মগরাদহের রূপকথা-আজিজুল হাকিম

মগরাদহের রূপকথা

আজিজুল হাকিম

 তোপিডাঙ্গা হাই মাদ্রাসা থেকে প্রায় পাঁচশ মিটার আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘুরে পশ্চিম দিকে গেলেই মগরাদহের পূর্ব ও উত্তর পূর্ব প্রান্তে পৌঁছানো যায়। আবার সুলতানপুরের খারেজিয়া মাদ্রাসার পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রায় তিনশ মিটার দক্ষিণ দিকে গেলে এই মগরাদহের উত্তর প্রান্তে পৌঁছানো যায়। এই মগরাদহ অতীতের উজ্জ্বল ও আত্মগৌরবান্বিত স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও  আত্মমগ্নতায় বিভোর হয়ে আছে।

  এই বিলটির বিস্তৃতি সুলতানপুরের পশ্চিম থেকে তোপিডাঙ্গার দক্ষিন-পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত চাঁদের মতো বাঁকা হয়ে চলে গেছে। দৈর্ঘ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা। এর প্রস্থ কোন কোন জায়গায় প্রায় ২০০ মিটারেরও বেশি। এই বিলে জলও প্রায় বারো মাস থাকে। কোন কোন বছর বেশী অনাবৃষ্টি হলে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে জল শুকিয়ে যায়। (অনেকের মতে সেটিও শুকাতো না, যদি এই লিভার পাম্পের মাধ্যমে জল তুলে মাঠ না চাষা আবাদ করা হতো।) তারপর বর্ষার বৃষ্টির প্লাবনতায় তার পূর্বের রূপ ও সৌন্দর্যে আবার ফিরে আসে। বুকের মাঝে মৃদুমন্দ ঢেউ তুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কবিতার ভাষায় বর্ষার এই প্রেক্ষাপট আমি এই ভাবেই চিত্রিত করেছি - 

বর্ষা এলে ভরে উঠে খালি বুক তার-
দূকুল ভেসে যায় এপার ওপার।
মাঠ ঘাট ভাসিয়ে নদী ছুঁতে চায়
এক কালে সখা ছিল যার সাথে, ভাই।
হৃদয়ের গভীরে টান লাগে বুঝি,
অতীতের সেই টানে পথ নেয় খুঁজি।
সময়ের স্রোতধারায় নদী ছোট হয়,
ছোট হতে হতে আজ বিল রয়ে যায়।
ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ যেন কাস্তের মত -
বাঁকা বিল বুকে নিয়ে হারানো স্মৃতি যত।


     
বর্তমানে এই বিলের দক্ষিণ পূর্ব দিকে কচুরিপানাতে ভর্তি হয়ে থাকে। কারণ তোপীডাঙ্গার পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার জন্য ছোটছোট কালভার্ট দেওয়ায় আর জাল বা বাঁশের বানা দিয়ে বিলের মাছকে বেরুতে না দেওয়ার জন্য জল নিষ্কাশন হলেও কচুরিপানা সে সব ভেদ করে যেতে পারে না।

এই বিলের জলে দুটি মাঠের চাষাবাদ নির্ভর করে। এর উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি লিভার পাম্প সত্তরের দশক থেকেই রাখা আছে। সেই লিভার পাম্প থেকে দুটি মাঠে সেচের ব্যবস্থা চলে আসছে।

বিশেষ করে এই বিলকে কেন্দ্র করে অনেকে বারোমাস মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এছাড়া তোপীডাঙ্গা ও সুলতানপুরের চাষিরা সারা মাঠের পাট এখানেই জাগ দেয়। ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির কাছে এই বিলের বিশেষ একটি গুরুত্ব আছে।  

