ভেংচি/ইসমাত রিজুয়ানা


ছোট গল্প

ভেংচি  

ইসমাত রিজুয়ানা 


জীবনে প্রথমবার একটি মেয়ের মুখ ভেংচি পছন্দ হয়েছিল নীলুর। তখন সবে মাত্র নীলুর স্কুল জীবনের সমাপ্তি হয়েছে। বন্ধুদের নিয়ে টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ানোতে ও  যে একটা খুব মজা আছে সেই নতুন অনুভূতিটা সে এখন তরিয়ে তরিয়ে উপভোগ করছে। প্রতিদিন বিকেলে ঘুরতে বের হওয়া। পাশের এলাকায় গিয়ে ফল চুরি করে খাওয়া। চুপি চুপি মেয়েদের দিকে তাকানো। এই সবই যেন এখন  নিত্যদিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে উঠেছে। 

একদিন নীলুর  সব বন্ধুরা মাঠে ক্রিকেট খেলতে চলে গেছে। নীলু  যায়নি। আজ ওর খেলতে ইচ্ছে করছে না। নীলু তাই কাছাকাছি এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে ফাঁকা মাঠটার দিকে চলে এল। শীতের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ মাঠের উপর অলস ভাবে শুয়ে আছে । ওর  সঙ্গে রয়েছে চারটে সিগারেট , দেশলাইয়ের কাঠি আর দেশলাইয়ের বারুদ মাখানো কাগজের কিছু অংশ। নতুন সিগারেট খেতে শিখছে। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ও সিগারেটের প্যাকেট অথবা দেশলাই পকেটে রাখতো না। এতে শার্ট বা প্যান্টের পকেট ফুলে থাকত না। 

মুখ দিয়ে টেনে যে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করতে পারত তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো নীলু। নিজে চেষ্টা করতে গিয়ে বহুবার যক্ষা রোগীর মতো কাশতে কাশতে দম বার হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।

নীলু ক্ষেতের আলে মিষ্টি রোদে এসে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি মেয়ে ওর দিকেই আসছে। সাথে একটি ছাগল। ছাগলটা আসতে চাইছে না, মেয়েটা তাকে জোর করে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ছাগলও একটু এগোয় আবার আবার জোর করে দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েটি হুস হুস করে তাড়া দিচ্ছে, আর দড়ি টানছে। ব্যাপারটা খুব মজার । কিন্তু ছাগলটার করুণ অবস্থা দেখে বড্ড মায়া হচ্ছে নীলুর। তাই সে আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলল 

-ছাগলটাকে তো মেরেই ফেলবে দেখছি। আসতে না চাইলে জোর করে টানার কী দরকার?

ছাগলের দড়ি হাতে মেয়েটি নীলুর দিকে তাকিয়ে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে আবার দড়ি ধরে টান দিয়ে বলল, "আয় বলছি"।

নীলু হৃৎপিণ্ডটা যেন কিছু সময়ের জন্য হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষের মুখ ভেংচি দেখলে রাগ হয়। অথচ এই মেয়েটির মুখ ভেংচি এত ভালো লাগল কেন? আবার ইচ্ছে করছে ওই মুখ ভেংচি দেখার জন্য। ভাবলো আবার কিছু একটা বলে যাতে মেয়েটা ওইরকম মুখ ভেংচি দেয়! কিন্তু সে তো মেয়েটার নামই জানে না !

,-এই যে ছাগলওয়ালী, ছাগলটাকে আর কষ্ট দিও না।

-কী? কী বললে? আমি  ছাগলওয়ালী ?

