i ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-১/আজিজুল হাকিম

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-১/আজিজুল হাকিম

 

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা  

- আজিজুল হাকিম

        (প্রথম অধ্যায়)

 

পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই অনেক দেশে একেকটি জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের ক্ষমতা ও আধিপত্য বজায় রাখতে অন্য কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে নিপীড়ন, বর্জন, এমনকি দেশ থেকে উৎখাত করে দেশান্তরি করেছে। এই ধরণের ঘটনাগুলির পেছনে থাকে রাজনীতি,  ধর্ম এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উৎখাত করার জন্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ও সংখ্যাগুরু শাসক, উভয়ে মিলে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। এমন কি এখনও বিভিন্ন দেশ করে আসছে। এই পন্থাগুলি সাধারণত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, জাতিগত বিদ্বেষ, ধর্মীয় উগ্রতা এবং সাংস্কৃতিক কৌশলের সমন্বয়ে গঠিত মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন; যা সংখ্যালঘুদের জীবনযাত্রাকে দুর্বিসহ করে তোলে বা তাদের জোরপূর্বক দেশান্তরি করা হয় হয়। ইতিহাসের আলোয় উদাহরণসহ এই পন্থাগুলির বিশ্লেষণ আজ খুব প্রয়োজন হয় পড়েছে।

সংখ্যালঘু উৎখাতের বিভিন্ন দিকগুলির মধ্যে প্রথম হল, আইনি বৈষম্য ও নাগরিক অধিকার হরণ। অনেক সময় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ হয় আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন দিক থেকে তাদেরকে কোণঠাসা করা। সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই সব আইনের মাধ্যমে তাদেরকে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাদের মৌলিক অধিকারগুলি হরণ করা হয়। তার ফলে তাদের জীবনযাত্রা একদম অসহনীয় হয়ে পড়ে। তারা পশ্চাদপদ শ্রেণিতে পরিণত হয়। যেমন,  জিম ক্রো আইন (১৮৭০-১৯৬০)। এই আইনের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রে  বসবাসকারী আফ্রিকানদের পৃথকীকরণ (Segregation) এবং বৈষম্য ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটি তাদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্বল করে দেওয়া হয়।

জিম ক্রো আইন (Jim Crow Laws) ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে প্রণীত এক ধরনের বর্ণবাদী আইন। এই আইনগুলো মূলত কৃষ্ণাঙ্গ (African American) ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে “আলাদা কিন্তু সমান” (separate but equal) নীতির ভিত্তিতে সামাজিক, শিক্ষা, পরিবহন, আবাসনসহ নানান ক্ষেত্রে পৃথকীকরণ চালু করেছিল। উদাহরণস্বরূপ: আলাদা স্কুল, আলাদা বাসের সিট, আলাদা রেস্টুরেন্ট, ভোটাধিকার সংকোচন, আলাদা টয়লেট ও আলাদা জলের ফোয়ারার ব্যবস্থা করা হয়।

কিন্তু ১৯৫৪ সালে Brown v. Board of Education মামলার রায়ে স্কুলে বর্ণভিত্তিক বিভাজন অবৈধ ঘোষণা করা হয়।  ১৯৬৪ সালে Civil Rights Act এবং ১৯৬৫ সালের Voting Rights Act এই আইনগুলোর মাধ্যমে জিম ক্রো আইন পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়।

একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় আপারথাইড আইনের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য অ-শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে আপারথাইড নীতি প্রয়োগ করা হয়। ‘আপারথাইড’ শব্দটি আফ্রিকানস ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘আলাদা থাকা’ বা ‘বিভাজন’।  আপারথাইড আইন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি বর্ণবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এই আইনের অধীনে, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কড়া বিভাজন তৈরি করা হয় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নানা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয় ও ‘রঙিন’ (mixed race) মানুষদের আলাদা শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি বিয়ের ক্ষেত্রেও বর্ণভিত্তিক বিধিনিষেধ ছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার ছিল না এবং তারা সরকারের অংশ হতে পারত না। নির্দিষ্ট জায়গায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই নীতি তাদের ভূমি, শিক্ষা, এবং রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

তাছাড়া আমাদের প্রায় সকলের জানা, নাৎসি সরকারের কার্যকলাপ। জার্মানির প্রেসিডেন্ট হিটলারের সহায়তায় ১৯৩৫ সালের নিরেনবার্গ আইন-এর মাধ্যমে ইহুদি জনগোষ্ঠীকে জার্মানির নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। 

এরপর মায়ানমারের দিকে তাকালেও আমরা একই ব্যবস্থা দেখতে পাই। 1962 সালে সামরিক শাসন শুরু হলে জাতিগত পরিচয় ও নাগরিকত্ব নিয়ে কঠোর নীতিমালা প্রবর্তিত হয়। তারপর 1978 সালে “নাগরিক যাচাই অভিযান” (Operation Nagamin) চালিয়ে বহু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য করা হয়। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি রাষ্ট্রহীন করে ফেলে। ১৯৮২ সালের নতুন নাগরিকত্ব আইনে ‘জাতীয় জাতি’ হিসেবে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রকাশ করা হয়, যাতে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ফলে তারা নাগরিকত্ব হারায় এবং ‘বিদেশি’ বা ‘বাঙালি’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। তারপর রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পায় না। তারা মায়ানমারের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তারা শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়ে পড়ে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মায়ানমার সরকার আইন প্রণয়ন করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। তাদেরকে রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত করেছে।

(চলবে)

Post a Comment

Previous Post Next Post