i ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-৩

ইতিহাসের আলোকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতের ধারা-৩

 

অধ্যায়-৩ 

অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও বর্জন

 

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎখাতে অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও বর্জন একটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক অস্ত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সংখ্যালঘুদের উপর অর্থনৈতিক নিপীড়ন-এর মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় সহজেই জীবিকা হরণ করার একটি ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এই কৌশলের দ্বারা সংখ্যালঘুদের ব্যবসা, চাকরি, জমি বা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। যার কারণে ওদের উন্নয়নের সমস্ত পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই কৌশলগুলো সংখ্যালঘুদের সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা ও অস্তিত্বের ভিত্তি উচ্ছেদ করতে ব্যবহৃত হয়। ওরা বুঝে নেয়, অর্থ ছাড়া শিক্ষা অসম্ভব আর শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অসম্ভব এবং প্রতিবাদ অসম্ভব। এই সরঞ্জামগুলি অস্বীকার করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমগ্র কাঠামোকে দুর্বল করতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় উঠে পড়ে লাগে। ফলে জমি বা সম্পত্তি ছাড়া এই সম্প্রদায়গুলি ধীরে ধীরে শিকড় বিহীন গাছে রূপান্তরিত হয়। যার ফলে তারা বাস্তুচ্যুত বা নির্বাসিত হয়ে আপন জন্মভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। প্রকাশ্য সহিংসতার বিপরীতে, অর্থনৈতিক নির্যাতন এবং বর্জন প্রায়শই সূক্ষ্মভাবে কাজ করে এবং এর ধ্বংসাত্মক ব্যাপারটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। এই কৌশলগুলি কেবল জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্য নয় বরং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলিকে তাদের সামাজিক গতিশীলতা, তাদের স্বাধীনতা এবং তাদের কণ্ঠস্বর থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বর্জন সংখ্যালঘুদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের উৎখাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে তাদের অস্তিত্বকে অসহনীয় করে তোলে। এসবের মাধ্যমে শাসক গোষ্ঠী সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায় আর এই হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে তারা দাঙ্গা বাধিয়ে সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করে। 

এবার আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক নিপীড়নের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাই। মধ্যযুগে ইউরোপে ইহুদিদের অনেক পেশায় নিষিদ্ধ করা হতো; যেমন কৃষি বা কারুশিল্প। তাদের শুধুমাত্র সুদের ব্যবসা বা বাণিজ্যের মতো সীমিত ক্ষেত্রে কাজ করতে দেওয়া হতো; যা তৎকালীন সময়ে সামাজিকভাবে ঘৃণিত অবস্থায় ছিল। দোকানের সামনে ‘ইহুদি বিরোধী’ স্লোগান ও প্রচারণা তাদের গ্রাহক হ্রাস করে। এসব তাদের অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। নাৎসি জার্মানিতে (১৯৩৩-১৯৪৫) ইহুদিদের ব্যবসা বয়কট, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ এবং পেশাগত নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে তাদেরকে ধ্বংস করা হয়। এই নীতিগুলো হলোকাস্টের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কাজ করেছিল, যার ফলে লাখো ইহুদি বাস্তুচ্যুত ও নিহত হয়েছিল।

আমরা যদি বিশ্বের চারিদিকে চোখ ফেরায় তাহলে দেখতে পাব আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসকরা আদিবাসীদের ভূমি ও সম্পদ কেড়ে নিয়ে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়ে ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার আদিবাসীদের জমি দখল ও তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবিকা (যেমন শিকার, কৃষি) বন্ধ করে তাদের রিজার্ভেশনে সীমাবদ্ধ করা হয়; যেখানে অর্থনৈতিক সুযোগ ছিল নগণ্য। এটি তাদের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।

