ঝুঁজকি আলোর রেখা-৭/আজিজুল হাকিম

 


বিচিত্র ভোরবেলা   

 আজিজুল হাকিম 

পর্ব-৭

আলবেলা বলল, ঘুমিয়ে গেছিলে বুঝি?

আমি বললাম, না। ছোট বেলায় হারিয়ে গেছিলাম।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

পরে শুনছি তোমার ছোট বেলার কাহিনী। এখন উঠো খেয়ে নাও।

পাশের ঘরে আমরা গেলাম। ছোট্ট ডাইনিং টেবিল। টেবিলের উপরে কাঁচের পাটাতন। কাঁচের উপরে লতাপাতা আর ফুলের সুন্দর নকশা। তার উপরে প্লেটে খাবার আর ফল সাজানো। টেবিলের দু-পাশে দুটি চেয়ার।

আমরা মুখমুখি বসলাম। ও আমাকে খাবার বেড়ে দিল। তারপর ও নিল। শুরু করলাম খেতে। খেতে খেতে সে বলল, তোমার সেই ছোট বেলার কাহিনী খুব ইন্টারেস্টিং, তাই না?

আমি বললাম, খুব ইন্টারেস্টিং কি না জানি না। তবে ওই দিনগুলি খুব মিস করি। হয়ত সকলের ছোট বেলাটাই খুব ইন্টারেস্টিং। তোমার ছোট বেলাটা কেমন ছিল?

আমার ছোট বেলা বলে কিছু নেই। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

তার মানে?

সে সব পরে হবে। আগে খেয়ে নাও। তোমার গল্প আগে শুনবো। তোমার গল্প শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

আমি হেসে বললাম, তাই হবে।

খাবার শেষে হাত মুখ ধুয়ে এক রঙিন প্রত্যাশা নিয়ে আলবেলার পিছেপিছে বিছানায় গেলাম। মনের মাঝে আকুলি বিকুলি করছে সারা জীবনের এক অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের অনাবিল আনন্দের শিহরণ। মনে মনে কতদিন ওকে চেয়েছি। যেদিন স্বপ্নে ওকে দেখেছিলাম সেদিনের পর থেকে ওর শুভ্র অনাবিল হাসি, প্রসন্নমুখ, অবিন্যস্ত চুল, অনিন্দ্য সুন্দর শারীরিক গড়ন, অপার্থিব মাধুর্যে পরিপূর্ণ মুখের ফিগার হৃদয়ের মাঝে আমি সর্বদা বয়ে নিয়ে বেড়াতাম। আমার মনটাকে পুরো অধিকার করে নিয়ে ছিল।

আমি ওকে বাস্তব পৃথিবীতে, আমার জীবন পথে ভীষণভাবে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে ও বড় দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছিল। ওরকম মেয়ে দেখলেই থমকে দাঁড়াতাম। জন অরন্যের মাঝেও নির্লজ্জের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। কম্পেয়ার করতাম এই আলবেলার সঙ্গে। কিন্তু নিরাশ হয়ে পড়তাম – এ তো আমার সেই আলবেলা নয়!

আমি যখন একাই ঘুরে বেড়াতাম তখন একটি গান গায়তাম—

“এই এই মেয়েটি তুমি এসো গো কাছে

আমাকে ভালোবেসে

আর কত কাল থাকবে তুমি ওভাবে বসে বসে একাকি।

 

মুখটি লুকিয়ে আর থেকো না এসো আমার কাছে

স্বপ্নের মালাগুলি সরিয়ে এসো বাস্তবে আমার বুকে

এসো………… এসো………………বলছি………

নয় তো দেখবে, কোন নোংরা মেয়ের পিছুনে ছুটছি।”

 বাস্তবে তাই হয়েছিল হয়তো। থাক সে কথা। আজ তো ওকে পেয়েছি। ওকে নিয়ে জীবনের যত খায়েশ আজ তো পূর্ণ হতে চলেছে।

আমরা বিছানায় পাশ ফিরে শুলাম। পরস্পরের মুখোমুখি। আমি ওর দিকে হাত বাড়ালাম। ও হাতটি ধরে আমার দিকে সরিয়ে দিল। বলল - অত পাগল হলে চলবে? এতো উতলা কেন? ধর্য্য ধরো, প্লীজ। আমি তো আর হারিয়ে যাচ্ছি না। আমি তোমারই আছি আর তোমারই থাকব। আজ হবে না। আজ আমরা সারা রাত জেগে থাকব। আজ তোমার গল্প শুনবো। শুরু কর।

আমি বললাম, কেবলই গল্প?

