i ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-৪/আজিজুল হাকিম

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-৪/আজিজুল হাকিম

 

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা

- আজিজুল হাকিম 

অধ্যায় - ৪ 


সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দমন


আমরা এর আগে জেনেছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্মূল করতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। সেগুলির মধ্যে সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দমন এক অমানবিক ও জঘন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি বা ভাষাকে দমন করার মাধ্যমে তাদের পরিচয়কে ধ্বংস করা হয়। ফলে তারা স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতামূলকভাবে দেশত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। এমনও দেখা গেছে যে সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের বিলোপ ঘটলে তারা সাধারণত তাদের নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে ধীরে ধীরে সংখ্যাগুরুর ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। উদারনীতির আলোকে দেখতে গেলে এই দমন শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের নয়, সমগ্র সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক সত্যতা এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কখনও কখনও ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের মতো এমন ঘটনা একটি পুনরাবৃত্তিমূলক এবং জটিল হিসেবে বিবেচিত করা হয়; যা বিভিন্ন সময়ে ও ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়ে আসছে। এমন দমন ও পীড়ন প্রায়শই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। এগুলির মধ্যে হল অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জোর করে ধর্মান্তরিত করা। কোন কোন দেশে আইন করে সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালন নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা হয়।  ধর্মীয় স্থান ধ্বংস বা অপবিত্রকরণ সাধারণ কৌশল। এই ধারার সব চেয়ে অমানবিক দিক হল সংখ্যালঘুদের দমন বা অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করা। এখান থেকে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দমন ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত করা হয়।

নিচে ইতিহাসের আলোকে এই বিষয়ের উপরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

 

১. প্রাচীন সভ্যতায় নিপীড়নঃ

প্রাচীন মিশরে ফারাও আখেনাতেনের একেশ্বরবাদী সংস্কারের সময়কার অনুসারীরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রায়শই নিপীড়নের শিকার হতো। কারণ তারা তৎকালীন প্রথাগত বহুদেববাদী বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।

প্রাচীন রোমে প্রাথমিক খ্রিস্টানরা এবং ইহুদিরা রোমান সাম্রাজ্যের প্যাগান ধর্মের লোকেদের দ্বারা নিপীড়িত হতো। নিরো বা ডায়োক্লেশিয়ানের শাসনামলে খ্রিস্টানদের উপর সহিংস নিপীড়নের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি রোমান সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না বলে তাদের বিদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হতো। সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। প্রাচীন রোমে ইহুদিরা বিশেষ কর প্রদান করতে বাধ্য ছিল।

প্রাচীন ভারতে পুষ্যমিত্র শুঙ্গর আমলে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। 

মধ্যযুগে নিপীড়নঃ

এই সময়ে ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, যেমন খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর দেশ ও জায়গা বিশেষে নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। ইউরোপে মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্ম প্রভাবশালী ছিল এবং ক্যাথলিক চার্চ ছিল সমাজের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন ইহুদি, মুসলিম, এবং বিভিন্ন খ্রিস্টান সম্প্রদায় (যেমন ক্যাথার বা ওয়াল্ডেনসিয়ান) প্রায়ই নিপীড়নের শিকার হতো। এমন কি যারা ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ভিন্নমত পোষণ করতো, তাদেরকে ‘হেরেটিক’ (ধর্মদ্রোহী) হিসেবে চিহ্নিত করে নির্যাতন করা হতো।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে ইহুদিরা প্রায়শই বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতো। তাদেরকে “খ্রিস্টের হত্যাকারী” হিসেবে দোষারোপ করা হতো। ১০৯৬ সালে প্রথম ক্রুসেডের সময় রাইনল্যান্ডে ইহুদিদের গণহত্যা (Rhineland Massacres) ঘটে।

দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় (১১শ থেকে ১৩শ শতাব্দী) মুসলিম এবং ইহুদি সম্প্রদায় জেরুজালেমে ও ইউরোপের কিছু অংশে নিপীড়নের শিকার হয়।

