i ভিন আকাশের তারা নববর্ষ সঙ্খ্যা-১৪৩২

ভিন আকাশের তারা নববর্ষ সঙ্খ্যা-১৪৩২

 


সম্পাদকীয়

    নববর্ষ মানেই আগামীতে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সেখানে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সাংসারিক ও সামাজিক মেল বন্ধন এবং সম্প্রীতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উদার আকাশ আর মুক্ত বাতাসকে আলিঙ্গন করা। কিন্তু প্রতিবেশী থেকে শুরু করে দেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই গুটি কয়েক লোক নিজেদের স্বার্থে সরকার নামক যন্ত্রটাকে হাতিয়ার করে সারা দেশকে অস্থির, অরাজকতা আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির আঁতুড় ঘরে পরিণত করতে চায়ছে। প্রতিদিন সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অবিশ্বাসের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে আগুন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। লুঠ হচ্ছে স্বাধীনতা, ঘর-বাড়ি, ইজ্জৎ। জন্ম নিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যা শুভবোধ সম্পন্ন মানুষেরা কখনোই চায় না। আগামীতে মানুষের পরিচয় কেবল মানুষ হোক এই বার্তা নিয়েই আমাদের নববর্ষ সংখ্যা।

আজিজুল হাকিম           

 

কবিতাগুচ্ছ

তৈমুর খান-এর চারটি কবিতা

 

অব্যবস্থা

  

 ফেলে চলে গেছো
 কত বর্ষাকাল একা একা মাঠে
 বিদ্যুতের হুংকার
 অথবা কালবৈশাখীর ধ্বংসনৃত্য
 দেখতে দেখতে পুড়ছে সময়
 
 ফসলহীন শুধু কর্তব্যের চাষে
 বিধুর কৃষক আমি
 নিয়ত আকালে বেঁচে আছি—
 বেঁচে থাকার অভিধানে আর কী কী থাকে?
 যন্ত্রণার বাগান, বাগানে আগুনফুল
 ফুলে ফুলে অলীক ভ্রমর—
ঘামগন্ধ নুন আর ছেঁড়া জীবনের বৃন্ত
 নীল, নীলমাধুর্যের কিশলয়....
 
 কবে ফেলে গেছো আশ্বিন
 একটিও অবশিষ্ট শিউলি নেই
 শুধু মুখপোড়া দিন
 
আর প্রার্থনার মূর্খ দেবালয়

 

ভালোবাসার মৃত্যু

 

একদিন ভালোবাসার নিকটে গিয়েছিলাম আমি 
ভালোবাসা আমাকে চুম্বন করেছিল 
আমি তার হাত ধরেছিলাম 
ভালোবাসা হাতে হাত রেখেছিল।
 
আমি হাত সরিয়ে নিইনি কোনওদিন 
সমস্ত আকাশে তখন মেঘ সরে গিয়েছিল শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছিল 
একটি কাল্পনিক হ্রদের ধারে 
আমরা একসঙ্গে হেসে উঠেছিলাম।
 
সেদিন ভালোবাসার বুকের তিলটি চাঁদ হয়ে গিয়েছিল 
আমরা আলোকিত ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলাম।
 
তারপর বহুদিন পর, আমাদের গল্পের ভেতর বহু নীরব শূন্যতা বয়ে গেল 
আমরা কান্নার সমুদ্রের তীরে নোনা বাতাসে ডানা ভেজালাম।
 
আমাদের কোনও মেঘদূত ছিল না 
আমাদের স্বপ্নরা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো
 কোথায় উড়ে গেল
                  বুঝতে পারলাম না…
 

বিশ্বাসের পথ দিয়ে অবিশ্বাস যায় 

 

বিশ্বাসের পথ দিয়ে অবিশ্বাস যায় 
বিশ্বাসের মতো ওর চুল ওড়ে 
রঙিন ঠোঁটের মধু ঝরে 
চিবুকের একটি তিল চিহ্ন হয়ে ঘোরে 
 
দাঁড়িয়ে থাকি । 
বহু বৎসর পর আবার আবেগ তালি দিলে 
নতুন পোশাকে আয়নার সামনে দাঁড়াই 
আবার জ্যোৎস্নার হাসি ফুটে ওঠে 
 
দেখতে দেখতে একটা মিথ্যার দেশে 
আমাদের যুগ 
আমাদের ঘর সংসার 
মহাকল্লোল 
ধুলোময় যুদ্ধের ভেতর বাক্যবাণ ওড়ে 
মর্মের বিষাদে ছবি আঁকা দিন কাটে
 

প্লাবক 

 

কারও পায়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ ঢুকে যাচ্ছে 
কারও পায়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ বেরিয়ে আসছে 
এত তাড়াতাড়ি আলো নিভে যাচ্ছে 
আমরা অন্ধকারে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না 
চেঁচিয়ে বলছি, হাত বাড়াও, হাত বাড়াও 
 
শৌর্য বীর্য ক্ষয় হয়ে গেলে যা হয় 
 
আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে কমিয়ে 
ভরসা রেখে অথবা না রেখে 
আমরা পোকা মাকড় হয়ে উঠছি 
হাসপাতাল যাবার কথা ভাবতে ভাবতে 
আমরা অন্ধকারে চলে যাচ্ছি 
 
চাঁদ পালাচ্ছে, চাঁদ পালাচ্ছে 
হিহি হিহি হিহি.......
*******
 

নাফিসা খান-এর দুটি কবিতা

হরতাল

 

উচ্চারিত হোক শব্দে অথবা বাদ্যে এ দহন , 
কেন শুধু চেয়ে থাকা  আসন পেতে ?
 
আমি মেঘ দিলাম , তুমি  আহুতি 
 
উত্তাল এই পর্জন্যে বিস্ময়  আমাদের ভোগবিলাস,
 
যা কিছু প্রাকৃতিক  অবসর  নিতে ইচ্ছুক 
আর কোন অঙ্গচ্ছেদ নয় ,নয় কোন ঘাত
 
হরতাল শেষে দেখা হোক  ,
কথা দাও
আমি দগ্ধে বৈশাখ  ,তুমি কী ভীষণ নিম্নচাপ !
 

নিখোঁজ 

 
দেখা নেই তার
যার কারণে শুচিম্মিত অন্তর ,
মুকুর চয়নে পোড়ে জলছবি   
পড়শি কিশোরী কোন বার্তা  রাখেনি 
 
তবু, আশা আছে 
ভার নিতে খোলা জালনায় 
গরহাজির শালিকের জুটি !
*******

(কবিতা)

তোমাকে ভালোবাসলেই কল্লোলিত শহর

তামান্না সুলতানা তুলি

(বাংলাদেশ)

 

তোমাকে ভালোবাসলেই কল্লোলিত শহর
বিকালের নিনাদ ভুলে মেতে ওঠে কবিতা
তোমাকে ভালোবাসলেই সৌম্য সন্ধ্যায় প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে জ্বলে ওঠে জোনাকি
চৌরঙ্গী মোড়ে বসে গানের উৎসব,
পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নেমে আসে ইউফ্রেটিস টাইগ্রিসের সুললিত ধারা
 
মেঘমনে আকাশ ভাসে
টোকা দিলেই গুচ্ছ গুচ্ছ নীলে ফুটে যায় অপরাজিতা
আমার শাড়ি উড়ে  যায়...
উড়ে যায় বকের দুধ সাদা নিরুদ্দেশের আকাশ
বৃষ্টি আসে দোতলার পশ্চিমের জানালায় 
ভূমধ্যসাগর উথলে ওঠে, ড্রেসিংটেবিলে লুটোপুটি স্রোত 
পর্দায়, গালিচায়‌ সুমিষ্ট অত্যাচার
সম্মোহিত শরীর চায় নোনা স্নানের আরাম 
 
তোমাকে ভালোবাসলেই
ঘোষ বাড়ি থেকে  ছুটে আসে‌ ননীর ঘ্রাণ,
ঘ্রাণের ভেতর থেকে স্মৃতিগন্ধা অতীতে খুলে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার মিউজিয়াম,
ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানে ঝুলে থাকে চাঁদ
জয়ন্তর মুখে স্পষ্ট দেখতে পাই;
মরুর দিক থেকে ফিরছে আমার প্রাশ্চাত্যের বিমান
 
তোমাকে ভালোবাসলেই পথের ধারে গান গেয়ে 
ওঠে বোবা ছেলে বিষ্ণুপদ 
ফ্রক পরা  নবম বর্ষের বালিকার পায়ে পায়ে ফেরে স্বস্তি  
কুমারী মাটির চাক পেলবতায় হাসে পাললিক হাসি
তোমাকে ভালোবাসলেই আমার এলামেন্ডার হলুদ আগুনে নামে শান্তি
 
স্কুলঘরে ছুটির ঘণ্টা বাজে
শেষ বিকালের নিরবতা ভেঙ্গে ইতা হাঁসদার কণ্ঠে আবার ফেরে কিশোরী হাসি;
ডোমপাড়ায় হাঁটে আমার নগ্ন পা,  দীর্ঘ উপবাসের পর পরিতৃপ্ত হয় তৃষ্ণা 
 
তোমাকে ভালোবাসলে মুদ্রায় ভরে ওঠে ভিক্ষুকের থালা,
ভাতের গ্রাসে মেলে এক টুকরা মাংস।
সড়ক বিভাজক উঠে যায়,
কংক্রিটের সভ্যতা খসে পড়ে, আমার নির্জনে থিতু হয় উদ্বাস্তু পৃথিবী 
 
তোমাকে ভালোবাসলেই উন্মুক্ত হয় দ্রাঘিমা 
দিগন্তের অধিকার হাতে যেখানে ইচ্ছা ছুটে যাওয়া যায়
যুদ্ধশান্তি, সফল হয় জাতিসংঘের আলোচনা
মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন বিরোধীতার সাফল্য আসে
ক্ষয়িষ্ণু বোধের ভেতর দাঁড়িয়ে যায় সুস্থির অর্থনীতি
নিরঙ্কুশ রাজনীতির প্রার্থিত গণতন্ত্রে ফেরে সমতা 
 