হ্যাঁ, কেবল তোমার গল্প। আর কিচ্ছু না। শুরু করো।

আমি বাধ্য হয়ে শুরু করলাম। প্রথমে খরা ও বৃষ্টির ঘটনাগুলি বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম।

আলবেলা বলল, তারপর?

আমি আবার শুরু করলাম। নানী বলেছিল, তুই যখন এই দুনিয়ায় আস্যাছিলি এই টুকি পুঁচকি ছেল্যা। মাঘ মাসের ঝুঝকি ভোর রাত। ভরা শীত। তখন পাড়ার সব বাড়ি থাক্যা ভাস্যা আসছে ভোরের মোরগের বাগ। কডা পাখি বেভোর হয়ে গাছে গাছে, ডালে ডালে কিচিরমিচির করে চিৎকার করে উঠল। মনে হচ্ছে তোর আসার খবর পাড়ায় পাড়ায় রটিয়্যা দিচ্ছে। বাড়ির পাঞ্জরকার মসজিদে আজানের মধুর আওয়াজ; ঠিক এমন সময় তুই ভূমিষ্ঠ হলি।

আমার নাম রাখলেন এক পীর সাহেব; যিনি আশে পাশের প্রায় পঞ্চাশটা গ্রামের মাঝখানে আমাদের গ্রামের পাশে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার বাবা মা ছিলেন ওই পীর সাহেবের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী। আব্বা-মাকে ওই পীর সাহেব নাকি বলেছিলেন, তোদের এই সন্তান মস্ত বড় হবে। তোদের মুখ উজ্জ্বল করবে।

আমি সকলের আদরে বড় হতে শুরু করলাম। পাঁচ বছর বয়স থেকে চাস্ত দাদী যাকে আমি নানী বলতাম। নানী বলতাম এই কারণে যে তিনি ছিলেন আমার আপন নানার আপন বোন।

নানী আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। যেখানে যেতেন আমাকে সঙ্গে করেই যেতেন। একদিন পদ্মার ধারে টিকলিচর নামে একটি গ্রামে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে রাত্রি কাটানোর পর ভোর বেলায় গেলাম পদ্মা দেখতে। কত বড় একটি নদী। হালকা কুয়াশায় আচ্ছাদিত ওপারের গ্রামগুলি নাকি বাংলাদেশ। সেদিনই জেনেছিলাম দেশও নাকি আলাদা আলাদা হয়। তাদের নামগুলিও আলাদা আলাদা। যেমন গ্রামের আলাদা আলাদা নাম হয়, তেমনি। সেদিনই প্রথম দেখলাম, নদী পাড় ভাঙ্গে। পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভয়ঙ্কর খাঁড়ি তৈরি করেছে। অনেক জায়গা এখন ফেটে ফেটে আছে। সেই সব ফাটলও ভয়ঙ্কর। দূর্বাঘাসগুলি ফাটলের উপর দিয়ে পরস্পরকে টানাটানি করছে। ভীষণ মায়ার বাঁধন। তবুও পারে না। এক বিঘা দু-বিঘা করে জমির প্লট একসঙ্গে গিলে খায় এই পদ্মা। ওটা নাকি বেশ বড় মাঠ ছিল। সব ভেঙ্গে পদ্মার তলায় তলিয়ে গেছে। জেলেরা নৌকাতে করে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। সারারাত নাকি ওরা মাছ ধরে। সাঁঝের পরে লণ্ঠন নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। সারারাত মাছ ধরে তারপর ফিরে আসে।

তখন অবশ্য কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। ইচ্ছে করলেই এপারের লোক ওপারে আর ওপারের লোক এপারে যাতায়াত করতে পারত। এখন পারে না। কারণ ওই পদ্মা এখন নিষিদ্ধ নদী।

