একমুঠো ভিক্ষার জন্য
আজিজুল হাকিম
----------------------
ভোরবেলা থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি চলছে। তবুও সারা অঞ্চলের লোক বৃষ্টিকে
উপেক্ষা করেই এই স্কুল চত্বরে এসে জড়ো হচ্ছে। প্রত্যেকের মাথার উপরে ছাতা থাকলেও
কোমর থেকে নিচের অংশ ভিজে গিয়েছে। যতই রোদ পড়ুক বা বৃষ্টি হোক ওসব কিছু পরোয়া করলে
চলবে না - এমন মানসিকতা নিয়েই ওরা আজ এখানে এসে হাজির হচ্ছে। এত বৃষ্টি হচ্ছে যে
স্কুলের চত্বরটিও হাঁটু পর্যন্ত জল জমে গেছে। তবুও……।
ওদের আসার একটাই কারণ, আজকে না এলে ওরা সরকারি সুযোগ থেকে বাদ পড়ে যাবে।
কোন অবস্থাতেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না। তাই এই লাইন এদিকে ওদিকে আঁকাবাঁকা
হতে হতে স্কুলের চত্বরে আর ধরছে না।
বেলা বাড়ছে; তবুও বৃষ্টি ছুটার কোন লক্ষণ নেই। এই বৃষ্টির ধারা যেন
প্রতিবাদ করে বলছে, না, না। তোমরা এসো না। তোমরা এসব নিও না। তোমাদের আসার দরকার
নেই। আর তোমরা যদি আসো তাহলে আমরা তোমাদেরকে ভিজিয়ে দেব।
তাই বৃষ্টিও সেই ভোরবেলা থেকে ঝরঝর ধারায় ঝরে যাচ্ছে। সারাক্ষণ।
মাথার উপরে তাকালে কেবলমাত্র ছাতা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে,
এই স্কুল চত্বরে বিভিন্ন রঙের ছাতার ফুল ফুটেছে। তবুও অনেকের গাও ভিজে চবচব করছে।
শাড়ি কাপড়গুলো ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। কিন্তু লাইন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার
কোনো রকম কারো মানসিকতা নেই। লোকে যা ভাবছে ভাবুক, লোকে যা দেখছে দেখুক; তাতে ওদের
কোন যায় আসে না। আর ভাববেই বা কে? এখানে তো ধনী-গরিব, বড়লোক-ফকির সকলেই এক লাইনে
দাঁড়িয়েছে।
লাইনটাও সেই সকাল থেকেই আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছিল। তারপর সময়ের স্রোতে এটা
বেড়ে যাচ্ছিল অনবরত। যখন এগারোটা বাজল; তখন অফিসের লোকজনেরা গাড়িতে করে এলেন।
বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে উনারা এসে উপস্থিত হলেন। তারপর
যখন উনারা উনাদের কাগজপত্র আর বিভিন্ন রকমের ফর্ম নিয়ে স্কুলের বারান্দার
চারিদিকে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসলেন; তখন লাইন আর একটা থাকল না। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন
দপ্তরের লাইন আলাদা আলাদা হতে শুরু করল। প্রথমে সকলে ভেবেছিল একটি লাইন থেকেই
সকলের কাগজপত্র জমা নেওয়া হবে। কিন্তু যখন দেখল বিভিন্ন দপ্তর আলাদা আলাদা টেবিলে
বসেছে তখনই বাঁধল যত সব গণ্ডগোল। লাইন ভেঙ্গে আবার নতুন লাইন করতে গিয়ে শুরু হল
হুড়োহুড়ি। সকলেই সকলের আগে যেতে চায়ছে। ফলে কে কাকে ধাক্কা মারছে, কে কাকে ঠেলছে
বোঝা মুসকিল হয়ে পড়ছে। কেউ কারো ছাতা ধরে টানছে, কেউ কারো শাড়ির আঁচল ধরে টান
মারছে, কেউ কাউকে ধাক্কা মেরে হটিয়ে দিতে চায়ছে - এমন একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি
হল। স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল আর বৃদ্ধরা লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার ভয়ে কোন ক্রমে ভিড়ের
মধ্যে থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করছ। একটি বুড়ো মেয়ে তো ধাক্কাধাক্কির
মাঝে পড়ে মুখ থুবড়ে কাদা মাখা পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। কয়েকটি যুবক ছেলে ছুটে গিয়ে
উদ্ধার না করলে লোকের পায়ের চাপে পড়ে পানিতে ডুবে মারা যেত।
ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যেই ঝামেলা বেশি দেখা গেল। যারা শাড়ি পরে এসেছিল
তারা তো বেসামাল হলই; তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল - যে সব মেয়েরা বোরখা পরে চোখ ছাড়া
আপাদমস্তক ঢেকে এখানে এসেছিল তাদের মুখের আর কোন আব্রু থাকল না। বিয়ের পরে কোন
পরপুরুষ যে মেয়েটার মুখ কোনদিন দেখেনি সেই সালমার মুখের ওড়নাটি কোথায় যে গেছে কে
জানে! ও একজন মৌলবির স্ত্রী। বিয়ের পরে কোনদিন চোখ ছাড়া বাইরের কোন লোক তার
মুখটি পর্যন্ত দেখতে পায়নি। সেই সালমা এখন খালি মুখে পাশের একটি মেয়ের সঙ্গে
ঝামেলা করছে। কেবল ঝামেলা নয়, ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল বারুদের মতো অশ্লীল যত
কথা। আবু বলেছিল যে একদিন ওর স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওদের বাড়ি গিয়ে