তোমাকে ভালোবাসলেই আমার জরায়ুতে 
জন্মায় অবিনাশী সবুজ
আমার শব্দিত পৃথিবীর সৌম্য শব্দরা
খইয়ের মতো ফুটে ওঠে সুনীল আকাশে –
~~~~~~~~~
 

জীবন মৃত্যুর আলেখ্য
-
আজিজুল হাকিম

 

কোথায় যাব, বল?
কেউ কি আছে? তুই ছাড়া কোন আশ্রয়?

তুই ডাকলেই আমি তোর কাছে যেতে পারি,
তোকে দিতে পারি সারা জীবনের ক্লান্তির হিসেব।
বল, কখন তুই ডেকে নিবি এক দুর্বোধ্য ভালবাসায়?

কখনো কখনো তোর চোখের সবুজ রশ্মি আমাকে স্ক্যান করে
আর কোন এক মোহ ঘোরে তোর চোখের শ্বেত গহ্বরে হারিয়ে যাই আমি
ওই নৃত্যরত আঁখি-পল্লবে যখন মধ্যাকর্ষণের ইঙ্গিত
তখন এক টুকরো পেঁজা তুলোর মতোই
এক বৃক্ষ প্রত্যাশা নিয়ে হারিয়ে যাই ওই শ্বেত গহ্বরের ভিতর। 
আত্মসমর্পণ এত ভাল লাগার হয়!
এত সুখ, এত শান্তিময়!

তারপর আমার সামনে অচেনা বেআব্রু পৃথিবী
তখন আমি যাযাবর পথিক
সহস্র বছর কেটে গেলে আদিম গহীন অরণ্য ভেদ করে
উন্মুক্ত পৃথিবীর বুকে গিয়ে দাঁড়াই
চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
তখন তোর চোখের কোণে বিগার জলপ্রপাতের কান্না
সেই ঝর্ণায় আমি ভিজতে থাকি
তারপর জীবনের গান গাইতে গাইতে
তোর পাহাড়ি পাড়া ঘেঁষে কখন ভেসে যাই নদীপথ ধরে
উত্তাল সাগর সঙ্গমে।

তোর চোখের ইশারায় আমি বন্দর খুঁজে পাই
যেখানে স্ফটিক আলোয় ঝলসে ওঠে সাদ্দাদের বেহেশত
সেখানে সামনাসামনি বসি তুই আর আমি
চারপাশে জীবনের বেলাভূমি
হেসে উঠে বিচিত্র আলপনায়
আবার সেসব ধুয়েও যায় ঢেউয়ের পাখনায়;
এই আলপনা আঁকা আর এই ধুয়ে যাওয়াই তো জল আর আগুনের অনন্ত খেলা।
তোর মুখে খিলখিল হাসির ঝংকার
আর আমার হৃদয়ে রোমাঞ্চকর বাসর উদ্যান
তারপর এক মল্লভূমিতে তোর আমার তুলকালাম কাণ্ড
অনেক যাত্রার পর মল্লভূমি পেরিয়ে গেলে
হেসে হেসে মাথা দোলায় অজস্র ফুল।

কখন যেন খসে পড়ে তোর অবাধ্য চুল
উড়তে থাকে আপন খেয়ালে
আমি রহস্য-ঘন গভীর বনানীতে হারিয়ে যাই
সেখানে ঘন কালো অন্ধকারে
শ্যাওলার মখমলে শান্তির ঘুম আসে নেমে
আমার দুচোখের পাতায়।
কখন যেন হারিয়ে যাই জোনাকিদের পাড়ায় --
চারপাশে আনন্দমুখর উৎসব
মিটিমিটি নেচে যায় জোনাকির ঝাঁক
তোর পায়ে বেজে চলে অনন্তকাল ধরে বেহিসেবি ঘুঙুর।
চারপাশে নানান ছন্দে বাজে ঝিঁঝিঁদের কোরাস
হয়তো তাই, এই পৃথিবী, এই বিশ্ব জগৎ
কেবল সুর আর ছন্দেই চলছে!

আমি জানি, আজ না হোক কাল,
তোর হীরক উজ্জ্বল চোখের হাসিতে আমাকে ডাকবি-ই।
বল, ডাকবি না?

 

রচনা: ৩০ ও ৩১/০৩/২০২৫

~~~~~~~


 প্রিয় তোমার জন্য 

মীর সাহেব হক

 
প্রিয়,
আত্মার আবাসন বানাতে পারিনি বলে 
সভ্যতার বহু প্রাচীন ধ্বংস স্তুপের মুখে দাঁড়িয়ে
 রোজ রাতে ফুঁপিয়ে উঠি 
_এই দেখো,মুখ অবয়বে লেগে আছে
 থকথকে কান্নার দাগ।
 
আমি কান পেতে আছি জীবনের দিকে
 জানি এর পরিমাপ নেই
তবুও অন্ধকারের উৎস মুখে 
আলোকিত কন্ঠের সন্ধানে 
এই হৃদয়ে ভেসে ওঠে 
অচেনা, এ কার ছবি?
 
সেই দিন তুমি বলেছিলে
 সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে 
কারো মুখের হাসি ধরতে যেও না 
এ হাসির দৈর্ঘ্য প্রস্থ পাবে না।
 
 হৃদয়বাসি হতে পারিনি বলে একাকীত্বে
 দিনরাত্রি ভারি এবং গভীর করে তুলেছি
 আমার দিনগুলি এখন রাত্রির মধ্যে পুড়ে যায়
 অধরা স্বপ্নে পাল তুলে দেবার মত তুমি ছাড়া 
আর কিছুই নেই।  
 
জীবন নদীর সীমারেখায়
অসংখ্য  স্বপ্নের বাঁক 
তবুও আকাঙ্ক্ষা জেগে আছে 
কেবলই এই ঠোঁটে ।
 
বাম আর দক্ষিণের জানালায় ঢেকে গেছে
 আমার স্বপ্নপুরের নদী ।
এখন তুমিই বলো
কোন অবগুণ্ঠনের তরঙ্গে আমি শুদ্ধাত্মা হবো
 আর বিচ্ছেদের মাঝে খুঁজে পাবো সম্পর্কের গভীরতা? 
 
ঋতুহীন এই পৃথিবীর পবিত্র আগুনে
 নিজেকে পোড়াতে পারিনি বলে 
স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি এখনও আঁকা হয়নি।
 
তবুও হৃদয়ের বিদ্রুপ শুনে 
হৃদয়কে পরিমাপ করতে পারেনি
 তাই কি আত্মার  আকুতি ঘুরে বেড়ায় বেলাতটে? 
 
তুমিও জানো
আত্মার যাত্রাপথ প্রজ্ঞা ভবনে 
কেবলই মুখোশের ছড়াছড়ি 
সবাই সবাইকে জ্ঞান দেয়, উপলব্ধি ছাড়া ।
 
বলো,চেতনার গভীরতা ছাড়া
 সম্পর্ক মাপার 
আর কোন মাপকাঠি তোমার জানা আছে ?
 
আমার কান্না শব্দের খাঁচায় বন্দী করি।
 নোনা জলে ভিজে 
ও তোমার কাছে উড়ে যেতে চাই।
 
কার কন্ঠে গান গাইতে  গিয়ে
 কখন যেন হারিয়ে ফেলেছি নিজের কন্ঠ।
 পরিমাপহীন সময়ের সুখ খুঁজতে গিয়ে
সোনার খাঁচায় বন্দি পাখির মতো উড়াল দিয়েছি।
 
আবাও তোমারই টানে
অনন্তের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে আছি ।
কাছে এসো প্রিয়
এই দ্যাখো,
বাইরের আবরণ খুলে ফেলেছি।
 এখন আত্মার সঙ্গে আত্মা সাজিয়ে 
একটা সুন্দর ভালোবাসার ঘর বানাব
সেখানে তুমিও থাকবে ,আমিও
গান থাকবে
 থাকবে আকাশ ।
সমুদ্র দু'জনকে কাছাকাছি ডেকে বলবে 
আর সম্পর্কের গভীরতা মাপতে যেও না
তা যদি মাপতে চাও
প্রেমহীন পৃথিবীতে
ফুল ফুটবে না
খাদ্যের অভাবে
প্রাণের বিলোপ হবে।

~~~~~~~~~


বিবাগী অস্তিত্বের সন্ধান

মঞ্জীরবাগ

 
ঠিকানা চেয়েছি নিজেকে গচ্ছিত রেখে!
 
মধ্যস্থতা বিষয়ের সমস্ত গল্পের দিশাহীন নাবিকের চেনা বন্দরের আশ্চর্য রূপকথা দ্বীপ
পরিচিত পাঠে হারিয়ে যায় দুপুরে পাঠশালা।
শীতের সম্পর্ক উষ্ণতা খুঁজে লেপের ভেতরে
ঋণী থেকে যায় পরিচিত নির্বাক সম্পর্কের কাছে‌
 
স্বর্গমুখের ঠিক এক ইঞ্চি দূরে অনুভব হয়
এখানে ভালোবাসা নেই, কর্তব্যের কামড়
সুর যদি নদী হয়,তবে ভেসে যাই ভালো
 
ক্রিয়া বিক্রিয়ার অনুশাসনের নিহত বসন্তের দিন,
একটি কোকিলের মৃত্যু ,বসন্তের গান থামাতে পারেনা…
অবহেলাও আমাকে প্রতিদিন ঋদ্ধ করে
বিপন্নতার চিঠিরা আমার উঠোনেই পড়ে থাকে শুকনো পাতার মতো।।
~~~~~~~

মাসের বড়াই

রুপালী রায়

 