হাত থেকে দড়ি ফেলে দিয়ে ওড়নাটাকে ঘুরিয়ে কোমরে  পেঁচিয়ে দুই হাত কোমরের  দুই পাশে রেখে অপূর্ব ভঙ্গিতে কথাটা বলল মেয়েটি। মেয়েটির রণংদেহি মূর্তি দেখে নীলু যেন একটু ঘাবড়ে  গেল । তবে মুখ ভেংচি দেখতে গিয়ে তো আর এক অপরূপ  ভঙ্গিতে মেয়েটিকে দেখতে পাবে সেটা কিন্তু নীলু কল্পনা ও করেনি । সত্যি-ই, কিছু কিছু মেয়েকে  রাগলে অসাধারণ সুন্দর লাগে। 

নীলু এবার মেয়েটিকে  আরেকটু রাগানোর জন্য বললো,

- বাব্বা, এতো দেখছি "ধন্যি মেয়ে"র  জয়া ভাদুড়ী!

এবার মেয়েটা কিন্তু  রাগলো না । মুচকি হেসে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। মেয়েদের মন বোঝা সতিই অসম্ভব! যখন রাগবার কথা তখন হাসবে, আর হাসার কথায় রাগবে । তবে নীলুর মনে হল এই মুচকি হাসিটাকেই মনে হয় মায়াবী হাসি বলে।

এরপর থেকে প্রতিদিনই নীলু একা একা ছাগলওয়ালীর খোঁজে ওই জায়গাটায় ছুটে যেত। বন্ধুদের  সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। উদ্দেশ্য হলো সেই ছাগলওয়ালী।

মেয়েটিকে নীলু প্রায়ই ওই জায়গায় দেখতে পেত । ওর মুখ ভেংচি আর রাগী চেহারা দেখার জন্য জন এটা ওটা বলতো। সেও রাগ করে কোমরে হাত রেখে নীলুকে দু এক কথা শুনিয়ে দিতো। 

নীলু ছাগলওয়ালীর প্রেমে পড়েছে কি-না জানে না। কিন্তু তার রাগী চেহারা আর মুখ ভেংচি দেখার জন্য প্রতিদিন ওই জায়গায় চলে আসে।

নীলু অনেকবার মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করেছে । কিন্তু মেয়েটি বলেনি । উত্তরে বলেছে, "প্রথমদিন যদি জানতে চাইতে তাহলে নিশ্চয় বলতাম। ছাগলওয়ালী বলে ডাকলে কেন ! যাও বলবো না আমার নাম।"

নীলু কখনো ছাগলওয়ালীর চোখে তার জন্য প্রেম দেখেনি। তার ভেংচি কিংবা মুচকি হাসি, রাগী চেহারা বা পিছন ফিরে তাকানোর মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পায়নি। তবুও সে এক কিসের অমোঘ টানে যেন ছুটে যেত ছাগলওয়ালীর কাছে।

একদিন ঘুম ভেঙ্গে বাইরে বের হয়ে অবাক হয়ে নীলু দেখে মেয়েটি ওদের বাড়ির বারান্দায় ওর বোন জয়ার সঙ্গে বসে আছে! নীলুর ঘুমের ঘোর তখনো ভালো করে কাটেনি। নীলু ভাবলো সে স্বপ্ন দেখছে না কি ? নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে না ঘটনাটা সত্যি। মেয়েটি সত্যি সত্যিই এসেছে ওদের বাড়িতে । তবে কি নীলুর নামে নালিশ করতে এসেছে? কই ছাগলওয়ালী বলে ডাকা ছাড়া সে তো বড়ো কোনো অপরাধ করেনি। আর সেই ডাক শুনে  মেয়েটি ও তো দুষ্টুমি করে মুখ ভেংচি  দিয়ে মুচকি হাসে! 

নীলুকে দেখে অবাক হয়ে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল - জয়া আমি এবার যাই।

জয়া অবাক হয়ে বলল, "কেন? চলে যাবি কেন? ওকে দেখে লজ্জা পাচ্ছিস কেন? ও তো আমার দাদা।

-হ্যাঁ চিনি, তোর দাদা আমাকে দেখলেই ছাগলওয়ালী বলে ডাকে।

জয়া আমার দিকে  অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল -  দাদা আমার বান্ধবীর নাম চৈতী। এত সুন্দর নাম রেখে ছাগলওয়ালী  বলে ডাকো কেন?