অনেকবার ডাকাডাকি করেছিল। কিন্তু বাড়ি থেকে কোন উত্তর আসেনি। যদিও বাড়ি থেকে
মেয়েদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। তবুও তার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। এর আগেও নাকি আবু
দু-দুবার ওদের বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু মৌলবি বাড়িতে না থাকায় কোন উত্তর না পেয়ে
ওকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। জামসেদ আবুর মুখে এসব শুনে ছিল। আজ জামসেদ ওই
মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বিয়ের পরে সে কোন অবস্থাতেই অন্য পুরুষকে মুখ
দেখাবে না বলে শপথ করেছিল।
কেবল জামসেদ নয়, ওই সুন্দরী মহিলার দিকে অনেকেই তাকিয়ে আছে। জামসেদের পাশে
দাঁড়িয়ে থাকা একটি লোক বলেই ফেলল, টাকার কাছে সব শালা, সব শালী ল্যাজ নড়ায়।
জামসেদ কিছুক্ষণ পর দেখল, আর একটি মেয়ে সমান তালে ঝগড়া করে যাচ্ছে; সেটি হল
হাসেন মাষ্টারের স্ত্রী। জামশেদের কাছে বিষয়টি কেমন কেমন ঠেকছে যেন। মনে হচ্ছে,
একটা অন্ধকার যুগের সূচনা হচ্ছে। মানুষ এতো লোভী হয়ে পড়ছে! এতো অর্থ-পিপাসু!
জামশেদ তাকিয়ে আছে ওই ঝামেলার দিকে। মেয়েরা সাধারণত চিৎকার চেঁচামেচি
করতেই ভালোবাসে। কিন্তু ও একটু অবাক হল - ওরা এখন হাতাহাতিও করতে ওস্তাদ। মঞ্জুর
এই এলাকার একজন ধনী ব্যক্তি। একজন বড় মাপের ব্যবসায়ী। ও কয়েক কোটি টাকার মালিক আর
তার স্ত্রীও এসে এ লাইনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যারা গরিব শ্রেণীর মানুষের স্ত্রী
তারা কিন্তু এদের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারছে না। যার কারণে অনেকে লজ্জায়, অনেকে
শক্তির অভাবে পিছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত এদের ঝামেলা থানার পুলিশ এসে থামতে বাধ্য হল। পুলিশ সালমাকে
ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। হাসেন মাস্টারের স্ত্রীকেও হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে
নিয়ে গিয়ে পিছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে বলল। তারপর পুলিশ ঘোষণা করল, এরপর যদি কেউ
ঝামেলা করে, তাহলে তাদেরকে লাঠি পেটা করা হবে। তখন সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে লাইনে
সোজা হয়ে দাঁড়াতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যে লাইন স্কুল পার হয়ে রাস্তার উপরে উঠে পড়েছে। ঘণ্টা খানেক
পর একজন এসে বলল, লাইন পঞ্চায়েতের গলি পর্যন্ত চলে গেছে।
স্কুল থেকে পঞ্চায়েতের দূরত্ব প্রায় একশ মিটার হবে। এতো বড় লাইন! জামসেদ
অবাক হয়।
জামশেদ ওই স্কুলের একজন সাধারণ কর্মচারী। তার কাছেই ইস্কুলের সমস্ত চাবি
থাকে। যার কারণে হেডমাস্টার ওকে সারাদিন স্কুলে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। স্কুলের
আসবাব পত্র যেন মানুষের কোলাহল আর ঝামেলায় নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে
বলেছেন।
জামশেদ স্কুলের বারান্দায় একটি চেয়ার নিয়ে বসে বসে এসব কাণ্ডকারখানা
দেখছে। ও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রব্বানকে বলল, তুমি আবার কিসের ফর্ম জমা দেবে?
রব্বান একজন সাধারণ লোক। বলল, আমি কিছুই জমা দেব না। আমি সরকারি কোন অনুদান
চাইও না। ভিখারির খাতায় নাম লিখানোর ইচ্ছা আমার নাই।
রব্বানের কথা শুনে জামসেদের মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। ও তাকিয়ে থাকল
লোকজনের লাইনের দিকে। দেখতে দেখতে ওর চোখটি কেমন যেন আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে গেল।
ও আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ওর মনের দৃষ্টি দিয়ে তখন তাকাতে লাগল। ও দেখতে পেল,
লাইনটি বড় হতে হতে স্কুল পেরিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে পঞ্চায়েতের ধার পর্যন্ত চলে
গেছে। হয়তো আরো দূরে যাবে। কিন্তু ও আর কোন সাধারণ মানুষকে দেখতে পাচ্ছে না। কেবল
দেখতে পাচ্ছে অগণিত ভিখারীর দল সার বেঁধে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে বিশাল লম্বা লাইনে
হেঁটে চলেছে। আর লাইনও আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে। পঞ্চায়েতে পেরিয়ে, বটগাছ তলা
পেরিয়ে মাইলের পর মাইল। এ লাইন আর কত বড় হবে!
*******