ঝুঁজকি আলোর রেখা-১৩/আজিজুল হাকিম

 


১৩ 

ধর্মের বারান্দায় রঙিন রাতগুলি


     আমরা নদীর ধারে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে বাড়ি ফিরে এলাম। তারপর খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় গেলাম। কিছুক্ষণ পর আলবেলা আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল।   

        ও বলল, তোমার কাহিনী শুরু কর। তুমি যে সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে বড় হয়েছে সে সব ঘটনার কিছুই তো বলা হল না। সে সব আমি শুনতে চাই।

        আমি বলতে শুরু করলাম, যেমন শবে বরাতের দিন ছিল আমার কাছে এক স্বর্ণালী দিন।

        ও বলল, শবে বরাত আবার কি?

        আমি বললাম, শবে বরাত একটি রাতের নাম। আরবি শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখের পরের রাতটি হল শবে বরাত। এই রাতে মানুষ ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ্‌ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। সারা বছরের রুজিরজগারে হিসাব নিকাশ তোমার কপালে অদৃশ্য কলম দিয়ে লিখে দেওয়া। ওই দিন সকাল থেকেই সকল বাড়িতে চলত হালুয়া রুটি তৈরির তোড়জোড়। প্রথমে চিনি আর গুড়ের হালুয়া। তারপর রুটি তৈরি। সেই রুটি আতব চাল আর গমের আটা এই দুই রকম করেই তৈরি করা হত। অন্যান্য গ্রাম থেকে ফকির মিসকিনরা সেই হালুয়া রুটি নিতে লাইন দিয়ে আসত। তারা এত রুটি পেত যে সে সব রুটি আর হালুয়া ওদেরকে মাথায় বয়ে নিয়ে যেতে হত।

        আলবেলা বলল, হালুয়া কি?

        আমি বললাম, একধরণের খাবার। নরম ও সুস্বাদু।

        ও বলল, তারপর বলল। 

        সেই দিন অবশ্য মা রোজা করতেন। কেবল সেই দিন নয় আগের দিন ও পরের দিনও একটি করে রোজা করতেন।

        তারপর সন্ধ্যা পার হলে রাতে পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে আমাদের বাড়িতে নামাজ পড়তে আসত। পাড়ার মেয়েরা ঝগড়াঝাঁটি করলেও বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে সকলেই একত্রিত হত। সেই সব দিনগুলির মধ্যে সবেবরাতের রাত একটি। আর তারা একত্রিত হত আমাদের বাড়িতে। তখন মনে হত না, কারো সঙ্গে কারো ঝগড়া হয়েছে। সকলেই রাতে গোসুল করে আমাদের বাড়িতে নামাজ পড়তে আসতো। মায়ের মুখে শুনেছিলাম ওই রাতে নামাজের উদ্দেশ্যে গোসুল করাই অনেক ফজিলত আছে। তাছাড়া মাথার চুল থেকে যতো ফোঁটা পানি ঝরবে ততই নেইকি পাওয়া যায়। সেই সব মেয়েরা মায়ের পিছুনে সারা রাত নামাজ পড়ে ভোর রাতে বাড়ি ফিরে যেত। মাঝে মাঝে এত বেশি মেয়েরা আসতো যে আমাদের অতো বড় উসরাই একবারে নামাজ পড়া যেত না। তখন মা কয়েকবারে নামাজ পড়াতেন।

        আবার এদিকে আমাদের বাড়ির পাশের মসজিদে সারা রাত ধরে মিলাদ মেহফিল চলত। কখনো কখনো সেই মিলাদ আমাদের বাড়ির সামনে যে বিশাল ফাঁকা পানগা ছিল সেই পানগাতে চাঁদুয়া টেঙ্গে হ্যাঁচাক জ্বালিয়ে মিলাদ করত। সেই সব দিনগুলিতে পাড়ার ছেলে মেয়েরা কতই না আনন্দ করত!

        ও বলল, মিলাদ আবার কি?

