ছবিঃ সংগৃহীত (আল-জাজিরা)
গাজা
থেকে বলছি
কলমে: রুওয়াইদা আমের
(গাজাঃ প্যালেস্তাইন)
তর্জমাঃ আজিজুল হাকিম
আমি একটি সংখ্যা নই, আমি আত্ম-পরিচয়হীন বেনামী কোন নারীও নই।
আমি গাজার একটি সত্যিকারের গল্প। এটি আপনাদের অবশ্যই জেনে রাখা উচিৎ।
(রুওয়াইদা আমের ক্রমাগত ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ভয়ের সাথে তার জীবনের লড়াই করার ঘটনা বর্ণনা করেছেন আর ভাবছেন এরপর কী হবে।)
এত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখব আমি আশা করিনি। আমি আগে বলতাম, মৃত্যু হঠাৎ আসে, যা আমরা অনুভব করি না; কিন্তু এই যুদ্ধে তারা আমাদের সবকিছু অনুভব করিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে। আমাদের বাড়িগুলি বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য কি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে! যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এটি হয়তো এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভয়ের সেই অনুভূতি আমার মনের মধ্যে স্থায়ীভাবে একটি জায়গা করে নিয়েছে। এই মৃত্যুর ভয় আমার হৃদয়কে ভীষণ ক্লান্ত করে দিয়েছে। আর এক সময় এটি আমাকে ভীষণ অসহ্য লাগে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, আমি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে খুব কাছ থেকে লড়াই করে যাচ্ছি। আমার এখনও সেই মুহূর্তগুলি মনে পড়ে যে নেতজারিম এলাকা দিয়ে ট্যাঙ্কগুলো প্রবেশ করেছিল। আমি হতবাক হয়ে আমার সব বন্ধুদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলামঃ “তারা গাজায় কীভাবে ঢুকল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি!”
আমি এই ভেবে অপেক্ষা করছিলাম যে তারা খুব অল্প সময়ে গাজা থেকে সরে যাবে। আমরা আবার মুক্ত হবে, যেমনটা আমরা সবসময় জানতাম। এখন তারা আমার খুব কাছে - আল-ফুখারিতে, খান ইউনিসের পূর্বে এবং রাফাহর উত্তরে। এটি সেই জায়গা যেখানে খান ইউনিস শেষ হয় এবং রাফাহ শুরু হয়।
তারা খুব কাছ থেকে প্রতিমুহূর্তে আমাদেরকে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে বাধ্য করছে, সেই অবিরাম শব্দগুলো আমাদের সহ্য করতে বাধ্য করছে।
তবুও বলব, এই যুদ্ধটি আলাদা, আমি আগে যা অনুভব করেছি তার থেকে অনেক অনেক আলাদা।
(রুওয়াইদা আমের ক্রমাগত ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ভয়ের সাথে তার জীবনের লড়াই করার ঘটনা বর্ণনা করেছেন আর ভাবছেন এরপর কী হবে।)
এত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখব আমি আশা করিনি। আমি আগে বলতাম, মৃত্যু হঠাৎ আসে, যা আমরা অনুভব করি না; কিন্তু এই যুদ্ধে তারা আমাদের সবকিছু অনুভব করিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে। আমাদের বাড়িগুলি বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য কি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে! যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এটি হয়তো এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভয়ের সেই অনুভূতি আমার মনের মধ্যে স্থায়ীভাবে একটি জায়গা করে নিয়েছে। এই মৃত্যুর ভয় আমার হৃদয়কে ভীষণ ক্লান্ত করে দিয়েছে। আর এক সময় এটি আমাকে ভীষণ অসহ্য লাগে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, আমি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে খুব কাছ থেকে লড়াই করে যাচ্ছি। আমার এখনও সেই মুহূর্তগুলি মনে পড়ে যে নেতজারিম এলাকা দিয়ে ট্যাঙ্কগুলো প্রবেশ করেছিল। আমি হতবাক হয়ে আমার সব বন্ধুদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলামঃ “তারা গাজায় কীভাবে ঢুকল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি!”