বৈশাখ বলল ইস্
আমি ছিলাম ভাগ্যিস 
       তাই নতুন বছর আসে ।
 
জষ্ঠী বলল থাম্
লোকে কেমনে খেত আম
        যদি আমি না থাকতাম পাশে ।।
 
আষাঢ় বলল থাক্ 
তোদের বর্ষপূর্তি রাখ্
         আমিই বাঁচাই গরমের শেষে ।
 
শ্রাবণ বলল ইশশ্
লোকে কোথায় পেত ইলিশ 
        নদীর পাশে না দাঁড়ালে এসে ।।
 
ভাদ্র বলল ইসে
আমি কম যাই বা কিসে
        আমার সাথেই শুরু শরতের যাত্রা ।
 
আশ্বিন বলে থাম্
তোর গরমে ঝরে ঘাম
       আমিই আনি আগমনীর বার্তা ।।
 
কার্তিক বলে বেটা 
তোদের ঝগড়া এবার মেটা 
       চেয়ে দেখ গাঁয়ে নবান্নের সুর ।
 
অঘ্রাণ বলে ঠিক 
বলেছিস সঠিক 
       আনন্দের মাঝে ঝগড়া থাকুক দুর ।।
 
পৌষ বলল বেশ 
হোক ঝগড়া ঝাটির শেষ 
       আমি বইয়ে দিলাম শীতল হাওয়ার রেশ ।
 
মাঘ বলল ওরে 
তুই টেক্কা দিবি মোরে
       আমি না থাকলে লেপের মজা শেষ ।।
 
ফাগুন বলল দেখ্
আমি এনেছি রঙের ব্যাগ 
       রঙিন ফুলে বৃক্ষ উঠবে দুলে ।
 
চৈত্র বলল আন্
হোক বছরের অবসান 
      নতুনের ভার বৈশাখে দিই তুলে l
~~~~~~~

আব্দুর রহমান - এর দুটি কবিতা

       (এক)
স্টেশন থাকতে নেই 

আমরা কোন স্টেশনে যাব 
শাশ্বত ছায়া বলে হাত বাড়ালেই পায়ের ছায়া পড়ে না 
শব দেহ শবের সঙ্গে কোলাকুলি করে 
কথা বলে আয়নায়
 
ভাঙা কাচ ব্যাঙের ছাতায় আকাশ 
নিলামে বিক্রি জীবন যাপন 
ভাতের থালায় সাজানো নাটক 
কুশীলব রান্না করে মৃত্যু বাণ

বাণিজ্যিক শব হৃদয় পশরা 

আমাদের কোনো স্টেশন থাকতে নেই
           ***
         (দুই)
এই অধিকার চায় লাশ
        
       এখন যেদিকে খুশি তাক্আও
       লাশেরা লাশের সঙ্গে কথা বলছে 

       কোথাও ধড় কোথাও মুন্ডু শরীরের অসংখ্য             

       অংশ 
        হাতে হাত মুখে মুখ রেখে কথা বলছে।   
       লাশেরা লাশের সঙ্গে কথা বলে 
       মিছিল করতে চায় — স্বর্গ নয় নরক নয়
       মৃত্যু শূন্য লাশ আমরা 
       লাশ হয়ে যাওয়া গন্তব্য 

        লাশ দ্রুত মিশে যাক মায়ের কোলে 

        মিছিলে এই অধিকার চায় লাশ।
                       ***

দাবদাহ 

লালন চাঁদ

 

দাবদাহ 
শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী 
আগুন কাঠ। মাটি ফেটে চৌচির 
 
গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে 
পাতা নেই ফুল নেই ফল নেই 
বাকল থেকে খসে পড়ছে এক একটি রোদেলা দিন 
 
আমারও পৌরুষ শুকোয় 
ঝরে পড়ে হাহাকার 
নিঃস্ব বিকেল মিলিয়ে যায় বিষাদের আলপনায় 
 
তোমার অপেক্ষায় আজও বসে থাকি 
জলে ভাসে পিপাসার নদী 
দুহাতে কুড়োই শুকনো পৌরুষ। কুড়োই অনন্ত ছাই 
 
নিঃস্ব আঁধারে তুমি মুখ ঢেকে হাসো 
দাবদাহে পোড়ে আমার পৌরুষ 
আমিও পুড়ে পুড়ে হই ছাই 
~~~~~~~


সহসা ঈদের নামে!

(ইমদাদীয় চতুর্দশপদী)

ইমদাদুল ইসলাম 

 

ক্ষুধার্ত জনে কিঞ্চিৎ আনাজের দান
আর সস্তা বসনের থলি হস্তান্তর,
সাথে কত ছবি ছাপ্পা ভাবে রূপান্তর,
দেখে বুঝি এল ঈদ দুষ্টে এল শান। 
সমগ্র বৎসর প্রাপ্য চুষে দরিদ্রর
বিবেক এলে হঠাৎ, তাও কেন সস্তা
খুঁজো ওহে ধর্মপ্রাণ, রাখো কোথা সত্তা?
এই বুঝি জাতি গড়া  নিবৃত্তি ক্লিষ্টর!
 
সহসা ঈদের নামে ধর্মেতে মত্ততা,
পারে কি কখনো নিতে দায়িত্ব দীনের?
সদা হৃদে হানো যারে চোট বল্লমের,
দেখেও দেখো না যেন করুণ অবস্থা।
হঠাৎ কিঞ্চিৎ দানে নেই কোনো যশ,
কেন ভরো না সমাজ দিয়ে নীতি রস?
*******

 

মধ্যরাত্রির হাতছানি
গোবিন্দ মোদক

 