নীলু অন্য দিকে তাকিয়ে বললো - ছাগলওয়ালী তো আমাকে ওর নামটা আগে বলেনি।

চৈতীর সেই চির-চেনা রাগী চেহারা। সে এখুনি চলে যাবে এমন একটা ভাব। নীলু এবার নরম সুরে বললো - চৈতী এভাবে চলে যেও না। তুমি বসো আমিই বাইরে চলে যাচ্ছি! তোমাকে রাগাবো না আর কোনদিন।

সেদিন বিকেলেই নীলু জয়ার কাছ থেকে জানতে পারল চৈতীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বছরখানেক আগে থেকেই। 

সেদিন সারারাত নীলু দু চোখের পাতা এক করতে পারলো না। এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবতে লাগলো, গল্পটা কি একটু  অন্য রকম হতে পারত না। কিশোরি একটি মেয়ে। তার এখন ছুটে চলার বয়স। অথচ তার পায়ে অদৃশ্য শিকল লাগানো।গাছে আমের মুকুল এলে যেমন আম হবার আগেই বৈশাখী ঝড়ে অনেক মুকুল ঝরে পড়ে তেমনি নীলুর এক বুক স্বপ্ন অকাল ঝড়ে আমের মুকুলের মত আঁছড়ে পড়ল মাটিতে।

এর পরের দিনগুলো খুবই কষ্টে কাটতে লাগল নীলুর। সে রোজই যেত চৈতীদের বাড়ির কাছে। তবে তাকে আর রাগানোর চেষ্টা করত না। নীলুকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে চৈতী মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যেত। তখন নীলুর চোখ দুটো ভিজে উঠত। ঝাপসা চোখে চৈতীর চলে যাওয়া দেখতো। 

কিছু দিন পর চৈতীদের ছাগলটা বিক্রি হয়ে গেল। তবুও চৈতী আসত। ছাগল ছাড়াই আসত। নীলুকে একটিবার মুখ ভেংচি দিতে সে আসত। নীলুরই কেবল তাকে ছাগলওয়ালী বলে রাগানো হয়ে উঠতো  না আর । একদিন শুধু চৈতী তার ডাগর চোখদুটি তুলে বলেছিল, "আমাকে আর ছাগলওয়ালী বলে  ডাকবে না? জয়া যদি নাম না বলত তাহলে তো ঠিকই ডাকতে।

নীলু মনে মনে বললো , চৈতী, জয়া শুধু তোমার নামটাই জানায়নি। জানিয়েছে আমার কিশোর প্রেমের এখানেই সমাপ্তি ঘটাতে হবে।

চৈতীর বিয়েতে জয়াকে  নিমন্ত্রণ করেছিল, সাথে নীলুকেও। নীলু বা জয়া কেউই চৈতীর বিয়েতে যেতে পারেনি । জয়া হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছিল দাদার মনের অবস্থা।

নীলু জানে সে  "ছাগলওয়ালী"র সেই মুচকি হাসি, রাগী চেহারা বা মুখ ভেংচি কখনোই ভুলতে পারবে না । তাকে ফুল বা চিঠি কিছুই দেওয়া হয়নি। কখনো মুখ ফুটে ভালোবাসি ও বলা হয়নি। তবুও  নীলু উপলব্ধি  করতে পারে সে সতিই গভীর ভাবে চৈতির প্রেমে পড়েছিলো।  আচ্ছা চৈতী কি তার প্রেমে পড়েছিল? নাহলে ছাগল না থাকার পরও সে  কেন আসত? বিয়ের ক'দিন আগে কেন অমন ভাবে জিজ্ঞেস করেছিল ," আমাকে আর ছাগলওয়ালী বলে ডাকবে না?"

Post a Comment

Previous Post Next Post