৭১১ সালে উমাইয়া খিলাফতের অধীনে মুসলিমরা ইরেবিয়ান উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেয় এবং আল-আন্দালুস নামে একটি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকেই খ্রিস্টানরা ইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানোর একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু করে। যার নাম হল রেকনকুইস্তার (Reconquista)। রেকনকুইস্তার (Reconquista) হল স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ ভাষা; যার অর্থ হল ‘পুনরুদ্ধার’ বা ‘পুনর্জন্ম’। এই প্রক্রিয়া চলেছিল ৭৮১ বছর ধরে – ৭১১ খ্রীঃ থেকে ১৪৯২ খ্রীঃ পর্যন্ত। এই অঞ্চল গুলিতে মুসলিমরা স্পেনের বেশিরভাগ অংশ শাসন করত এবং আল-আন্দালুস নামে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে সহাবস্থান করত। স্পেনের মুসলিম শাসনামলে কর্ডোবায় মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা একসঙ্গে বসবাস করত এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে অংশ নিত। কর্ডোবার উমাইয়া খিলাফতে সংখ্যালঘুরা তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত।

কিন্তু ১১শ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টানরা কাস্টাইল, আরাগন-এর মতো অনেক মুসলিম অঞ্চল পুনরুদ্ধার শুরু করে আর ১৪৯২ সালে গ্রানাডার চূড়ান্ত পতন ঘটে। কাস্টাইলের রানী ইসাবেলা এবং আরাগনের রাজা ফার্দিনান্দ গ্রানাডা - শেষ মুসলিম রাজ্য দখল করেন। এর মাধ্যমে ইউরোপ মহাদেশে মুসলিম শাসনের সমাপ্তি ঘটায়।

গ্রানাডা জয়ের পর মুসলিমদের উপর ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়ন তীব্র হয়।  ১৪৯২ সালে গ্রানাডার চুক্তি মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিলেও, এটি দ্রুত ভঙ্গ হয়। ১৫০২ সালে কাস্টাইলে মুসলিমদের জন্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ বা নির্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের বলা হতো ‘মোরিস্কো’।

ইনকুইজিশন (Inquisition), বিশেষত ১৩শ শতাব্দীতে স্পেনে, এই নিপীড়নের একটি প্রধান হাতিয়ার ছিল। হাজার হাজার মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয় বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। স্প্যানিশ ইনকুইজিশন (১৪৭৮-১৮৩৪) মুসলিমদের উপর কঠোর নজরদারি চালায়। তাদের ধর্মীয় আনুগত্য পরীক্ষা করা হতো এবং অনেককে গোপনে ইসলাম পালনের অভিযোগে নির্যাতন, কারাবাস বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। সেখানে মুসলিমদের আরবি ভাষা, পোশাক এবং ইসলামি রীতিনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এটি তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় ধ্বংসের একটি প্রচেষ্টা ছিল।

১৬০৯-১৬১৪ সাল অবধি মুসলিমদের ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য নির্বাসন ও নিধন চলে। ১৬০৯ সালে রাজা তৃতীয় ফিলিপ মুসলিমদের স্পেন থেকে বিতাড়নের নির্দেশ দেন। আনুমানিক ৩০০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ মুসলিমদেরকে উত্তর আফ্রিকা, ওটোমান সাম্রাজ্য এবং অন্যান্য অঞ্চলে নির্বাসিত করা হয়েছিল। নির্বাসনের সময় সমুদ্রপথে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী খিলাফতের অধীনে খ্রিস্টান, ইহুদি এবং জরথুষ্ট্রীয়দের ‘ধিম্মি’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তারা কিছু ক্ষেত্রে সুরক্ষা পেলেও, তাদের ওপর জিজিয়া কর আরোপ করা হতো। কিন্তু আব্বাসীয় যুগে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান সম্মানিত হতো।

মধ্যযুগে ভারতে হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ এবং পরবর্তীকালে মুসলিম শাসকদের অধীনে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী সহাবস্থান করত। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখতে পাওয়া যায় যে ভারতে মুসলিম শাসকরা হিন্দু ও জৈনদের ওপর ‘জিজিয়া কর’ আরোপ করেন। কিন্তু সম্রাট আকবর সেটিকে বাতিল করলেও পরবর্তীকালে সম্রাট ঔরোঙ্গজেব সেটিকে আবার পুনর্বহাল করেছিলেন। মুসলিম শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে কিছু মন্দিরকেও ধ্বংস করা হয়। ১২০৬ – ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৮০টি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল তার মধ্যে কেবল ঔরংজেবের আমলে ১২টি। সম্রাট আকবর সকল সম্প্রদায়কে এক ছত্রছায়ায় আনতে গিয়ে ‘দীন-ই-ইলাহী’র মতো সকলের জন্য একনীতি প্রচলন করেতে চেয়েছিলেন।

চীনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাবো যে ৮৪৫ সালে তাং রাজবংশের সময় বৌদ্ধ মঠগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা বৌদ্ধদের জন্য নিপীড়ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। 

আধুনিক যুগে নির্যাতনঃ

বিংশ শতাব্দী থেকে একাবিংশ শতাব্দীতে এসেও সারা ইউরোপ জুড়ে ইসলামোফোবিয়ার মতো আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে সেখানে মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে শুরু হয় এবং আমেরিকায় ৯/১১ হামলার পর এর ব্যপকতা আরও বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে মুসলিম নারীদের হিজাব নিষিদ্ধকরণ এবং মসজিদ নির্মাণে বাধা আসে। এমনকি মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরানের পাতা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা চোখে পড়ে। আর এসবই হল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এবার চোখ ফেরানো যাক চীনের দিকে। ২০১০-এর দশক থেকে সেই দেশের সরকার উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। জিনজিয়াং প্রদেশে ‘পুনঃশিক্ষা শিবির’-এ লক্ষাধিক উইঘুরকে আটক করা হয়েছে; যেখানে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছে ফেলা হচ্ছে। মসজিদ ধ্বংস, উইঘুর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে।

এবার মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির দিকে তাকানো যাক। ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট-এর দ্বারা পরিচালিত বাহিনী ইরাকে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের উপর হামলা ও গণহত্যা চালায়। ফলে প্রায় ৬০০০ মানুষ নিহত হয়। ২০০০ হাজারের উপর কিশোরী ও যুবতী নারীকে অপহরণ করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের উপরে অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং শেষপর্যন্ত যৌনদাসীতে পরিণত করে।

এছাড়াও আরবীও দেশগুলিতে শিয়া-শুন্নির দ্বন্দ্ব যুগযুগ ধরে চলে আসছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে শিয়া সম্প্রদায়ের উপরে সরকারী নির্যাতন এখনও চোখে পড়ার মতো।

পাকিস্তানে ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ জনের বেশি হাজারা উপজাতির শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষকে জঙ্গিরা হত্যা করেছে।

আফ্রিকা মহাদেশের কথা না বলাই ভাল। সেখানে তো সংখ্যালঘুদের রক্ত নিয়ে সঙ্খ্যাগুরুরা খুনের উৎসব করে।

১৮৮০ সাল ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষ ধরে কানাডার সরকার আদিবাসী শিশুদের জোরপূর্বক তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছে। ফলে সেখানে আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি নির্মূল হতে চলেছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসী গোষ্ঠী, বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দমনের শিকার হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দমন চালানো হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্টভাবে নির্যাতন চালানো হয়। যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরেও মাঝেমধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং ধর্মীয় স্থাপনার উপর হামলা লক্ষ্য করা গেছে।

এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক ভারতের মাটিতে। ব্রিটিশরাই প্রথম ‘Divide and Rule’ নীতি প্রয়োগ করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে এবং তা  তীব্রতর হয়। যদিও ব্রিটিশরা সরাসরি সংখ্যালঘু নিপীড়নে জড়িত ছিল না, তবে তাদের বিভাজনমূলক রাজনীতি ভবিষ্যতের দাঙ্গা ও ধর্মীয় উত্তেজনার ভিত্তি গড়ে তোলে।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ ও দলিত সম্প্রদায়ের উপর দমন-পীড়নের নজির দেখা গেছে।

১৯৯২ সালে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ১৬ শতকের বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর সারা দেশে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গাও ছড়িয়ে পড়ে।

২০০২ সালে গোধরা ট্রেন দুর্ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে মুসলিমদের উপর ব্যাপক গণহত্যা ও ধর্ষণ চালানো হয়। এই দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মুসলমান নিহত হন। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