ভাবনার গলিপথ আঁকা মন জুড়ে 
অচেনা রাখাল-বাঁশি বাজে নানা সুরে। 
মধ্য রাতের চাঁদ আকাশের নীড়ে 
হেসে হেসে পথ হাঁটে তারাদের ভিড়ে। 
তবুও যে মন ভাবে – এই মধ্য রাতে 
রাখালের ভাবনারা বয় কোন খাতে! 
উড়ন্ত বাদুড়েরা মেলে কালো ডানা 
গিয়ে ফল বাগানেতে করে খুব হানা। 
চাঁদের আলোয় তারা নিঃসংশয় 
রাতজাগা প্যাঁচাদেরও নেই কোনও ভয়।
তবুও রাখাল ভাবে – দেখি চুপি চুপি 
ঘরটা আঁধার থাক জ্বালাবো না কুপি! 
বাঁশি থাক তাকে তোলা বাজাবো না আর 
বরং কাস্তে নিয়ে দেবো তাতে ধার। 
ফুরালে চাঁদের আলো, জ্যোৎস্না-আস্ফালন
পাড়ি দেব দূরদেশে এই চায় মন! 
ভাবনার গলিপথে রাখালেরা একা 
আলো জ্বেলে সকালের মুখখানা দেখা!
বাঁশি তার থেমে যায় বাজে নাকো সুরে 
সুখ মরীচিকা হয়ে চলে গেছে দূরে॥
~~~~~~~

 

(ছোট গল্প)

শিল্পী

ইসমাত রিজুয়ানা 

 

ক্যানভাস জুড়ে ধীরে ধীরে একজন মানুষের আকৃতি স্পষ্ট হচ্ছে । মানুষটি একটা ভাঙা বাড়ির দাওয়ায় উবু হয়ে বসে রয়েছেন। পরনে ধুতি আর সাদা ফতুয়া। ধৃতিমানের খুব চেনা লাগছে উবু হয়ে বসে থাকা ক্যানভাসের মানুষটিকে। তবু তিনি ঠিক চিনতে পারছেন না এ কার মুখ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে চলেছে ক্যানভাসের গায়ে।

মানুষটার হাতে ধরা একটা সোনালি রঙের পুরনো দিনের দামি ঝরনা কলম। রোল করা দামি কাগজের ওপর ঝুঁকে ক্যানভাসের এ-চরিত্র আসলে কী করছেন তা-ই এক ধাঁধা হয়ে রয়েছে সমবেত শিল্পী-লেখকদের ভেতর।

কিছু কি ভাবছেন তিনি? মুখাবয়বের রেখাগুলি সে-কথা বলছে না; বরং তাকানোটা বড় বেশি বিষন্ন ঠেকছে; প্রিয় কোনোকিছু হাতছাড়া হয়ে পড়লে মানুষকে যে রকম রিক্ত-নিঃস্ব দেখায়, সে রকম। মানুষটার কী এমন হারিয়ে গেছে যে কলম নিয়ে ঝুঁকে থাকতে হবে সাদা কাগজের ওপর?

ধৃতিমান এককালে গান-টান করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলিতে প্রায়ই তাঁকে সবার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গান গাইতে দেখা যেত। তিনি নিজেকে একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সম্ভবত এই তাড়না থেকেই উজ্জীবিত হয়ে তিনি ক-বছর ধরে কবি - লেখক-শিল্পীদের একত্র করছেন ডায়মন্ড হারবারের সবুজে ঘেরা নিজের বাগানবাড়িতে।

শিল্পীদের গাড়ি করে আনা এবং গাড়ি করে আবার পৌঁছে দেওয়া – সব দায়িত্ব তাঁর একার কাঁধে। তাঁদের খাওয়ানো ও দামি-দামি সব উপহার দিয়ে তৃপ্ত রাখার এক অমলিন ইচ্ছা জন্মেছে তাঁর ভেতর। ক-বছর ধরে বস্ত্র-ব্যবসার পাশাপাশি তিনি মেতে রয়েছেন এসব নিয়ে।

এ উপলক্ষে তাঁর ডায়মন্ড হারবারের বাগানবাড়িটি জমজমাট সাজে সেজে ওঠে প্রতিবছর। পায়ের নিচে কোমল ঘাস আর মাথার ওপর রকমারি গাছের ছায়া সত্যি সত্যি মনোরম স্নিগ্ধ এক আবহ তৈরি করে রেখেছে এখানটায়।

স্টেজে চলছে একের পর এক জনপ্রিয় বাংলা গান। গাইছেন কলকাতার তরুণ শিল্পীরা। ড্রাম আর গিটারের উত্তাল শব্দ চারপাশে। যে-পাখিগুলির গাছে বিশ্রাম নেওয়ার কথা এ সময়, ভয়ে-ত্রাসে ওরা এখন নিঃসীম নীলাকাশে দিক্ভ্রান্ত, ছোটাছুটি করছে এখানে-ওখানে।

জগন্ময় শীল নিরামিষাশী মানুষ। বয়স প্রায় সত্তর। কুঁজো হয়ে হাঁটেন। ফর্সা লম্বা চেহারা। কণ্ঠস্বর পাতলা; বিনয় মিশে রয়েছে কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটি উচ্চারণে। ধৃতিমানের এক বন্ধুর সুবাদে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তখন থেকেই মানুষটাকে নিয়ে একটা জমায়েত করার ইচ্ছে ছিল নিজের এই বাগানবাড়িতে।

বোলপুরে কোপাই নদীর তীরে একটা মাটির ডেরায় তিনি থাকেন। নেশার ভেতর শুধু হুঁকো টানেন আর মাঝে মাঝে মহুয়া পান করেন সাঁওতালদের পরব-পার্বণে।অকৃতদার মানুষটি মাঝে মাঝে চাঁদের নেশায় বুঁদ হয়ে কোপাই -ময়ূরাক্ষীর পাড়ে ঘুরে বেড়ান রাতের বেলায়। পাগলাটে স্বভাবের শিল্পী হিসেবে তাঁকে সবাই জানে ও চেনে।

যেখানে শিল্পী থাকেন, সেখানকার পুরোটা সবুজ অন্ধকারে ঢাকা। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। তারপর শনছাওয়া মাটির কুঁড়েঘর। ঘরটার ওপর দুটো সজনে গাছ একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। তবে চারপাশে এত পুরনো গাছপালা থাকা সত্ত্বেও ধৃতিমান লক্ষ করলেন, উঠোন একেবারেই সাফসুতরো। কোথাও একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই।

তিনি যখন এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারছেন তখনই হঠাৎ করে হাতে খুন্তি নিয়ে জগন্ময় শীল বেরিয়ে এলেন, ‘হুলো বেড়ালের মতো কাকে খুঁজছিস রে হারামজাদা?’

‘গুরুজি, আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আপনি যাবেন কলকাতায়?’

‘কেন যাবো না? কলকাতার গঙ্গা নদীটা তো এখনো আমায় ডাকে। সেই অশ্বত্থ গাছটা তো এখনো আমার মাথার ভেতর। এ-জীবনে কত অশ্বত্থ আর বটবৃক্ষ দেখেছি । কিন্তু ওই গঙ্গা পাড়ের নিঃসঙ্গ বৃক্ষটির কি তুলনা হয় বল? আমার পুরো কৈশোরটাই তো ওই বৃক্ষটার শিকড়ের সঙ্গে পেঁচিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারছিস?’ 

শিহরণ খেলে গেল ধৃতিমানের শরীরে। যে-মানুষটির অনুভব এতো তীব্র, তাঁর সৃষ্টিকর্ম গভীর তাৎপর্যময় না হয়ে পারেই না, ভাবেন ধৃতিমান।

অবশ্য প্রথম দর্শনে এরকম তুই-তুকারি সম্বোধন মোটেই ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু জগন্ময় শীল উচ্চারিত এই তুই-তুকারি মোটেই ধৃতিমানকে অপমানিত করছে না, বরং নিজের ভেতর মানুষটির প্রতি একধরনের গভীর আত্মীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলছে। বড় আপন লাগছিল তাঁকে।

‘আজ সজনের ডাঁটা দিয়ে মুগডাল আর ভাত রেঁধেছি। তুই খেয়ে যাস। অকৃতদার মানুষ হলেও আমার রান্নার হাতটা আঁকার মতোই মন্দ নয় রে!’

ধৃতিমান মানুষটার সারল্যে এতটাই মুগ্ধ যে তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তার সঙ্গে লাঞ্চ করলেন।

সেই তো শুরু। তারপর শিল্পী জগন্ময় শীল এলেন কলকাতায়। আইডিয়াটা এরকম , শিল্পী জগন্ময় শীল একটি ছবি আঁকবেন দিনভর। বিশিষ্ট লোকজন হল্লা করবেন; গান-বাজনা হবে; খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান চলবে। সবকিছুর মাঝে শিল্পী তাঁর ছবিটি আঁকবেন। এই ছবিটাই হবে ধৃতিমানের জন্য মহামূল্যবান এক উপহার। কথাটা জানাতেই জগন্ময় এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। 

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল কাজকর্ম। ধৃতিমানের অ্যাড ফার্ম উঠে পড়ে লেগে এই ফার্ম-হাউস মাত্র চারদিনে আয়োজনের উপযোগী করে তৈরি করে ফেলল। প্রবীণ শিল্পী জগন্ময় শীলের লাইভ আর্ট-শো। অর্থাৎ তিনি আঁকবেন আর অন্য সব বুদ্ধিজীবী হাসিমুখে সেসব দেখতে দেখতে চর্ব - চোষ্য- লেহ্য- পেয়তে মজে থাকবেন।

স্থপতি ইমরান সমসাময়িক বন্ধু ধৃতিমানের। তিনি জগন্ময়ের দিকে চোখ রেখে বলে উঠলেন, ‘ শিল্পীরা কি পাগল হয় নাকি দোস্ত। আঁকতে আঁকতে কি রকম পাগলের মতো করছে। কোত্থেকে ধরে আনলি এঁকে?’

‘শিল্পীরা পাগলই হয়। ওদের সঙ্গে এসব পাগলামি কিভাবে যেন মিলেও যায়। তুই আমি কি সব ছেড়েছুড়ে ওঁদের মতো হতে পারবো কোনোদিন বল? তুই-আমি ব্যবসা করে দেদার টাকা-পয়সাও জমাবো আবার শিল্প-সাহিত্য নিয়ে একটুখানি ছুকছুকও করবো। দুটোই রাখবো, ছাড়বো না একটাও। হাঃ হাঃ হাঃ।’ ধৃতিমান হেসে ওঠেন গলা ছেড়ে।

ইমরানকে কাটিয়ে এবার ধৃতিমান এসে দাঁড়ালেন শিল্পীর সামনে। মানুষটি তুলি চালানোর চাইতে আঁকিবুঁকিপূর্ণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অনেকক্ষণ। হয়তো ভাবছেন কিছু।

ধৃতিমান সরে এলেন শিল্পীর কাছ থেকে। বাংলোঘরের ভেতরে পা দিতেই ওঁর চক্ষু চড়কগাছ।সবাই এর মধ্যেই একত্রিত হয়ে সুরাপান আরম্ভ দিয়েছেন আর বিরামহীনভাবে এটা-ওটা ভক্ষণ করে চলেছেন। কেউ এখানকার হিমেল হাওয়া ছেড়ে শিল্পীর কাছে চালতা গাছতলায় যেতে চাইছেন না। রূপার গানের পর বাঁশি বাজানোর কথা তপনের। তাকে দেখা গেল বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। 

বিরক্ত হয়ে ধৃতিমান ত্রিপল টাঙানো খোলা জায়গাটায় ফের এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন শিল্পকর্মটি। প্রথমে যে-রকম লেগেছিল, এখন রেখাগুলি স্পষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ ঝুঁকে বসে রয়েছে একটি লেখার খাতার ওপর। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, হতাশ আর বিমর্ষ মুখ তাঁর। আঙুলের ফাঁকে উল্টো করে ধরা কলমটি। চাঁচাছোলা চেহারার এক বৃদ্ধ কেন এভবে তাকিয়ে রয়েছেন, ধৃতিমান বুঝতে পারেন না ।

এ সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কবি কমলেশ বসু। তাঁর কবিতার ধার অনেককেই স্পর্শ করছে ইদানীং। মুখ বাড়িয়ে ক্যানভাসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ধৃতিমানকে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ‘লোকটা কি পারভার্ট?দেখছেন না কী আঁকছেন?’

সঙ্গমের দৃশ্য। একটা লোক, তাও বৃদ্ধ, উপুড় হয়ে আছে এক নারীর ওপর। ছিঃ। বুড়ো হয়েছেন, তবু ভণ্ডামি যায় না।’

ধৃতিমান ফের তাকালেন ছবিটার দিকে। শিল্পী জগন্ময় শীল নিবিষ্ট হয়ে রয়েছেন ছবিটায় ; বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছেন। হাতে-মুখে আর কাপড়ে রঙের ছোপ।

লেখক সৌরিন সেন পাশে এসে দাঁড়ালেন। চাপা গলায় বলে উঠলেন, ‘এ তো বাচ্চাদের ছবির মতো লাগছে। পেটে দ্রব্য পড়েনি?এই একটা ম্যাদম্যাদা ছবি দেখানোর জন্য এত আয়োজন?’

ধৃতিমান মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। সহসা তাঁর মনে হলো, তিনি জোর করে মানুষটিকে একটা বৈরী পরিবেশের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখানকার কেউ তাঁকে বুঝতেই চাইছেন না। কেন যে এখানে ছবি আঁকার লাইভ-শো করার ইচ্ছে হলো ওর। 

জগন্ময় শীল পিছন ফিরে তাঁকে ডেকে উঠলেন, ‘ধৃতি দেখে যা।’ এমনভাবে ডেকে উঠলেন যে মনে হলো ওর প্রয়াত বাবা ডাকছেন বালক ধৃতিমানকে। একইরকম আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে শিক্ষক বাবা তাঁকে ডাকতেন। সেই ডাকটা এখনো তিনি বুকের গহিনে নিয়ে চলেন।

ধৃতিমান শিল্পীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। মুখে মিঠা হাসির ছোঁয়া। সহসা হাতের তুলিটা আকাশের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এইবার তোর লোকজনকে ডাক দে। জিজ্ঞেস করে দ্যাখ দেখি, কে বুঝতে পারছে ছবিটা? ছবিটার একটা নাম দিলাম – অপারগতা। 

ধৃতিমানকে ডাকতে হয়নি; শিল্পীর পাগলপারা আচরণে বিস্মিত সবাই  ছুটে এলেন এদিকে।

কবি কমলেশ বসু ফস করে বলে বসলেন, ‘এ তো একটা পাহাড়, ঝুঁকে রয়েছে একটা বহতা নদীর ওপর। পাহাড় আর নদীর চুম্বনবন্দি যেন এ চিত্র।’

‘বাহ, কল্পনাশক্তি তো তোর খুব প্রখর। মা এদিকে আসো তো।’ এবার ডেকে উঠলেন খোদ শীলাকে।

শীলার পরনে হলুদ বেনারসি। বেশ ঝলমল করছে। কাছে আসতেই জগন্ময় বললেন, ‘মা বলতো এই অধম কী আঁকতে চাইছি? একটু দেখে বল।’

‘একটা বিশাল আকৃতির বক নদীর তীরে এসে মাছ খুঁজছে নুয়ে।’ বলতে গিয়ে শীলার হাসি পাচ্ছিল বড়। কিন্তু এটা হাসির জায়গা নয় ভেবে কোনোভাবে নিজেকে চেপে উত্তর দিলেন।

এসময় ভেতর থেকে টলতে টলতে ক্যানভাসের ঠিক সামনে চলে এলেন কথাসাহিত্যিক জামাল নাসের। ঘোর লাগা চোখে ছবিটি ভালো করে দেখে নিলেন কয়েক পলক। তারপর বলে উঠলেন, ‘আরে এ তো ডাচ শিল্পী পাগলাটে ভিনসেন্ট উইলিয়েম ভ্যান গগ। আত্মহত্যার ঠিক আগেকার সময়ে মানসিক ভারসাম্য হারানো গগ। ঠিক কি না গুরুজি?’

জগন্ময় কোনো কথা না বলে তুলি আর রঙের পাত্রটি জামাল নাসেরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুই কি করিস রে বাবা? আমার মতো পাগলা দাশু?’

‘না গুরুজি। পাগলামি করার সুযোগ নেই এ-জীবনে। বাঁধাধরা জীবন আমার। একটু-আধটু গল্প-উপন্যাস লিখে থাকি । এই আর কি।’ সবার কৌতূহলী দৃষ্টি এখন তারই ওপর।

‘তাইলে তোর গুরুকে তুই চিনতে পারছিস না কেন? 

‘গুরুজি আপনিই বলুন।’ অনুরোধ ঝরে জামাল নাসেরের গলায়।

‘আরে বাপু এ-মানুষটা আর কেউ নন, স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমি যেমন এখন পারি না। তিনিও একটা সময়ে এসে আর লিখতে পারতেন না। আমি যেমন ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিষ্ফলা সময় কাটাই, দাঁত দিয়ে নখ কাটি, ওই মানুষটাও দামি কলম-কাগজ নিয়ে দিনের পর দিন বসে থাকতেন। লেখা বেরোত না। যা আসত তা মনঃপূত হতো না, ছিঁড়ে ফেলতেন কাগজ। তোরা কেউ ধরতেও পারলি না? ’ শেষের কথাগুলি বলতে গিয়ে কেমন বুঁজে আসে গলার স্বর তাঁর। এক অপরিমেয় কষ্টে ধনুকের মতো বেঁকে যায় ছোট শরীরখানা।

চারপাশ স্তব্ধ। এখানে যাঁরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন তাঁরা কোনো না কোনোভাবে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে রয়েছেন। এমন কি যাঁরা চার-হাতে টাকা কামাচ্ছেন বলে অন্যের চুলকানি হচ্ছে, তাঁরাও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকা মানুষজন।

ধৃতিমানের সহসা মনে হলো – জগন্ময় শীলের কথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও আত্মমগ্ন এই মানুষগুলিকে অস্থির করে দিয়েছে; ওদেরও চোখে-মুখে স্পষ্টতর হচ্ছে অপারগতার এক যন্ত্রণাবোধ।

ধৃতিমান এগিয়ে যান শিল্পী জগন্ময় শীলের দিকে। তারপর শিল্পীর ছোটখাটো ভাঙাচোরা বুড়ো শরীরটিকে জড়িয়ে ধরে গভীর মমতায় বলে ওঠেন, ‘ভেতরে চলুন। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে ।

সহসা ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি, ‘আমরা পারি না কেন ধৃতি? একটা সময়ের পর এমনিভাবে আমরা ফুরিয়ে যাই কেন? আমরা কেন গঙ্গা পাড়ের অশ্বত্থ হতে পারি না? কেন রে? পারি না কেন? হো হো হো।’

সবার পকেটের রুমাল তখন চোখের কোনায়।

~~~~~~~

 

সর্দি জ্বরের নৈশ চিকিৎসা

 রাহুল পারভেজ

 

রাত দু’পহরে প্রথম চেষ্টা বিফলে গেল হজরত আলীর। বাপ দশরথ আলীর দেয়া নামটা লোকে ডাকে, হজা!