আমি এই ভেবে অপেক্ষা করছিলাম যে তারা খুব অল্প সময়ে গাজা থেকে সরে যাবে। আমরা আবার মুক্ত হবে, যেমনটা আমরা সবসময় জানতাম। এখন তারা আমার খুব কাছে - আল-ফুখারিতে, খান ইউনিসের পূর্বে এবং রাফাহর উত্তরে। এটি সেই জায়গা যেখানে খান ইউনিস শেষ হয় এবং রাফাহ শুরু হয়।
তারা খুব কাছ থেকে প্রতিমুহূর্তে আমাদেরকে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে বাধ্য করছে, সেই অবিরাম শব্দগুলো আমাদের সহ্য করতে বাধ্য করছে।
তবুও বলব, এই যুদ্ধটি আলাদা, আমি আগে যা অনুভব করেছি তার থেকে অনেক অনেক আলাদা।
আমার গল্প মনে রেখো
এটা কি করে সম্ভব যে আমার কাফনের উপর শুধু লেখা থাকবে “একজন তরুণী, কালো/নীল ব্লাউজ পরা”? আমি কি “অজ্ঞাত ব্যক্তি” হিসেবে মরে যেতে পারি, শুধু একটা সংখ্যা হয়ে?
আমি চাই আমার চারপাশের সবাই আমার গল্প মনে রাখুক। আমি একটা সংখ্যা হয়ে হয়ে এই মরতে চাই না।
আমি সেই মেয়ে, যে গাজায় খুব কঠিন অবরোধের মধ্যে শোচনীয় পরিস্থিতিতে হাই স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছি এবং আমার বাবাকে সাহায্য করার জন্য সর্বত্র কাজ খুঁজেছি। তিনি অবরোধের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন আর বারবার চাকরি হারিয়েছিলেন।
আমি আমার পরিবারের বড় মেয়ে। আমি আমার বাবাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। এটাও চেয়েছিলাম যেন একটা ভালো বাড়িতে থাকতে পারি।
থামো… আমি আর কিছু ভুলতে চাই না। আমি একজন শরণার্থী। আমার দাদা-দাদি ছিলেন শরণার্থী, যাদের ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের কারণে আমাদের নিজস্ব ভূমি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তারা গাজা উপত্যকায় চলে গিয়েছিলেন এবং খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন; যেটা শহরের পশ্চিমে অবস্থিত। আমি সেই শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাকে সেখানে আমার জীবন মসৃণভাবে চালিয়ে যেতে দেয়নি।
বাড়িটি খুব ছোট ছিল। একটি পরিবারের পাঁচজনের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে বাবা ও মা ছিলেন। তার জন্য একটা অতিরিক্ত ঘর, একটি বসার ঘর এবং রান্নাঘরে প্রয়োজন ছিল। তবুও আমরা সেখানে খুব কষ্টে প্রায় ১২ বছর বাস করলাম। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমি ২০১৫ সালে আমার বাবাকে সাহায্য করার জন্য একটা কাজ করতে শুরু করি। আমি বাড়িটিকে বাসযোগ্য করে তুলতে বাবাকে সাহায্য করলাম। যদিও এই কাজটি খুব কঠিন ছিল। আমরা আমাদের বাড়ি তৈরি শেষ করি ৭-ই অক্টোবর ২০২৩ সালে। যুদ্ধ শুরুর মাত্র তিন মাস আগে। হ্যাঁ, প্রায় ১০ বছর আমি আমাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এটিকে একটু একটু করে পুনর্নির্মাণে ব্যয় করি আর যুদ্ধের ঠিক আগে আমরা নির্মাণের কাজ শেষ করতে সক্ষম হই।
গাজার জীবনের অবরোধ ও কঠিনতার কারণে আমি ইতিমধ্যে ক্লান্ত ছিলাম। তারপর যুদ্ধ এসে আমাকে সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিল, আমার হৃদয়কে ক্লান্ত করল এবং আমার মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে চলেছি। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই, ক্ষুধা বা তৃষ্ণায় মরে না যাওয়ার জন্য লড়াই, আমরা যে ভয়াবহতা দেখছি এবং অনুভব করছি তা থেকে মন হারিয়ে না ফেলার জন্য লড়াই। আমরা যে কোনো উপায়ে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করি। আমরা বাস্তুচ্যুতি পেরিয়ে এসেছি – আমার জীবনে আমি চারটি বাড়িতে বসবাস করেছি এবং প্রতিটি বাড়ি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণের কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমাদের থাকার জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। যুদ্ধবিরতির আগে আমরা ৫০০ দিন দুঃসহ ভয়ের মধ্যে কাটিয়েছি।