বর্তমান ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নামে ‘হিন্দুত্ব’ যেভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী ও উগ্র হয়ে পড়ছে তাতে ভারতের সংবিধান হুমকির মধ্যে পড়তে চলেছে। এখন থেকেই সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর ভয়ঙ্করভাবে চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ‘লাভ জিহাদ’ ও গোরক্ষার নামে মুসলিম তরুণদের টার্গেট করে নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। পথেঘাটে মুসলিমদের ভয় দেখিয়ে জোর করে ‘জয় শ্রী রাম’ বলাচ্ছে। তাদের উপর চরম নির্যাতন হচ্ছে। এমনকি তাদেরকে হত্যাও করছে। এটি অহিংস ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বৈশিষ্ট নয়।  

‘Uniform Civil Code’-এর নামে মুসলিম পার্সোনাল ল’ বিলোপের চেষ্টা চলছে। উর্দু ভাষার অবমূল্যায়ন এবং মুসলিম ঐতিহ্যকে ‘বিদেশি’ রূপে চিহ্নিতকরণ। এগুলো মূলত সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে চাপের মুখে ফেলে দেয়।

২০১৯ সালে পাস হওয়া CAA ও নাগরিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া (NRC) অনেক মুসলিমের নাগরিকত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের এই আইন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী হিসেবে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে।

হিন্দুস্থান টাইমস-এর ১১ই মে ২০২৫ তারিখের পোস্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে, কেবল মাত্র উত্তর প্রদেশেই অবৈধ বা বেআইনি বলে ৩৫০-এরও বেশি স্থাপনা হয় বন্ধ না হয় ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার মধ্যে ২২৫টি মাদ্রাসা, ৩০টি মসজিদ, ২৫টি মাজার এবং ৬টি ঈদগাহ রয়েছে।

এবার আসা যাক দলিত সম্প্রদায়ের উপরে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নির্যাতনের দিকে। আজ এই উন্নত সভ্যতার চরম শিখরে এসেও আমরা দেখতে পাই উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা অস্পৃশ্যতার ফতুয়া জারি করে দলিতদের অপবিত্রতার প্রতীক হিসেবে দেখে।তাদের জন্য মন্দির নিষিদ্ধ করা হয়। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (NCRB) অনুযায়ী ২০২১ সালে ৫০৯০০টির বেশি অপরাধ রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ এবং শারীরিক নির্যাতনের মতো ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত David Alton-এর ২৭/০৯/২০২৪-এর রিপোর্ট অনুযায়ী দলিতদের বিরুদ্ধে প্রতি ১৮ মিনিটে একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয়। প্রত্যেক সপ্তাহে ১৩ জন করে দলিত নিহত হয়। প্রতিদিন ২৭জন করে দলিত নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতিবছর ৪৫,৯৩৫টি কেস রেকর্ড করা হয়। এই ধরণের ঘটনা সব চেয়ে বেশি দেখা যায় উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান-এর মতো রাজ্যগুলিতে বেশি পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়।

ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা কেবল মুসলিম আর দলিত সম্প্রদায়ের উপরে নির্যাতন করে ক্ষান্ত হচ্ছে না; তারা সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপরও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। Genocide Watch-এ ১০/০৯/২০২৩ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে ভারতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ৫২৫টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। মণিপুরে সহিংসতার কারণে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদনে ধ্বংস হওয়া উপাসনালয়ের সংখ্যা ৬৪২টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।     

এই সমস্ত ইতিহাস আর তথ্যের দিকে মনোনিবেশ করতে হলে অবাক হয়ে যেতে হয় - সমস্ত পৃথিবী যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম শিখরে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় আত্মমগ্ন হয়ে রয়েছে; তখন সার্বিক ভাবে দেখতে গেলে আমরা প্রাচীন ও মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার জন্যে ষাঁড়ের মতো উন্মত্ত কলহে জড়িয়ে পড়ছি। যখন পশ্চিমা দেশগুলি ধর্মগুলিকে পাশে রেখে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় মগ্ন তখন অশিক্ষার অন্ধকারে সমস্ত দেশটাকে ছুঁড়ে দিশাহীন বেকারত্ব আর দারিদ্রতার সম্প্রসারণ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বেড়েই চলেছে। এর কারণেই কি সরকারের ধর্ম ধর্ম খেলা খেলা?  

Post a Comment

Previous Post Next Post