ছোট বেলায় পাকা কাঁঠাল পাড়তে 

গিয়ে গাছ থেকে আছড়ে পড়ে মাটিতে‌। 

পা ভেঙ্গে যায়। দীর্ঘদিন প্লাস্টার করা থাকলেও ঠিকঠাক জোড়া লাগে না। 

পা ছোট বড় হয়ে যায়। যাকে বলে ঝনকা লাগা। তাই পাইট মুনিষের ভারী কাজ সে করতে পারে না। জমি জমা দাদু পোদ্দাদু দের  হয়ত ছিল। এখন কিছু নাই। বাপ দশরথ আলী গিরস্ত বাড়ির কিষাণ ছিল। তার তিন ভাই নদীয়া বর্ধমানে ধান কাটার কাজ করে সংসার চালায়। হজরত হালকা পাতলা কৃষি কাজ করত আগে। এখন সেটাও পারে না। মাঠের মিষ্টি আলু, ঢেঁড়শ-পটল আর ছিঁচকে চুরিই তার এখন একমাত্র ভরসা‌।

তো ক'দিন ধরে মঞ্জুর হাজির বাড়ি হানা দিয়ে কাজ হয় নি। নাতিটা শুয়ে থাকে পাটের গাদার পাশে। সঙ্গে ছোট পোতা সাব্বির আলী। ওরা হাজি দাদুর মক্কা থেকে আনা জাপানি রেডিও নিয়ে মত্ত। ঘুম না আসা পর্যন্ত তারা মহঃ রফির গানে ডুবে থাকে। রাত বারোটা একটার আগে পেঁচা দুটো তো শুবেই না! ওরা ঘুমে কাঁদা হলেও রেডিও বাজতে থাকে। হাজি সাহেব তখন রেডিওর কান মুচড়ে দিয়ে শুরু করেন ওজু। আধঘন্টা ধরে মুখে পানি ধরে গড় গড় শব্দে শ্লেষ্মা টানতে থাকেন। তারপর তাহাজ্বুদের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়েন। আবার ফজরের ওয়াক্তে উঠে যাবেন।

দফায় দফায় এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরপাক খেতে থাকে হজা। মাঝে  আসগর মন্ডল, ইয়াদ আলীর ঘরে ঢুঁ মারতে গিয়েও লাভ হয় নি। কুকুর গ্যাঙের তাড়া খেয়ে ফিরে আসে হাজির পিয়ারা তলায়। এখান থেকে বৈঠক ঘরের সব কিছু দৃশ্যমান। 

রেডিও নিরব। হাজিও ডুবে আছেন নাশা গর্জনে। এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ! উঁচু দাওয়া টপকে এক বোঝা পাটের মোড়া বগলে দেবে বাড়িতে রেখে আসে হজা।

এবার জ্বিনে ধরা মেজো চাচা আবুলের ঝাঁপ খুলবে কি খুলবে না দোনো মোনো করে সে। সন্তর্পণে 

ঝাঁপ খুলতেই ক্যাঁচ করে একটু  শব্দ হয়। চাচা নাক ডাকলেও তাঁর পরহেজগার জ্বিনেদের চোখে ঘুম নাই! একটু ঠেলা দিতেই অভদ্র ঝাঁপ কেঁদে ওঠে ক্যাঁচ! শব্দটা হজার কাছে মনে হয় জ্বিনেদের কারসাজি!

দশ বিশ নয়, গেল বছর চাচার গতরে একশো জ্বিন চাক বাঁধে। চাচা আলিফ-বে-তে- শে- কিম্বা আমপারা জীবনে পড়ে নি। অথচ বাজখাই গলায় কোরান শরীফ ঘন্টার পর ঘন্টা তেলাওয়াত করে! 

আবার চাচা খায়িশ মিটাতে চাচির কাছে গেলে পরে জ্বিনেরা ক্ষিপ্ত হয়! মুহুর্মুহু চাবুক চলে উদোম পিঠে। পিঠের চামড়া কালশিটে হয়ে গেলে ছাড় পায়। নাপাক হলেই চাচার উপর নেমে আসে কঠিন আজাব! চাচা তখন শূন্যে লাফিয়ে উঠে মাটিতে ভীষণ ভাবে আছাড় খেত। তারপর অজ্ঞান! বালতির বালতি পানি ঢাললে জ্ঞান ফিরত। তখন ছেলে মেয়েরা সরিষার তেল গরম করে অনেকক্ষণ মালিশ করত আপাদমস্তক। তারপর চাচা সারারাত মরার মত ঘুম পাড়ত।

এখন সেই ক্ষ্যাপা জ্বিনেরা অবশ্য কিঞ্চিৎ বশ মেনেছে। তবে তার চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে কেমন যেন ভয়াল রূপ ধারণ করে। বাড়ির ছোট বড় সকলেই তখন আতঙ্কে তটস্থ হয়ে থাকে।

হজা ভয়ে ভয়ে আবার ঝাঁপে আলতো ভাবে হাত লাগায়। চাচা নাক ডাকাচ্ছে। হঠাৎ একটা হৈঁদরী হাঁক ছাড়ে চাচা!

হজা ভয়ে দাঁড়িয়ে যায়। গলাটা কেমন যেন বিস্ময়কর! ফের চাচার নাকের ডাক তীব্র হয়। তিল বিলম্ব না করে এক গাদা পাটের মোড়া বগল দাবা করে বেরিয়ে আসে। আবার বেয়াদব জ্বিনেরা ঝাঁপটাকে ঝাঁকিয়ে দেয়! শব্দ তৈরি করে ইথার তরঙ্গে ছেড়ে দেয়, ক্যাঁচ! ক্যাঁচ!

চাচাও জ্বিনেদের লাথি খেয়ে উঠে পড়ে। গরুর পান্ঠি হাতে ছুটতে থাকে হজার  পিছন পিছন। ঝাপসা চাঁদের আলোয় মুখ ঢাকা হজা তখন ভৌ দৌড় শুরু করে।

‘এই শালার ব্যাটা শালা, দাঁড়া, নাহলে পান্ঠি দিয়ে তোর সায়া লাল করে দিব।’

জ্বিনের গতিবেগ তখন চাচার পায়ে। হজা হার মানে। রাস্তার উপরেই পিছন থেকে জাপটে ধরে। উনাভন দু'চার ঘা পান্টি পড়ে পিঠের উপর। পাটের জন্য ততটা লাগে না। টানতে টানতে  নিয়ে আসে খৈলানে। 

হজা বলে, আমি গো চাচা! আমি চুরি কত্তে আসি নি। একটা চিকিচ্ছা কত্তে আইস্যাছিনু।

আবুল বলে, ঠেলায় পড়লে সব শালা চাচা বলে!

হঠাৎ ভাতিজা হাইন্ঠ্যা কুদ্দুস ছুটে আসে। হাজি সাহেব, তাঁর নাতি-পোতা, বড় বউ, মেজো বউ, পোতা বউ সবাই জড় হয়। কুদ্দুস পিনাল্টি সর্ট মারে হজার পাছার উপর। হজা মুখ থুবড়ে পড়ে যায় খৈলানের শক্ত মাটিতে। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরে।

আবুল চাচা তখন সমানে গর্জাচ্ছে। বোল শালা, ক'মোড়া পাট লিয়ে গেছিস ? হজা বলে, এই কটা মোড়া বগলে দেবে ঘুরাঘুরা কচ্ছিল্যাম। তক্ষুনি তো পান্ঠি হাতে আমাকে ধরে সাঁটাতে শুরু কল্লেন!

হাজি বললেন, পাট চুরি কল্লি ক্যানে? 

হজা কাশতে কাশতে বলল, তিনদিন থেকে সর্দি জ্বরে বাহাত্তারা হয়্যা গেনু। সন্ধ্যায় জসিম কবরেজ বুলল, শুইকন্যা পাট বগলে দেবে ঘুরাঘুরি কল্লে সর্দি টেনে লিবে। তাই ঘুরাঘুরি করছুনু।

হাজি বললেন, কতক্ষণ ঘুরেছিস?

হজা বলল, এই তো দশ মিনিট ।

--আচ্ছা। তাহলে এখন পাটগুলা নামা। আর এখান থেকে খৈলানের শেষ মাথা  পর্যন্ত নাক ছেঁছড়ি দে। তারপর এক মোড়া পাট বগলে দেবে বাড়ি যা।

হজা নাক বাঁচিয়ে নাক ছেঁছড়ি দিতে থাকে। আর ভাবতে থাকে, যাক বাবা, বাঁচা গেল। ভাগ্যিস কুড়ি মোড়া পাট বাড়িতে রেখে এসেছিনু! মোটা মোটা মোড়া। তিরিশ পঁয়ত্রিশ সের তো হবেই। একশ দেড়শ টাকা কম কিসে! টাকায় আড়াই সের চাল। দু-সের ডাল। কুড়ি সের আলু তো নিশ্চিত ! এখন একমাস রাত জেগে বাড়ি বাড়ি কুকুরের মত ঘুর ঘুর করতে হবে না তাকে! 