এবার বিলের চারিপাশটা দেখে নেওয়া যাক। এই বিলের উত্তর দিকে মাঠ থাকলেও নতুন নতুন বাড়ি গড়ে উঠার কারনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছাড়া বিলের ধার বরাবর আর কোন ফাঁকা জায়গা নেই। পূর্ব দিকে তোপীডাঙ্গা গ্রাম। দক্ষিণ দিকে যেখানে বিল শেষ হয়েছে সেখান থেকে আবাদি নীচু জমি ও বিস্তৃত মাঠ অবস্থিত। পশ্চিম দিকে কিছু নতুন বাড়ি ছাড়া বিস্তৃত সবুজ মাঠ।  

কীভাবে এই বিলের উৎপত্তি ঘটল, অতি প্রাচীন কালের সেই ইতিহাস এই এলাকার কোন মানুষের তেমন কিছু জানা নেই। তবে এর উৎসমুখ খুঁজতে খুঁজতে আমি বসনপুরের ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত গিয়েছি। বসনপুরে ভাগীরথীর পূর্ব তীরে যেখানে শাহ্‌ জহিরুদ্দিনের মাজার শরীফ আছে, সেই মাজারের উত্তর প্রান্তে অর্থাৎ উনার মাথার ঠিক নীচ থেকেই এই বিলের উৎপত্তি ঘটেছে। সেই উৎসস্থল থেকে এই বিল বসনপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে গোবরার উত্তরের মাঠে পড়েছে। সেখান থেকে কালুখালিতে যেখানে ২০০০ সালের বিধ্বংসী ভয়ঙ্কর বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গেছিল সেই পথ দিয়ে সুবর্ণ মৃগীর রেল ব্রিজের তলা দিয়ে সুবর্ণ মৃগীর উত্তর কোল ঘেঁষে পূর্ব দিকে চলে গিয়েছে। সেখান থেকে পাইক পাড়া গ্রামের উত্তর প্রান্ত দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সুলতান পুরের পশ্চিম মাঠে গিয়ে এই মগরা দহের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। অবশ্য পদ্মার আর একটি শাখা নদী যাকে নহর বলা হয়; সেই নদী ডাঙ্গাপাড়া থেকে পূর্ব দক্ষিণ দিকে বেরিয়ে মাদাপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়ে এই বিলের পশ্চিম প্রান্তে মিশে গেছে। তারপর এই বিল নদীর আকার ধারণ করে সুলতানপুরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত থেকে তোপীডাঙ্গার দক্ষিণ পশ্চিম কোনে গিয়ে নীচু জমিতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। সেই নীচু জমি সোজা পূর্ব দিকে চলে গিয়ে বোয়ালিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে ভৈরব নদী থেকে আসা নীচু জমির একটি শাখার সঙ্গে মিশেছে। সেখান থেকে আবার পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে পলাশীর দক্ষিণ পূর্ব দিক হয়ে কুমির দহকে পূর্বে রেখে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। কুমির দহ ও গুধিয়ার মাঠে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে আঁকাবাঁকা সর্পিল গতিতে গুধিয়ার উত্তর কোল ঘেঁষে কুড়োল ডাঙ্গার দক্ষিণ কোল দিয়ে শিবনগরের উত্তর প্রান্তে ভাণ্ডার দহের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে গৌরিবাগের ব্রিজের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে গোবরা নালার সঙ্গে মিশে বালিঘাটের ব্রিজের দিকে চলে গেছে। এই গোবরা নালা আবার একই জায়গা থেকে উৎপত্তি হয়ে পলাশবাটি, আমডহরা আর কাটরা ঘাট হয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়ে তোপখানায় যেখানে জাহানকোষা কামান আছে তার উত্তর প্রান্তে পূর্ব দিকে ঘুরে গিয়ে একই জায়গায় অর্থাৎ গৌরিবাগ ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে মিলিত হয়েছে।

