিতার্থ এবং দূরদর্শিতার অভাবে কোটিকোটি মানুষের জীবনে নিয়ে আসে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। দীর্ঘকালীন সহবস্থান, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও গভীর শ্রদ্ধার বুকে ওরা ছুরিকাঘাত করে। মনের মধ্যে নিয়ে আসে চরম হিংসা, প্রতিহিংসা আর বিদ্বেষ। পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব সুলভ উদার ধর্মীয় মানবিকতায় পরিপূর্ণ দেশের বুকে অভিশাপের মতো নেমে আসে বিষাক্ত ধর্মীয় উন্মাদনা। চিরপরিচিত মুখগুলি রাতারাতি শত্রু হয়ে যায়। ওদের প্ররোচনায় ঘটে যায় দাঙ্গার মতো বীভৎস ঘটনা। তারপর দেশের বুকে ভাগ-বাটুয়ারার হাট বসে। পরস্পরের হৃদয়ে সীমান্তের দেয়াল মাথা চাড়া দেয়। নিজ দেশেই কখন ভিনদেশী হয়ে যায়। জায়গা বিশেষে তারা সংখ্যালঘু মানুষে পরিণত হয়। তারা স্থায়ী আশ্রয় খুঁজে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পাণ্ডাটা (যে পাণ্ডাটা ১৯০৫ সালে প্রথম দ্বিজাতি তত্তের জন্ম দিয়ে ছিল) যখন রাজনৈতিক দালালদের দিয়ে দেশের বুকে ছুরাকাঘাত করল; ঠিক তখন সেই আঘাত সমস্ত ভারতবাসীর বুকে গিয়ে লাগল। শুরু হল ধর্মীয় দাঙ্গা, সহিংসতা এবং নিরাপত্তাহীনতা। প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ স্থানচ্যুত হল আর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাল।

একইভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-সেনাবাহিনীর ‘সার্চলাইট অপারেশন’-এর দ্বারা চরম নির্যাতনের শিকার হলে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম আর ত্রিপুরায় এসে আশ্রয় নেয়।   

আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের দিকে চোখ ফেরায় তাহলে দেখতে পাব যে যুদ্ধ-পরবর্তী সীমান্ত পুনর্নির্ধারণ ও জাতিগত প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পোল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়ার মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ জার্মানিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটলে আর্মেনীয়দের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব ফ্রন্টে রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে আর্মেনীয় বিদ্রোহীরা রাশিয়াকে সাহায্য করে। এই অপরাধে প্রায় লক্ষাধিক আর্মেনীয়দের পূর্ব আনাতোলিয়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সিরিয়ার মরুভূমিতে নির্বাসিত করা হয়েছিল। জলবায়ুর পরিবর্তন আর খাদ্যের অভাবে প্রচুর আর্মেনীয় মৃত্যু বরণ করে।

দেশ ভাগ মানেই অসহায় নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু মিছিল, দেশ ভাগ মানেই সবুজ ঘাসের উপর রক্তের প্লাবন, দেশ ভাগ মানেই কিশোরী আর নারীদের ধর্ষণ যাতনায় ভারাক্রান্ত বাতাস, দেশ ভাগ মানেই  গৃহহারা নিরন্ন মানুষের উদ্বাস্তু শিবিরে শেষ আশ্রয়। এরকমই একটি চিত্র দেখতে পাই যুগোস্লাভিয়া ভাঙনের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ইতিহাসে এটিই সব চেয়ে বড় গণহত্যা। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল অত্যন্ত সহিংস ও দুঃখ জনক এক অধ্যায়। জাতিগত নিধনের ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় প্রায় ২৫ থেকে ২৭ লক্ষ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫ লক্ষ মুসলিম, প্রায় ৬ লক্ষ বসনিয়ান ক্রোট আর প্রায় ৫ লক্ষ সার্ব।

এটা আমরা প্রায় সকলেই অবগত যে ২০১৬ ও ১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এর নামে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অকথ্য দমন-পীড়ন চালায়। যার কারণে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা একে ‘জাতিগত নিধন’ বললেও তাদের স্থায়ী সমাধান আজও করে উঠতে পারেনি। ফিরিয়ে দিতে পারেনি তাদের পরিচয় – তাদের নাগরিকত্ব। বর্তমানে শিক্ষা, স্বাস্থ ও নিরাপত্তা তাদের কাছে একটি স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়।

(চলবে)

Post a Comment

Previous Post Next Post