অবশ্য মঞ্জুর হাজি লোক ভাল। তাঁর মত লোক আছে বলেই দুনিয়াটা এখনও টিকে আছে! না হলে ক্ষ্যাপা চাচার জ্বিনেদের অত্যাচারে দুনিয়া এদ্দিন পয়মাল হয়্যা যেতক!

~~~~~~~

 

সোনালী স্বপ্ন

            লেখক ইসরাইল সেখ 

 

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমি যখন রাস্তা দিয়ে যেতে থাকি সামনে দেখতে পেলাম আমার বন্ধু নীরাঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে আমি তার উদ্দেশ্যে করে বললাম, কি নীরাঞ্জন, রাস্তার মাঝে একা একা দাড়িয়ে আছো যে?

সে কোন উত্তর দিল না। তার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছিল।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। নিরাঞ্জনের চোখে জল! এ তো হতে পারে না। নীরাঞ্জন ছিল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তার না ছিল অর্থের অভাব না ছিল বিলাস রাহুল জীবনের কোন ত্রুটি। পড়াশোনায় ছাত্র হিসাবেও সে ছিল অনেক মেধাবী। আজ তাকে রাস্তার মাঝে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তার এই কান্নার রহস্য জানার জন্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে আমি আবার তাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকলাম, ‘নীরাঞ্জন কি হয়েছে তোমার?’

সে কেবল আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, সে অনেক কথা সঞ্জয় ভাই।

নীরাঞ্জনকে আমি সঙ্গে নিয়ে পাশে বল্টুর চায়ের দোকানে গেলাম। তার চোখের ছাহনি দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন হাজার ব্যথার স্রোত চোখ দিয়ে বহে চলেছে। তার কেন এত কষ্ট আজ আমাকে জানতেই হবে। 

আমি বললাম, ‘বল্টু ভাই দুটো বিস্কুট ও দুটো চা দাও তো, ও হ্যাঁ সঙ্গে দুটো সিগারেট দিও।’ বিস্কুট খাওয়ার পর চা সিগারেট একসঙ্গে খেতে খেতে নীরাঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করলাম, বল নীরাঞ্জন, তোমার এই চোখের জল কেন ঝরছে? জীবনের প্রথম আজ দেখলাম তোমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে।

‘সঞ্জয় ভাই সব কপালের ফ্যার। জানো তো পাশের পাড়ার সে প্রধানের মেয়ে সোনালিকে আমি অনেক ভালোবাসতাম।

সোনালি?

হ্যাঁ ভাই সোনালি।

প্রধানের মেয়ের সঙ্গে তোমার এত সম্পর্ক আমিতো জানতাম না। সঞ্জয় ভাই, বন্ধু যখন সুখে থাকে তখন বন্ধুর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দুঃখের সময় বন্ধু ছাড়া আর উদ্ধার হওয়া মতো কেউ থাকে না।

হুঁ বুঝলাম। সোনালিকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। বলতে পারো একরকম নিজের হাতেই মানুষ করেছি তাকে।

হ্যাঁ তুমি তো তাকে অনেক দিন থেকে টিউশনি করাতে, না?

হ্যাঁ টিউশনি করাতাম বটে কিন্তু আমি তাকে ভালবাসতাম আর সেই কারণেই আমি টিউশনি পড়াতে যেতাম। জানো আমি পড়াতে গিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা নিতাম না। কেন জানো? আমি তাকে ভালোবাসতাম। আমি শুধু তাকে দেখার জন্য কেবল পড়াতে যেতাম, পড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আমি কোনদিনই তাকে পড়াতে যাইনি। আগামী সোমবার আমার প্রাণের, আমার সোনালির বিয়ে। সে আমাকে কার্ড দিয়ে গেল আর বলল, নীরাঞ্জন  দা, অবশ্যই তুমি আমার বিয়েতে যাবে। তারপর থেকে আমি আর কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এটা কিভাবে সম্ভব! একটা সময় ছিল যখন সেও আমাকে চেয়েছিল। এখন সে কিভাবে আমাকে কার্ড দিয়ে গেল! শুনলাম, এক সরকারি সার্ভিস ম্যান-এর সঙ্গে তার নাকি বিয়ে। আমি তো এক বেকার ছেলে, কেনই বা সে আমাকে বিয়ে করবে? বেকারদের মূল্য বাবা-মা ই তো দেয় না, সমাজ কিভাবে দেবে? জীবন যেন সমুদ্রের ফেনার মতো, কোন সময় ফাঁপিয়ে তুলে আবার কোন সময় ঠিক টেনে নিচের দিকে নামিয়ে দেয়। জানো সঞ্জয়, আমার জীবনটাও ঠিক এরকম। একেবারেই নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। রাত্রি ১২ টায় যখন আমায় ফোন দিয়ে সোনালি বলত, নীরাঞ্জন দা অংকটা বুঝতে পারছি না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতাম, আমি আসছি। আমার কাছে সময় জ্ঞান কিছুই ছিল না। সে সব রাতে ওর চোখের কোণে কত নেশা উঁকি মারত! একদিন রাতে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অন্ধকারের মাঝে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তোমাকে ছাড়া বাঁচব না নীরাঞ্জন দা। কিন্তু সে সব কি‌ কেবলই ছলনা ছিল? আমি চাইতাম সে কিছুই না বুঝুক। সে যেন আমার কাছে সব কিছু বুঝিয়ে নেয়। আমি সমস্ত পৃথিবী তাকে বুঝিয়ে দেব।

সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর আবার বলতে থাকল, সোনালি দেখতে ফর্সা, হালকা পাতলা একজন যুবতী। ভ্রুগুলি টানা টানা। চুলগুলো বেশ লম্বা। তার হাসি দেখে আমাকে মনে হতো যেন উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাতের টকটকে চাঁদ। কতদিন কল্পনার নৌকাই চড়ে ওর সাথে রাত্রি বিহার করেছি। প্রেম বিহীন ধূসর পৃথিবী কি কেবল টাকাই চায়? শুধুই কি টাকা? এই পৃথিবী কি মানুষের জন্য না? মানুষ টাকার কাছে নিজেকে এই ভাবে বিলিয়ে দেয়? দিতে পারে? - আমি নিজের মানুষের কাছ থেকে সেটা শেখলাম। না, না ওকে কাছের মানুষ বলা যাবে না, কারণ সে আমার কাছের মানুষ হলে আমাকে ছেড়ে কখনো অন্য কারো বুকে চলে যেতে পারত না। সঞ্জয়, চলো আজ এক প্যাক মদ খাই। মদ খেলে নাকি সমস্ত ব্যথা বেদনা দূর হয়ে যায়। দূর হয়ে যাক সেই মেয়ে, যার নাম আমি আর মুখে উচ্চারিত করব না কোনদিন।

ওরা দুই বন্ধু মিলে রেস্তোরার দিকে এগোতে লাগল। সেখানে বেশ বাংলা মদ পাওয়া যায়।

সকালে নীরাঞ্জনের ঘুম ভাঙতেই সোনালির কথা মনে পড়ে গেল। আজ সোমবার। আজ ওর বিয়ে আমি কি যাব তার অনুষ্ঠানে? না, আমার বোধহয় যাওয়া ঠিক হবে না। আমি গেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না। তাই আজ দূর থেকেই তাকে অনেক আশীর্বাদ করব, সে যেন অনেক সুখ ও স্বাচ্ছেন্দে জীবন কাটাতে পারে। আজ থেকে আমি শুধু চেয়ে থাকবো তার জন্য। কোন  এক  অমোঘ ঘর্ষণে সে যদি আমার কাছে ফিরে আসতে চায় আমি নিশ্চয় তাকে কাছে টেনে নেব - কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব রাখব না। আমি জীবনে কাউকে ঠকাইনি বলেই কি আমি নিজেই ঠকে গেলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় নীরাঞ্জন বাড়ি থেকে সেই বের হয়ে গেল তো গেলই। এ বাড়িতে নীরাঞ্জন ছাড়া কত গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত পার হতে থাকল; কিন্তু বাসন্তিকা একবারও এসে উঁকি মেরে দেখল না।

~~~~~~~


সোমা

 আজিজুল হাকিম

শঙ্কর ও তার স্ত্রী - মিতালী সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সোমাকে পেল না। দুজনেরই চোখেমুখে আতঙ্ক। কথাবার্তায় পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করতেও কেউ ছাড়ল না। পরিচিতিদের মধ্যে সকলকেই কল করা হয়েছে। খোঁজ পায়নি। খুঁজাখুঁজির সমস্ত উপায়গুলি আজ নিরুপায় হয়ে গেছে।
শঙ্কর দোতলার ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। অনুসন্ধিৎসু চোখে চারিপাশে তাকাল। না, কোথাও সোমার চিহ্ন মাত্র নেই। কেবল শহরে বিভিন্ন প্রান্তে ধোঁয়ার উদ্গিরন চোখে পড়ছে। আকাশটা যেন কালি মেখে মুখভার করে বসে আছে। দূরের আকাশে শকুনের সারি উড়ে বেড়াচ্ছে।
        এমন সময় বাড়ির বাইরে পা বাড়ানোর সাহস নেই। সারা শহরটায় যেন শব্দ দূষণের কবলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কেবল কাকের চিৎকার সারা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাইরেনযুক্ত গাড়ির শব্দ মাঝে মাঝেই রাস্তার ওপর আছঁড়ে পড়ছে। আবার বিলিন হয়ে যাচ্ছে। কখনও বা গণ্ডগোলের আওয়াজ দমকা বাতাসের মতো আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে।
        পাঁচদিন ধরে শহরটা যেন কেমন হয়ে গেল। সারা শহরটায় রক্তের ছড়াছড়ি। চারিদিকে অবিশ্বাসের বাতাস বয়ছে। শান্তশিষ্ট ছেলেগুলি রাতারাতি উগ্র আর রক্ত পিপাসু হয়ে গেল। রহিমের ছেলেটা কত শান্ত ছিল! পড়াশুনায় দুর্দান্ত মেধা ছিল। যে ছেলেটি শহরের গৌরব বাড়িয়ে দিয়ে ছিল, সেই ছেলেটি পৃথিবীতে আর নেই। ওর বন্ধুরাই নাকি ওকে মেরে ফেলল। আর ওই বন্ধুদের দলেই নাকি ছিল শঙ্করের ছেলে। কেন যেন, সেদিন সোমার সারা মুখ অশ্রুসিক্ত ছিল। সারাদিন কিছুই মুখে তুলেনি। রহিমের সঙ্গে নিজের সম্পর্কটাও খারাপ ছিল না।
        শঙ্কর আর ভাবতে পারছে না, ষোল বছরের মেয়েটি গেল কথায়!

সে ছাদ থেকে নীচে নেমে এল। থানায় কল করল; কিন্ত একটা জোর ধমক খেয়ে মোবাইলটা নামিয়ে নিল। বুকের ভিতরটা যেন হাহাকার করে উঠল। মিতালী এসে শঙ্করকে জিজ্ঞেস করল, “কোন খবর পেলে?”
        শঙ্কর কোন উত্তর দিল না। খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চোখ মেলে ধরল। ধোঁয়ার কুন্ডুলিটা বিস্তৃত আকাশ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
        এমন সময় বাড়ির বাইরে একটা গাড়ি এসে থামল। শঙ্কর গলির দিকে ছুটে গেল। দেখল, একটা কালো কাঁচের গাড়ি গলিতে দাঁড়িয়ে। গাড়ির কাঁচ আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল। শঙ্কর থতমত খেয়ে গেল। গাড়ির ভিতর থেকে রহিম বললেন, “এমন দিনে মেয়েকে ছেড়ে দিতে হয়?”
        মিতালী বলল, “কোথায় আমার মেয়ে?” কন্ঠে এক আকাশ আতঙ্ক ।
        গাড়ির ব্যাক সিটের কাঁচ খুলে গেল। সোমা হেনার পাশ থেকে নামছে।