 এই মগরাদহের একেক জায়গায় একেকটি নাম হয়েছে। যেমন পলাশীতে গিয়ে ‘পলাশীর বিল’ নামে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার গুধিয়া, কুড়োলডাঙ্গা আর শিবনগরে গিয়ে ‘ডাঁড়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। পরবর্তী কালে পলাশবাটি ঘাটে ব্যাবসা বাণিজ্য স্থায়ী করার জন্য গোবরা নালা কেটে সংস্কার করলে এবং কালুখালিতে বাঁধপুল দেওয়া হলে এই বিলে জল আসার ব্যবস্থা প্রায় চিরতরের মতো বন্ধ হয়ে যায়। এখন কেবল বর্ষার সময় দুই দিকের মাঠের প্লাবিত জলে এই বিলটি পরিপুষ্ট হয়ে থাকে। তবে মাঝে মধ্যে ব্রিটিশ তৈরি নহর প্লাবিত হলে তার জল সুলতানপুরের মাঠ ভেসে এই বিলে এসে পড়ে।

এই বিলের চারিপাশ ঘুরে দেখা গেছে এই মগরা দহের দক্ষিণ পাড়ে প্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল। যার নাম কোলান। কোলানের জন্মের ইতিহাসও বহু প্রাচীন এবং এটি ছিল নদীকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলির একটি।  তখন এই বিল বিল ছিল না। ছিল একটি মস্ত বড়ো নদী। গাঙ্গুলিপাড়ার মধ্য দিয়ে যে রাস্তাটি মাঠের দিকে গিয়ে শেষ হয়েছে; সেখান থেকে এই বিলের উত্তর পাড়ে যেখানে লিভারপাম্প আছে সেই পর্যন্ত এই বিলের বিস্তৃতি ছিল। প্রস্থে প্রায় এক কিলোমিটার। এই গাঙ্গুলীপাড়ার রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে পূর্ব বা পশ্চিমে তাকালে সেই নদীর ক্ষয়িষ্ণু পাড় এখনও চোখে পড়ে। আর এই পাড়ের দিকে তাকালেই দেখা যায় প্রাচীন বসতির চিহ্ন। অনেক জায়গায় ঢিপি বা উচ্চভূমি। এই মাঠে প্রায় সব জমিতে পুড়া মাটির ভাঙা পাত্র যেখানে সেখানে পড়ে আছে। এমন কি মাটি খুঁড়লেও এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। আজ ইট ভাটায় মাটির প্রয়োজনে সে সব চিহ্ন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

এবার আসছি এই বিল কেন্দ্রিক ইতিহাসের কথায়। অনেকের মতে নবাবী আমলে এই বিলের এপারে আর ওপারে তোপ যুদ্ধের মহড়া চলত। সেখানে তোপ দাগা হত। সেই কারণেই এই বিলের পূর্ব পাড়ের গ্রামটিকে তোপিডাঙ্গা বলা হয়।

এছাড়া এই বিলের দক্ষিণ পশ্চিম পাড়ে মনসা তলা নামে একটি জায়গায় বৈশাখ মাসে মনসার পূজো হতো। যেখানে পূজো দেওয়া হতো সেখানে একটি বড়ো নৌকার এমাথা ওমাথা দূরত্বে দুটি বড় বড় গাছ ছিল। তাদের মধ্যে একটি পাকুড় গাছ আর আকটি নিম গাছ। সেই পাকুড় গাছের নীচে একটি গর্ত ছিল। সেখানে মনসা সাপ থাকত বলে কথিত আছে। যারা পূজো দিতে যেত তারা ফলমূলের সঙ্গে দুধও নিয়ে যেত। সেখানে বাটিতে করে দুধ রাখলে সেই সাপ গর্ত থেকে বের হয়ে দুধ খেয়ে যেতো। সেই পূজোকে কেন্দ্র করে বৈশাখ মাসের প্রতি সোমবার বিরাট মেলা বসতো। সেই মেলায় আশেপাশের গ্রামের লোক ছাড়াও দূরদূরান্তের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ থেকে লোক আসত ও মানত দিত। এমন কি এও জানা যায় যে, রায়বাহাদুরদের মতো অভিজাত শ্রেণীর লোকেরাও হাতিতে ও ঘোড়ায় চড়ে এই মেলায় আসতো ও পূজো দিত। তবে আজ এসব কর্মকাণ্ড কালের গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।