        আমি বললাম, মিলাদ হচ্ছে একটি ধর্মীয় উৎসব। এরকমই ঘটনা ঘটত রমজান মাসে শবে কদরের রাত এলেই। বড় হয়েও মনের স্মৃতির সোনালি পথ ধরে এক ছুটে সেই ছেলেবেলায় চলে যেতাম। কতই না সুন্দর, সুমধুর ছিল সেই রাতগুলি! আজও ভুলতে পারিনি। আজও খুঁজে ফিরি স্নিগ্ধ, শান্তিময়, আনন্দধারায় মুখরিত সেই পেলব রজনীগুলি। ধর্মের মধুর উদ্দীপনায় জেগে থাকতো সারা পাড়া। তার মধ্যে আমাদের বাড়ির তো তুলনাই ছিল না।

আমি তখন ক্লাস ফাইবে। নতুন বাড়িতে এলাম। বড়ো বড়ো দুটি মাটির ঘার। তার সামনে মস্ত উসরা। এই রাতগুলি এলে, বিশেষ করে শবে কদরের সাতাশ আর ঊনত্রিশের রাত এলে পাড়ার প্রায় সমস্ত মেয়েগুলো রাত জেগে নামাজ পড়ার জন্যও আমাদের বাড়িতে এসে জমায়েত হত। কারণ একটায়, সেই সময় পাড়ার মধ্যে ধর্মীয় ও বাংলা শিক্ষায় আমার মায়ের সমতুল্য কেউ ছিলেন না। তাছাড়া আমার মা কোরান শরীফের অনেকটাই মুখস্ত করে রেখেছিলেন। যাকে বলা হয় হাফ হাফেজ। যারা কোরান শরিফকে মুখস্ত করে রাখে তাদেরকে ‘হাফেজ’ বলা হয়। সেই সুবাদেই পাড়ার মেয়েরা মায়ের কাছে নামাজ পড়তে আসত। পাড়ার মেয়ে বলতে অধিকাংশ বৃদ্ধ মহিলারা ছিলেন আমার সম্পর্কে দাদি বা নানি আর মধ্য বয়সি মেয়েরা ছিলেন সম্পর্কে মামি অথবা কাকি।

তখনই জেনেছিলাম, ওই রাতের তাৎপর্যয়ই আলাদা। ওই রাতে এবাদত করলে হাজার বছরের এবাদতের চেয়ে বেশি নেইকি পাওয়া যায়। আর এই নেইকি পাওয়ার আশায় সকল মা ও দাদি, নানিরা সারা রাত জেগে কোরান তেলোয়াত, নামাজ আর তসবি পাঠ করতেন। এমন কি অনেকে মোনাজাত করার সময় হাওমাও করে কেঁদে উঠতেন। মাঝে মাঝে মনে হত এদের তপস্যায় যেন ফেরেস্তারা সব আমাদের বাড়িতে নেমে এসে সকল মেয়েদের প্রার্থনারত হাতে উজার করে নেইকি ঢালছে।

তবে কেবলই আমাদের বাড়ি নয়, যেহেতু আমাদের বাড়ির একদম পাশেই মসজিদ ছিল, সেখানেও পাড়ার লোকেরা এসে মসজিদকে ইবাদতের আনন্দধারায় মুখরিত করে তুলত। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের বাড়িতে যেমন পাড়ার মেয়েদের আগমনে ভর্তি হয়ে পড়ত; তেমনি আমাদের বাড়ির বাইরের চত্তর আর মসজিদের আশপাশ সহ ভিতরের অংশে উপাসনার গুঞ্জনে কল্লোলিত হয়ে থাকত। মসজিদের ছাদে উঠে আমরা ছোট ছোট ছেলেরা চারিপাশের কার্নিশে মোম্বাতি জ্বেলে দিতাম। একটু দূর থেকে মনে হত আকাশের তারাগুলি যেন মসজিদের ছাদে নেমে শান্তির আলোতে মসজিদ আর তার চারিপাশ ভরে দিচ্ছে। এই সব রাতগুলি পাওয়ার জন্য সারা বছর ধরে আমরা অপেক্ষায় থাকতাম। আর যেদিন জালসা হত সেদিনের আনন্দ আরো একটা নতুন মাত্রা পেত।  সেদিন তো আমাদের বাড়িতে পাড়ার মেয়েরা এতো বেশি জমায়েত হতো যে বাড়ির অঙ্গিনা পর্যন্ত ভরে থাকত। জালসা শোনার নেশায় তারা আসতেন। যেহেতু জনসাধারণের মধ্যে তারা বসতে পারতেন না; তাই তারা আমাদের বাড়িতে পুরুষদের আড়ালে থেকে জালসা শুনতেন। জালসার স্বেচ্ছাসেবকেরা মুড়ি, জিলাপি বা অন্যান্য খাবার আমাদের বাড়িতে অগত মহিলাদেরকে দিয়ে যেত। জালসার শেষে যখন কেয়ামের জন্য সকল শ্রোতাগণ মৌলবির সঙ্গে কেয়ামে দাঁড়াতেন; তখন দেখতাম আমার মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আগত সকল মহিলারাও দাঁড়িয়ে কিয়াম করতেন। কিয়ামের কথাগুলি আমাকে ভীষণ ভাল লাগত। “তুমি না এলে দুনিয়ায় আঁধারে ডুবিত সবই”-এই কথা আমার শিশু ও কিশোর মনে ভীষণ নাড়া দিত। তারপর সেহেরি রান্নার সময় হলে সেই রাতে যে যার বাড়ি চলে যেতেন। সেই সব রাতগুলো ছিল এক অনাবিল আনন্দময় রজনী।  