এক ঝাঁক লোকের আগ্রাসী কোলাহল তখনও আকাশ বাতাস কাঁপাচ্ছে।

~~~~~~~  

 

(রম্যগল্প)

শাসন শোষণ ভাষণ

     প্রদীপ কুমার দে

 

ছোটবেলা থেকে মা মেরে মেরে আমায় তক্তা বানিয়ে ছেড়েছে,  একেবারে শক্ত মানুষের মত মানুষ হয়েছি। কত শিখেছি। উঠতে বসতে মায়ের শাসন ছিল বড় অদ্ভুত আর কঠিন।
সকালবেলায় একটু বিছানা আঁকড়ে থাকলেই হয়েছে আর কি, আরম্ভ হত মায়ের চিৎকার,
--  ঘুমো ঘুমো, কুম্ভকর্ণের মত ঘুমো, জেগে উঠে দেখবি আর কিছু করার নেই।
আমি পাশ ফিরে শুতাম, মা রেগে যেত আরো,
--  কুলাঙ্গার এক‌টি। বাপের ডুপ্লিকেট!
আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতো আর আমি বাবার কি দোষ সেটাই খোঁজার চেষ্টা চালাতাম কারণ বাবা অনেক আগেই উঠে গেছে।
--  কিরে শয়তান উঠবি না কি গায়ে জল ঢেলে দেব, কষ্টের পয়সা নষ্ট করো তুমি?
উঠে বই নিয়ে বসলেও চিৎকার,
--  পড়ছিস না ঘুমাচ্ছিস?
--  পড়ছি .....
--  গলায় আওয়াজ কোন চুলোর দোরে গেল? বাপের মত মিউ মিউ করছো যে ....
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতো মায়ের শাসন। এটা নয় ওটা নয়।  এটা করবি না ওটা করতে নেই। আমি যা বলছি তাই অক্ষর অক্ষরে মেনে চল। তাহলে বাপের মত হবি না নিশ্চিত ইত্যাদি প্রভৃতি। 
বড় হয়ে গেলাম। যাহোক করে টেনেটুনে পাশ করেছিলাম ভাল চাকরিও জুটলো না। বেসরকারি গরুর গোয়ালে চাকরি জুটিয়ে  নিলাম। আমি দেখতে  বেশ চালাক চতুর ছিলাম। লম্বা মিশুকে। মেয়ে পটে গেল। সে আবার আর এক গল্প।
আমরা তিনটি অভিন্ন প্রানের বন্ধু ছিলাম।  আমি মন্টু আর দুজন বিতাস আর সুবাস। হলো কি মাঝে একটা উটকো ঝামেলা এসে উৎপাতের কারণ ঘটিয়ে ছাড়লো। 
বেশ চকমকি চেহারার হাসিখুশি লতি এসে ভাব জমালো আমাদের সাথে। আমারাও ডগমগ মেয়ে বন্ধু পেয়ে ডাব খাইয়ে ভাব করে নিলাম। শুরু হয়ে গেল কে বেশি বেশি করে লতিকে খুশি করার প্রয়াস। অভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে লাগাতার চেষ্টা চালাতে লাগলাম আমরা তিনজনেই। 
ওরা সরকারি চাকরি করতো। আর আমি বেসরকারি। বেশি বুদ্ধি আমার, আমি লতিকে লটকিয়ে নিলাম। গঙ্গার পাড়, শপিংমল হোটেল রেস্তরাঁয় নিয়ে যেতে লাগলাম। বন্ধু দুজন কেমন একটু শ্লথগতি হয়ে পড়লো আমার দেদার হওয়া দেখে। 
লতি অর্ডার করলে, --  আমাকে ফোরেইন কসমেটিকস কিনে দিতেই হবে।
--  সে আর এমনকি?  দেবো।
--  চলো না গাড়িতে লংড্রাইভে যাই।
--  চলো ....
--  এই শোনো না আমার বেশ কিছু নগদ লাগবে। কোথায় পাবো বলোতো?
--  কোথায় আর পাবে? আমি ছাড়া?
এরকম করেই চললো শোষণ। প্রথমে ধরতে পারিনি পরে বুঝেছিলাম। একটার পর একটা বায়না। চাপ দিয়ে আদায় করতে লাগল। হঠাৎ দেখি আরো একটি ছেলে লতির পিছনে পিছনে ঘুরছে। বুঝলাম বড় লোকের ছেলে। এত খরচ করে ফেলেছি লতির পিছনে আর খরচ করা ঠিক হবে  না। রিস্ক নিলাম না। শোষণের হাত থেকে বাঁচতে একদিন আচমকা লতিকে ছেড়েই দিলাম। 
আহাঃ লতি গয়া গঙ্গা হল। পরে বুঝতে পেরেছি লতির আমাকে শোষণের এটাই একটা চাল!
ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিলাম। লতিকে ছাড়তেই নারী সঙ্গ খুব প্রয়োজন হয়ে উঠলো। খুব আনন্দ পেলাম। বউ পেলাম। এবার বউ আমার আন্ডারে! এবার আমি আমার মতো চালাবো ওকে।
ভাবি এক আর হল আর এক। দুই বছরেই আমি নাজেহাল। বেসরকারি আয়ের ভারে আমি নেতিয়ে পড়তেই বউ ওলির ভাষণ শুরু হয়ে গেল।
--  দুবছর হয়ে গেল। কি দিলে আমায়?
--  দেবো আবার কি? খাওয়া পরা তো দিচ্ছিই।
--  এই জন্য কোন মহিলা বিয়েতে রাজী হবে? জানো আমার বড় ঘরে বিয়ে হলে কত আদর যত্নে থাকতাম। আমার বন্ধুরা সব্বাই কত আনন্দে মজায় আছে। আর আমায় তুমি কি দিলে?
-- এটা পাওয়া নয়? তোমার কপাল। আমায় দোষ দিচ্ছো কেন?
--  না এখন থেকে তুমি আমার কথা শুনে চলবে।
--  তাই? তা কিরকম কথা, যেমন শুনি ...
--   এযুগে সবাই চোর তুমিও অফিসে দুনম্বরি করবে। বড়লোক হতেই হবে।
-- তাহলে তো চাকরি চলে যাবে আর না খেতে পেয়ে মরতে হবে।
--  কিচ্ছু হবে না। চোরেরা চোরকে বাঁচায়। 
চোরে চোরে মাস্তুতো ভাই
কিন্তু সাধু চোরে মিল নাই।
--  লোন নাও, ফ্ল্যাটে নিয়ে চলো, এখানে থাকা যাচ্ছে না।
--  লোন শোধ করবো কোথা দিয়ে?
--  দুবার চারবার শোধ দেবে তারপর আর দেবে না।
--  সে কি! আমার যে জেল হবে।
--  যাবে। ভাল রোজগেরে যখন নয় তখন বাইরে থাকা আর জেলের মধ্যে থাকা একই ব্যাপার।
শুধু আগেভাগেই ফ্ল্যাট আমার নামে করে দেবে।
--  ওহঃ তুমি তাহলে এটাই চাও।
--  হ্যাঁ,  আরো অনেক কিছু .....
--  যেমন?
--  প্রাক্তনের সাথে মিলতে ...
*******

 

(প্রবন্ধ)

 

বাবা-মা’র ঠিকানা কখনও যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয

মহম্মদ মফিজুল ইসলাম 

 

পৃথিবী নামের এই অপার সৌন্দর্যের বুকে ভালোবাসা, সম্পর্ক, এবং দায়িত্ববোধের মেলবন্ধনই একে সত্যিকার অর্থে বাসযোগ্য করে তোলে। প্রকৃতির নিয়মে ফুল ফোটে। খেলায় নিয়ম থাকে। আর পথচলায় শৃঙ্খলা প্রয়োজন হয়—এটাই স্বাভাবিকতা। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যদি বাগানের প্রতিটি কোনায় লেখা থাকে “ফুল তুলবেন না”, খেলার মাঠে লেখা থাকে “নিয়ম ভাঙবেন না”, আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে লেখা থাকে “ট্রাফিক আইন ভাঙবেন না”, তাহলে কেন পৃথিবীর কোনও দেয়ালে লেখা থাকে না “বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মাকে রাখা যাবে না”? কেন এমন কোনো আইন নেই, যা সন্তানকে বাধ্য করবে মাতা-পিতার শেষ বয়সের আশ্রয় হয়ে উঠতে?
বাবা'-মা ভালোবাসার আলো। সম্পর্কের শিকড়।
একটি ছোট্ট শিশুর জন্য তার মা-বাবাই পুরো পৃথিবী। জন্মের পর যখন সে চোখ মেলে, তখন প্রথম যে মুখ দুটি সে দেখে, তা তার বাবা-মায়ের। যখন প্রথমবার হাঁটতে শেখে, তখন তাদের হাতই থাকে শক্তির প্রতীক হয়ে। বাবা-মা কাঁধে তুলে এই পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখান, আঙুল ধরে পথ চলতে শেখান। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের প্রতিটি ধাপে তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, আর আত্মত্যাগের গল্প রচিত হয়।
কিন্তু সময়ের প্রবাহে যখন সেই শিশুটি বড় হয়ে ওঠে, তার দায়িত্ব বাড়ে। কর্তব্য বাড়ে ।জীবনের নানা প্রতিযোগিতায় সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে—তখনই কি বাবা-মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়? আজকের সমাজে এমন বহু চিত্র দেখা যায়, যেখানে বৃদ্ধ বাবা-মা সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দেহ, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, কাঁপা কাঁপা হাতে তারা দরজার ফাঁক দিয়ে সন্তানের অপেক্ষায় বসে থাকেন। কিন্তু সন্তান ফিরে তাকায় না, একবার জিজ্ঞেসও করে না— বাবা, কেমন আছো?”
“ মা, কেমন আছো?”
যাদের বাবা-মা নেই তাদের কাছে অনুভূতি একটি স্বর্গহীন পৃথিবীর। একদিন দেখা যাবে, যে গাছের ছায়ায় বসে তুমি শৈশবে স্বপ্ন দেখেছিলে, সেই গাছ একা দাঁড়িয়ে কাঁপছে বাতাসে। যে নদীর জলে তুমি স্নান করেছিলে, সেই নদী শুকিয়ে গেছে অভিমানে। যে আকাশ তোমাকে আগলে রেখেছিল, সেই আকাশও ধীরে ধীরে মেঘ হয়ে ঝরে পড়ছে।
এভাবেই পৃথিবী একসময় হারায় তার কোমলতা, ভালোবাসার উষ্ণতা। বাবা-মায়ের মুখে হাসির বদলে জমে ওঠে অভিমান, চোখের কোণে জমা হয় এক বুক অশ্রু। আমরা যদি প্রকৃতির নিয়ম মানতে শিখি, তাহলে কি পারিবারিক সম্পর্কের শিকড় আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি না? কেন এই সমাজ ধীরে ধীরে এত নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে, যেখানে বৃদ্ধাশ্রমই শেষ ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায় বাবা-মায়েদের?
নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষাই আসল শিক্ষা। মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মূল কথাই হলো দায়িত্ববোধ ও সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা। আমরা যদি সমাজকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করতে চাই, তবে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। বৃদ্ধাশ্রম নয়, বরং মায়ের কোলের মতোই ঘর হোক বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয়। সম্পর্কের শেকড় শক্ত রাখতে হলে সন্তানের উচিত তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা, যেমন একদিন তারা আমাদের জন্য করেছিলেন।
প্রত্যেক সন্তানের মনে রাখা উচিত, মা-বাবা কোনো বোঝা নন, বরং তারাই জীবন নামক বৃক্ষের মূল। যদি এই শিকড়কে উপড়ে ফেলা হয়, তবে ভালোবাসার বৃক্ষ আর বেঁচে থাকতে পারে না। সমাজে আইন করেও যদি এ ব্যাপারে পরিবর্তন আনা সম্ভব না হয়, তবে নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন, এবং মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে তা সম্ভব। আমাদের প্রতিটি কাজের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত “বৃদ্ধাশ্রম নয়, ভালোবাসার আশ্রয় চাই।”
ববাবা-মা প্রত্যেকে  সন্তানের কাছে একটা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর আলোকবর্তিকা। পৃথিবী তখনই স্বর্গ হয়ে উঠবে, যখন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চোখের জল শুকিয়ে যাবে সন্তানের কপালে ভালোবাসার স্পর্শে। সমাজে যদি প্রতিটি সন্তান বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তাহলে বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এই মূল্যবোধে শিক্ষিত করতে হবে, যেন তারা শেখে—অসহায় বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো শুধু কর্তব্য নয়, ভালোবাসার প্রকাশও।
এই পৃথিবীর প্রতিটি দেয়ালে লেখা থাকুক: “পিতা-মাতা কোনো বোঝা নয়, তারা জীবনের শিকড়।” লেখা থাকুক “বৃদ্ধাশ্রম নয়, ভালোবাসার আশ্রয় চাই।” লেখা থাকুক “মানুষ হও, মনুষ্যত্ব রক্ষা করো।”
তাই আসুন, আমরা এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে কেউ যেন বাবা-মায়ের চোখের জল ফেলে দেয় না, যেখানে সম্পর্কের শেকড় যেন কখনও শুকিয়ে যায় না, যেখানে ভালোবাসা চিরসবুজ হয়ে থাকে।
*******


জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ইহুদী সম্প্রদায়ের অগ্রগতির কারণ 

-      এষা বেলা

 