ওই ছোট বেলায় দেখতাম, এ বাড়ি, ও বাড়ি, সে বাড়িতে একদিন একদিন করে মিলাদ হতো। সেদিন খুব ভাল লাগত। মাইকে সুন্দর করে গজল গায়ত। মিলাদের শেষে যখন সকলে এক সঙ্গে কিয়াম করতো তখন মনের মধ্যে একটি রোমাঞ্চকর অনুভূতি আসত। এছাড়া দেখতাম, আব্বা, মাও গজল গায়ত।

সেই ছোট বেলাতেই একদিন রাতে নানীকে বললাম, আমার একটা গজল মুখস্ত হয়ে গেছে।

নানী বললেন, বোল দেখি।

আমি শুরু করলাম,

“কোন পাষাণরে মারলিরে পাথর, নূর নবীজির খুন বয়ে যায়

শের শরীফে মারলিরে পাথর – কাঁদেনও আসমান জমিনও হায় হায়

কান্দিয়া বলেন আমিরও হামজায়, কহো ভাতিজা কহোরে আমায়

কে মারিল এমনি জোরে, পাথরও উঠাইয়ে তোমারো মাথায়

দাও বলে দাও ভাতিজা আমায় নাম নিশান তার রাখব না রে

বংশকে তার করিয়া ধ্বংস ঘরবাড়ি তার দেবো গো উড়াইয়ে।”

নানী শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন। তুই আরো বড় হবি।

এদিকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাকে আব্বার কাছে পড়তে বসতে হতো। পড়ার শেষে মায়ের সঙ্গে আমাকে প্রার্থনা করতে হতো। মা বলতেন, আমার সঙ্গে সঙ্গে বল, আল্লাহ, আমাকে তোমার প্রিয় বান্দা বানাও। আমাকে সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলো। আমাকে মহান করো। আমি যেন বড় হতে পারি, মাওলা,  আমার জন্য তৌফিক দান কর।

প্রতি রাতে মায়ের সঙ্গে এসব কথাগুলি বারবার আবৃত্তি করতে হতো।

আলবেলা বলল, বাহ! ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার সুন্দর প্রার্থনা। যাহোক, তারপর বল।

ওই সময় এক দিন স্কুল গেলাম। তখনও কোন শিক্ষক আসেননি। কোন এক কারণে আমার পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে ঝামেলা লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত মারপিট। যদিও আমার থেকে ও তিন চার বছরের বড়। ও তখন টু-এ। ও আমাকে স্কুলের মেঝেতে ফেলে আমার বুকে বসে মারছেন। এমন সময় হেড মাস্টারের আবির্ভাব। উনি ওকে কিছু বললেন না। ঘরে গিয়ে কঞ্চির ছড়ি নিয়ে এসে আমাকে মারতে শুরু করলেন। সে কি নির্মম, নিষ্ঠুর ছড়ির কশাঘাত! আমি আঘাতের যন্ত্রণায় যতই চিৎকার করে কান্না করছি উনি ততই জোরে জোরে মেরে যাচ্ছেন। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আমি যেদিকে ঘুরছি, সেদিকেই উনি মেরে যাচ্ছেন। সহ্য করতে না পেরে আমি মেঝেয় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম; তবুও উনার ছড়ি চলতে লাগলেন। মেরে মেরে আমার সারা পিঠে, হাতে, পায়ে কালশিটে ফেলে দিলেন। পিঠের কয়েক জায়গা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। তখন রক্ত দেখে উনি আর মারলেন না। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে কান্না করতে করতে আমি বাড়ি ফিরে এলাম।

আলবেলা অবাক হয়ে বলল, একটি শিশু ছেলেকে এতো মার মারা হল! উনি এতো নিষ্ঠুর মাস্টার ছিলেন!  ভাবতেও অবাক লাগে।

আমি বললাম, কেবল স্কুল জীবনের প্রথম দিনটি সারা জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে রইল।

(চলবে) 

Post a Comment

Previous Post Next Post