   আমি যখন মাধ্যমিক পাশ করার পরে ইলেভেন-এ কলেজে ভর্তি হলাম; তখন আমাদের বাড়িতে আর একটা ঘর, বারান্দা ও বৈঠকখানা সংযোজিত হল। এর ফলে যেদিনই এই সবে কদরের রাত আসতো সেদিনই পাড়ার মেয়েদের আগমনে আমার ঘরও ভর্তি হয়ে যেত। সেই রাতে আমার আর ঘুম পাড়া হত না। যদিও মাঝে মাঝে ওই ঘরের একদিকে চকির উপরে আমি শুয়ে থাকতাম, তখন মামী, কাকি, নানী, দাদিরা এসে ঘরের ফাঁকা অংশে আর ওই ঘরের বারান্দায় নামাজ পড়তেন। কখনো কখনো মামাতো আর চাস্ত বোনেরা এলে আমার আর শুয়ে থাকা হত না। তারা তাদের আদুরে জ্বালাতনে আমাকে বিছানা থেকে তুলে ঘর থেকে বের করে আমার বিছানার দখল নিত। আমিও স্বেচ্ছায় তাদেরকে আমার বিছানা ছেড়ে দিয়ে পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে বাইরে ঘুরে বেড়াতাম। যদিও আমি তেমন নামাজ পড়তাম না, তবুও মনে হতো সেই সব নির্মল রাতগুলি যেন শান্তি আর বরকতের উচ্ছ্বাসময় শুভ্র নেইকির পরশে আমাদের বাড়ি আর আমার ঘরখানি ভরিয়ে দিচ্ছে।

তারপরেও কত সবে কদরের রাত এসেছে, এখনও আসে আর ভবিষ্যতেও আসবে; কিন্তু ছোট্টবেলায় দেখা সেই ধর্মীয় জৌলস আর কোথাও দেখতে পাই না আর যতটুকু দেখি তা মেকি, অনুদার আর অগভীর সম্পর্ক মিশ্রিত ধর্ম পালন। আমার আরও মনে হয় সেই সব মেয়েদের সাথে সাথে শবে কদরের যে ফজিলত তা কালের অদৃশ্য স্রোতে হারিয়ে গেছে। আমিও যেন সেই বাড়ি ছেড়ে কোন এক অন্ধকার অসীম প্রান্তরে হারিয়ে গেছিলাম অনন্তকালের জন্যে।

আমার কথাগুলি আলবেলা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। বলল, তোমার ছোট বেলার সেই দিনগুলি খুব সুন্দর ছিল, খুব সোনালী ছিল, তাই না? তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি যদি সেই দিনগুলিন পেতাম, তাহলে কতই ভাল হত! আমি ধন্য হয়ে যেতাম।

আমি বললাম, কেন তোমার ছোট বেলার কোন কাহিনী নেই?

না।

মানে?

ও সব ছাড় তো। তোমার গল্প মানেই তো আমার গল্প। তাই না?

আমি হাসলাম। বললাম, তা কি করে হয়?

আলবেলা বলল, ঘুমিয়ে পড়। পরে আবার শুনব।

আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বললাম, সেটিই ভাল হবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post