আজ মাটি থেকে আকাশে, স্কুল থেকে হসপিটালে, জীবনদায়ী ওষুধ থেকে বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা, গুগল থেকে ফেসবুকের পাতা – সমস্ত জায়গায় ইহুদীরা নিজেদের প্রতিভাকে বিকশিত করেছে। আর এই বিকাশের পিছনে তাদের যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা, প্রশ্ন করার সক্ষমতা আর ধর্মের কূপমণ্ডূকতা পেরিয়ে এই বিশ্বপ্রকৃতির জ্ঞানের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মণিমুক্তা অর্জন করেছে; যা বিশ্বের অন্য কোন সম্প্রদায় আজ পর্যন্ত পারেনি। 
        প্রশ্ন আসতে পারে, এই সম্প্রদায় কি হঠাৎ করেই কি এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে? না। দেশ ছাড়া, বাড়ি ছাড়া, বিতারিত এই যাযাবর সম্প্রদায় ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ১৯শ শতাব্দীতে ইউরোপে ‘হাসকালা’ নামে একটি শুরু করে। যার অর্থ হল ‘ইহুদী আলোকপ্রাপ্তি’। এই সময়ে ইহুদীরা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দেয়। এর ফলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত ও প্রকৌশলের মতো ক্ষেত্রে অবদান রাখতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীতে এই অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হয়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং পরবর্তীতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর।
   ইউরোপে ইহুদীরা প্রায়শই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক ছিল। এই পরিস্থিতি তাদের শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে উৎসাহিত করে। শিক্ষা তাদের জন্য সামাজিক গতিশীলতার একটি পথ হয়ে ওঠে। তারপর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইহুদী সম্প্রদায় (ডায়াসপোরা) বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জ্ঞানের সঙ্গে তাদের সংযোগ স্থাপন করে। এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনায় সহায়তা করে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ইহুদী সম্প্রদায়কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার জন্য উৎসাহিত করা শুরু হল। অথচ আমরা দেখতে পাই সুলতানদের পরাজয়ের পর সৌদি আরবের জন্ম হলে ওহাবি আন্দোলনের নেতা আব্দুল আজিজ সৌদ কেবল ধর্মের গোঁড়ামির দিকে নজর দেন। দেশটি প্রতিরক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, যা ইহুদী বিজ্ঞানীদের জন্য একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এগুলি কয়েকটি ধাপে বর্ণনা করতে পারি। প্রথমত, শিক্ষার প্রতি গুরুত্বঃ ইহুদি সংস্কৃতিতে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের উপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়। তালমুদিক ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা বিকাশ লাভ করে, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়। এমন কি ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ দেখা দিলে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
        দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যঃ ইহুদি সম্প্রদায়ের তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন করা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে; যা অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। এটি মনের মধ্যে কৌতূহল, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য উপযোগী মানসিকতা তৈরি করে। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মন ও মানসিকতার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতি গভীর গুরুত্ব থাকার ফলে অনেক ইহুদী পণ্ডিত ও গবেষক নোবেল পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মান লাভ করেছেন। প্রায় ২০% নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইহুদী বংশোদ্ভূত। যা বিশ্বের জনসংখ্যার তুলনায় অসামান্য।
      তৃতীয়ত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে যখন ইহুদিরা বাস করত তখন প্রায়শই নির্দিষ্ট পেশা (যেমন, ব্যাংকিং, বাণিজ্য) থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। ফলে তারা শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বাধ্য হয়; যার মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন ওদের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ফলে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে তাদের অবদান অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে।
        চতুর্থত, নেটওয়ার্কিং ও সহযোগিতাঃ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্তিশালী সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং পারস্পরিক সমর্থনের সংস্কৃতি রয়েছে বরাবর রয়েছে। এটি জ্ঞান, সম্পদ এবং সুযোগের বিনিময়ে সহায়তা করে, যা গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এমন নেটওয়ার্কিং-এর ও সহযোগিতার বড়ই অভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে মুসলিম আর হিন্দুদের মধ্যে। হিন্দুরা জাতপাত নিয়ে পড়ে থাকে আর মুসলিমরা মাজহাব নিয়ে কোলাহল করে।
   পঞ্চম, অভিবাসন ও অভিযোজনঃ এরা কালের স্রোতে বহুবার বিভিন্ন দেশে অভিবাসন করতে বাধ্য হয়েছে – যা অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়নি। যার ফলে তারা নতুন পরিবেশে দ্রুত অভিযোজন এবং উদ্ভাবনের দক্ষতা অর্জন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০শ শতাব্দীতে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় ইহুদি বিজ্ঞানীদের অভিবাসন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছে। যেমন, আইনস্টাইন, ফন নিউম্যান–এর মত বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়।
   ষষ্ঠত, ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভূমিকাঃ আধুনিক সময়ে ইসরায়েল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি অবাক করার মতো উদ্ভাবন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানকার স্টার্টআপ সংস্কৃতি, সামরিক গবেষণা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। এমনকি গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ২০শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ইহুদীরা তথ্যপ্রযুক্তি ও স্টার্টআপ সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দেয়। ইসরায়েল, যাকে ‘স্টার্টআপ নেশন’ বলা হয়, মাইক্রোসফট, গুগল, ইন্টেলের মতো কোম্পানির গবেষণা কেন্দ্র এবং অসংখ্য টেক স্টার্টআপের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
    সপ্তম, বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকদের অবদানঃ ইহুদী বিজ্ঞানীরা আধুনিক বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেছেন। যেমনঃ আলবার্ট আইনস্টাইন (আপেক্ষিকতার তত্ত্ব), জোনাস সল্ক (পোলিও ভ্যাকসিন), রবার্ট ওপেনহাইমার (পারমাণবিক বোমার গবেষণা), রিচার্ড ফাইনম্যান (কোয়ান্টাম মেকানিক্স), বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছেন। এছাড়া সের্গেই ব্রিন (গুগল), মার্ক জাকারবার্গ (ফেসবুক) এবং ল্যারি পেজ (গুগল) প্রযুক্তি জগতে এই সম্প্রদায়ের প্রভাব সারা বিশ্বের দরবারে প্রদর্শন করে। এটি অস্বীকার করার কিছুই নেই যে, গুগল আর ফেসবুক ছাড়া বর্তমান পৃথিবী অচল। এছাড়াও গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসায় ইহুদী বিজ্ঞানীরা অসাধারণ অবদান রেখেছেন। বর্তমানে ইসরায়েল সাইবার নিরাপত্তা, কৃষি প্রযুক্তি, এবং মেডিকেল ইনোভেশনেও বিশ্বনেতৃত্ব দিচ্ছে।
   অষ্টম, ইসরায়েলের প্রযুক্তি খাতের পরিসংখ্যানঃ ইসরায়েলের জিডিপির ১৮% প্রযুক্তি খাত থেকে আসে। দেশটি প্রতি বছর গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) জিডিপির ৫% বিনিয়োগ করে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।
নবম, সংস্কৃতি ও শিল্পকলাঃ আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাব যে ইহুদী লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এবং সঙ্গীতজ্ঞরা বিশ্ব সংস্কৃতিতে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তুলনামূলক আমরা অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখতে পাই না। বিশেষ করে ইসলামের যা চোখে পড়ার মতো নয়। উদাহরণস্বরূপ, স্টিভেন স্পিলবার্গ (চলচ্চিত্র পরিচালক), ফিলিপ রথ (লেখক), এবং লিওনার্ড বার্নস্টাইন (সঙ্গীত পরিচালক)। ইহুদী সংস্কৃতি হলোকাস্ট স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি ও মানবাধিকার আন্দোলনে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাব ফেলেছিল।
   দশম, অর্থনীতি ও ব্যবসাঃ ইহুদী ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং, ফিনান্স, এবং উদ্যোক্তা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জেপি মরগানের প্রতিষ্ঠাতা পরিবার এবং গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতো প্রতিষ্ঠানে ইহুদী নেতৃত্ব। বলতে গেলে, আজ সারা বিশ্বের বাণিজ্যিক লাগাম তাদের হাতে রয়েছে।
  এছাড়াও ইসরায়েল প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, এবং কৃষি উদ্ভাবনে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ড্রিপ ইরিগেশন (জলসেচ পদ্ধতি) এবং ওয়াজ (নেভিগেশন অ্যাপ) ইসরায়েল থেকে উদ্ভূত। এসব ভাবতে গেলে বর্তমান বিশ্বে ইহুদী সম্প্রদায়ের চরম অবদান লক্ষ্য করা যায়। এমন কি আজকের বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার মতো একটি দেশ ‘ইহুদী অঙ্গুলি হেলন’ ছাড়া চলতে পারে না।
এ সব সত্ত্বেও আজ শক্তির দম্ভে এই সম্প্রদায় আগ্রাসী, নিষ্ঠুর এবং গণহত্যাকারী সম্প্রদায়ে পরিণত হচ্ছে। জাতিপুঞ্জের নির্দেশকে অমান্য করে সমগ্র ফিলিস্তিনকে জোর করে দখল করে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা কখনোই একটি সভ্য সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আশা করা যায় না। যারা এক সময় মানবাধিকারের পূজারী ছিল আজ তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলছে অবিরত।    

Post a Comment

Previous Post Next Post