অর্থনৈতিক নিপীড়ন ও বর্জনের ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রায়শই তাদের জন্মভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি লুণ্ঠন, ব্যবসা ধ্বংস এবং অর্থনৈতিক বয়কটের মাধ্যমে তাদের বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৭-এর দেশভাগে ভারত ও পাকিস্তানে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের সময় (১৯৪৮-১৯৯৪) কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য অ-শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বর্জন করা হতো। তাদের উন্নত শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতো, যার ফলে তারা গ্রামীণ বা শহরতলির দরিদ্র এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। এই বর্জন তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথ রুদ্ধ করে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে, যেমন ইন্দোনেশিয়া (১৯৬৫-৬৬), চীনা সংখ্যালঘুদের ব্যবসা ও সম্পত্তির বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বর্জন প্রয়োগ করা হয়। এই বর্জন তাদের অর্থনৈতিক শক্তি হ্রাস করে এবং অনেককে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বয়কট ও সহিংসতা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মায়ানমারে আইন করে কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব এবং ভূমি অধিকার কেড়ে নিয়েছে। গ্রামগুলি ধ্বংস করা হয়েছে এবং সম্প্রদায়গুলিকে শিবিরে বা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

কর্মসংস্থান বৈষম্য এবং পৃথকীকরণ সংখ্যালঘুদের কর্মসংস্থান বাজারে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নির্যাতনের অপর একটি রূপ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ দক্ষ চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং কম বেতনের শ্রমে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। এই অর্থনৈতিক প্রান্তিককরণ শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক হাত শক্ত করেছিল।

আমেরিকার বুকেও একই অবস্থা দেখা গিয়েছিল। আমেরিকায় বসবাসকারী আফ্রিকানরা চাকরি-বৈষম্য, মজুরি-বৈষম্য এবং পেশাগত পৃথকীকরণের সম্মুখীন হয়েছিল; যা তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করেছিল এবং সামাজিকভাবে তাদেরকে পশ্চাৎপদ শ্রেণিতে পরিনত করেছিল।

শ্রীলঙ্কায় সিংহলি সংখ্যাগুরু সরকার তামিলদের শিক্ষা, চাকরি এবং জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে তামিলদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নীতি (১৯৮২) রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদের চাকরি, শিক্ষা ও ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। যার রেশ ধরে ২০১৭ সালে তাদেরকে ব্যাপক উৎখাতের দিকে নিয়ে যায়। যার কারণে প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়।

বর্তমান ভারতে ১৪ শতাংশ মুসলিম বাস করলেও সরকারি চাকরিতে মাত্র ২ থেকে ৫  শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ২৭.০১ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায় বাস করলেও সরকারি চাকরিতে মাত্র ৪ শতাংশ (ওবিসি সহ)। এসব পরিসংখ্যান দেখলেই মুসলিমদের প্রতি উভয় সরকারের আসল দায়িত্ব উন্মোচিত হয়ে পড়ে।

সবশেষে চোখ ফেরানো যাক বর্তমান ফিলিস্তিনের দিকে। সেদিকে তাকালেই আমরা একই অবস্থা দেখতে পাই। সেখানে বসতি সম্প্রসারণ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির মাধ্যমে অনেক ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এমনকি এখনও করা হচ্ছে। যার ফলে তাদের অর্থনৈতিক উপস্থিতি এবং গতিশীলতা চরমভাবে স্তব্ধ হয়ে গেছে। জৈতুন বাগানের দিকে তাকালে দেখতে পাই আগুন আর মরুভূমির কোরাস। যার কারণে গণতন্ত্র ও মানবতার পূজারী বিশ্ব মোড়লদের মানবিক মুখগুলিকে নরখাদক ও পৈশাচিক দেখাচ্ছে। মিসাইল, যুদ্ধবিমান আর অ্যাটম বোমের আস্ফালনে পুড়ে যাচ্ছে বিশ্ব মানবতার সোনালি স্বপ্নগুলো। জাহান্নামের আগুন আর ধ্বংসের অর্কেস্ট্রায় নিষ্পাপ জীবনের কান্নাগুলো কেমন ম্লান হয়ে যাচ্ছে বরাবর।

(চলবে) 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post