এবার আসছি এই বিলকে কেন্দ্র করে যে সকল লোককাহিনী চলে আসছে সেই সব বিষয়ের উপরে। যখন এটি একটি বিশাল বড় নদী ছিল তখন আশে পাশের গ্রামে যারা বাড়িতে বিভিন্ন উপলক্ষে অনুষ্ঠান করতো তখন এই বিলের ধারে গিয়ে থালা বাসন চায়তো। একটি মস্ত বড় ঢেউ নদীর মধ্যে থেকে উঠে এসে এই পাড়ে আঁছড়ে পড়তো। যখন ঢেউ আবার নদীর গর্ভে হারিয়ে যেতো তখন নদীর পাড়ে চকচকে সুন্দর থালা-বাসন সাজানো থাকতো। সে যত সংখ্যক থালা বাসন চায়তো ততো সংখ্যক পেয়ে যেতো। অনুষ্ঠান শেষ হলে সেই সব থালা বাসন আবার নদীর পাড়ে রেখে দিলে ঢেউয়ের মাধ্যমে সেই থালা বাসন আবার টেনে নিতো। অতীত কাল থেকে এরকমই একটি রীতি চলে আসছিল। একদিন একটি লোক গিয়ে নদীর কাছে থালা বাসন চায়ল। নদী দিয়েও দিল। কিন্তু সেই লোকটি নদীকে তার থালা ফিরিয়ে দিল না। তখন থেকে বিল মানুষকে থালা বাসন দেওয়া বন্ধ করে দিল।

তারপর মানুষ থালা বাসনের আশায় বিলের পাড়ে যায় আর হতাশ হয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে। অবশেষে আশে পাশের সমস্ত গ্রামের লোকজন বিলের ধারে গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করল। একসময় এই বিলের বুকে ফুটে উঠল সুন্দর সুন্দর লাল পদ্ম আর তার বুক ভরে উঠল পদ্মপাতায়। আশপাশের গ্রামের লোক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। কোন অনুষ্ঠান হলেই সেখান থেকে পদ্মপাতা নিয়ে আসা শুরু করল।

এরপর আসছি আরেকটি লোককাহিনীতে। আগেই উল্লেখ করেছি দুটি বড় নৌকার দুই মাথা দূরত্বে দুটি বেশ বড় গাছ ছিল। ধনসম্পদে পরিপূর্ণ নৌকা নিয়ে চাঁদ সৌদাগর এই নদীপথ দিয়ে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মনসার কুচক্রান্তে এখানে ভয়ংকর ঘূর্ণি ঝড় আর উথাল পাথাল ঢেউয়ের মাঝে পড়ে সেই নৌকা ডুবে যায়। এই নদী থেকে উজানি নগরের দূরত্ব মাত্র দশ কিলোমিটারে পথ। এই উজানি নগরটি ছিল সুবর্ণ মৃগী থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিম দিকে।

এর পর চাঁদ সৌদাগরের ছেলে বালা লক্ষ্মীন্দর যখন সাপের দংশনে মারা যায়; তখন এই নদী পথ দিয়েই বেহুলা সুন্দরীর ভেলা ভেসে ইন্দ্রপুরীতে পৌঁছে ছিল বলেও কথিত আছে।