যুদ্ধের সময় আমি যা করিনি, দুর্ভাগ্যবশত, তা হল কাঁদা। আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি এবং আমার দুঃখ ও ক্রোধ ভেতরে দমিয়ে রেখেছি, যা আমার হৃদয়কে আরও ক্লান্ত আরও দুর্বল করে দিয়েছে। আমি ইতিবাচক ছিলাম। আমার চারপাশের সবাইকে আশ্বাস, বেঁচে থাকার জন্য মনোবল দিয়েছিঃ হ্যাঁ, উত্তরের মানুষ আবার ফিরে আসবে। হ্যাঁ, সেনাবাহিনী নেতজারিম থেকে সরে যাবে। আমি সবাইকে শক্তি দিতে চেয়েছিলাম, যদিও আমার ভেতরে ছিল প্রচণ্ড দুর্বলতা, যা আমি কখনও কাউকে দেখাতে চাইনি। আমার মনে হয়েছিল, যদি এটা প্রকাশ পায়, তাহলে আমি এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাব।
কিন্তু যুদ্ধ ফিরে এলো। আমার আরও কাছাকাছি। আমি অবিরাম ভয়ের মধ্যে বাস করছি, কারণ আমার চারপাশে চলছে অবিরাম গোলাবর্ষণ। তারা আমাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে – রকেট, বিমান ও ট্যাঙ্ক থেকে গোলা। ট্যাঙ্কগুলো গুলি চালিয়ে গেছে, নজরদারি ড্রোন উড়তে থেকেছে; সবকিছুই ভয়ঙ্কর।
আমি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ঠিকমতো ঘুমোইনি। যদি একটু তন্দ্রা আসে, তবে বিস্ফোরণের শব্দে জেগে উঠি এবং দৌড়ে যাই। আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি, কিন্তু বাড়ির মধ্যে দৌড়াই। এই অবিরাম আতঙ্কে আমি আমার হৃদয়ে হাত রাখি। ভাবি, এটা আর কতটা সহ্য করতে পারবে? তাই আমি আমার সব বন্ধুদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছি, তাদের বলেছি আমার গল্পটি ছড়িয়ে দিতে, যাতে আমি শুধু একটি সংখ্যা হয়ে না থাকি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমার চারপাশের পাড়াটি ধ্বংস করছে। আমরা অসহনীয় দিনগুলো পার করছি। এখানে এখনও অনেক পরিবার বাস করছে। তারা চলে যেতে চায় না। কারণ বাস্তুচ্যুতি ক্লান্তিকর – শারীরিকভাবে, আর্থিকভাবে এবং মানসিকভাবে।
আমার মনে পড়া প্রথম বাস্তুচ্যুতি ছিল ২০০০ সালে, যখন আমার বয়স ছিল প্রায় আট বছর। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বুলডোজার খান ইউনিস শিবিরে এসে আমার চাচার বাড়ি এবং আমার দাদার বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। তারপর, কোনো কারণে, তারা আমাদের বাড়ির কাছে থেমে যায়।
আমার বাবা-মা ভেবেছিলেন আমরা পরে ফিরে আসতে পারব। তারা আমাদের জন্য একটি জরাজীর্ণ বাড়ির খোলস খুঁজে পান, যেখানে আমরা অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারা ভেবেছিলেন এটা সাময়িক।
আমি সহ্য করতে পারতাম না যে আমরা আমাদের বাড়ি হারিয়েছি। তাই আমি আমার দাদা-দাদির সঙ্গে সেই সুন্দর স্মৃতিগুলোর বাড়িতে ফিরে যেতাম। কিছু জিনিস নিয়ে আমার মায়ের কাছে ফিরে আসতাম।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ঈদের আগের রাতে আমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দিল। আমি এবং আমার পরিবার ঈদুল ফিতরের প্রথম দিনে সেখানে গেলাম। আমি ঈদের নতুন পোশাক পরে ধ্বংসস্তূপের ওপর ঈদ উদযাপন করলাম।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের কিছুই রাখতে দেয় না; তারা সবকিছু ধ্বংস করে, আমাদের হৃদয়ে শুধু দুঃখ রেখে যায়। আমি জানি না, ভবিষ্যৎ কী নিয়ে আসবে; যদি বিশ্ব আমাদের এই ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীর হাত থেকে না বাঁচায়। আমি জানি না আমার হৃদয় এই অবিরাম শব্দগুলো আর কতটা সহ্য করতে পারবে। আমাকে কখনো ভুলে যাবেন না।
আমি আমার জীবনের জন্য কঠোর লড়াই করেছি। আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। ১০ বছর ধরে একজন সাংবাদিক এবং শিক্ষক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছি। আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী আছে এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আমার সুন্দর স্মৃতি আছে।
যদিও গাজায় জীবন কখনো সহজ ছিল না, তবুও আমরা গাজাকে ভালোবাসি এবং আমরা অন্য কোনো দেশকে ভালোবাসতে পারব না।