এরকম আরো একটি প্রচলিত কাহিনী যা আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বসেছে, সেটি হল এই বিলের পশ্চিম দক্ষিণ পাড়ে যেখানে নদী বাঁক নিয়েছে সেখানে মিয়াঁ ঘাট নামে একটি জায়গা ছিল। সেখানে একটি মহিলা পিতলের শিবলিঙ্গকে প্রায় স্নান করাতে নিয়ে আসত। আর এই শিবলিঙ্গটি ছিল কোলান গ্রামের কাছারিপাড়ায়। যার ওজুনও ছিল যথেষ্ট পরিমানে। কেবল মাত্র একটি মহিলা ছাড়া নাকি কেউ শিবলিঙ্গটি কাঁখে নিতে পারত না। সেই মহিলাটি কাঁখে করে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এই মিয়াঁ ঘাটে নিয়ে যেতো। রাস্তার মাঝে কোথাও সেই মূর্তি নামানো হতো না।

এছাড়াও ভূতের কাহিনী, ডাইনি কালির কাহিনী বহুল প্রচলিত আছে। এই বিলে কেউ ডুবে মারা গেলে লোকেরা বলতো, কালিতে জলের তলায় নামিয়ে মেরে ফেলেছে। একসময় কেউ একা এর পাড় দিয়ে হেঁটে গেলে কোন এক অদৃশ্য হাত তার পা ধরে জলের তলায় নাকি নামিয়ে নিতো। এরকম অনেক কাহিনী এখনও মানুষের মুখে ঘুরে বেড়ায়।

এই বিলের নাম মগরা কেন হল, এই নিয়ে অনেকেই একমত যে ওখানে কোন একটি জায়গায় মরঘাটি বা শ্মশান ছিল। আশির দশকে এই বিল সংস্কারের সময় আমিও মানুষের অনেক মাথার খুলি এই বিলের তলায় গড়াগড়ি খেতে দেখেছি। সেই কারণেই এই বিলেকে অনেকে মগরাদহ বলে মনে করে। কিন্তু যেখানে মরা পুড়ানো হয় সেই জায়গাকে মগরা বলে না। আসলে কোন নদীর বিস্তৃত ও গভীর জলাভূমিকে মগরা বলা হয়। যেমন মুকুন্দরাম তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বলেছেন, “চারিদিকে জল / ধাইল ধবল / মগরা জুড়িয়া ফেনা।”

সুভাষ ভৌমিকের মতে ‘মকর’ শব্দ থেকে প্রাকৃত ভাষায় ‘মগর’ শব্দটি এসেছে এবং এই মগর থেকেই মগরা হয়েছে। যেমন তেল থেকে তেলা বলা হয়। জল থেকে জলা বলা হয় এমনই শব্দ ‘মগর’ থেকে ‘মগরা’। মগরা বলতে সঠিক যে অর্থ দাঁড়ায় সেটি হল ‘জলচর’ বিশেষ প্রাণী ও উদ্ভিদ। যেমন - মাছ, কুমির, হাঙ্গর এই সব প্রাণী বা জলজ উদ্ভিদ।

আসলে ওখানে একটি গভীর দহ ছিল। যার জল ছিল মিশ কালো। কোনদিন সেই দহের জল শুকাত না। কেবল এই দহের দুই প্রান্তে দুটি লিভার পাম্প বসিয়ে দুটি মাঠকে জল সরবরাহ করতে আশির দশক থেকে কোন কোন বছর জল শুকিয়ে যায়।

বর্তমানে সরকারের উদাসীনতায় এই বিলের সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে বসেছে। দুপাড়ের মাঠ বিধৌত পলি জমে হারিয়ে যেতে বসেছে এর গভীরতা। এই বিলের সৌন্দর্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনতে গেলে কয়েক বছর পরপর এর সংস্কার করা উচিত। তার সঙ্গে এর দুপাড়ের পাড় মুক্ত রাখা উচিত বলে আমার মনে হয়।   

       এবার শেষ করছি এই বিলকে নিয়ে আমার কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ দিয়ে -
তবু বিল হেসে উঠে বাতাসের সাথে
ছোট ছোট ঢেউ তুলে আনন্দে নাচে।
চাঁদের মত বাঁকা বিল চাঁদবদন তার-
কখনও বা হেসে উঠে কখনও মুখভার।


Post a Comment

Previous Post Next Post