চৌদ্দ-পোয়া
রাহুল পারভেজ
শেষ পর্ব
নূরনেহার
চলে যেতেই জেকের আলী কাঁঠালগুলো বস্তায় ভরতে থাকে। হঠাৎ বিলাত মন্ডলের পাঁচ
ব্যাটারি বিলাতি টর্চের আলোয় দু'চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হাজির ছেলেরা তখন পান্ঠি হাতে
জেকেরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু-তিন ঘা পড়তেই বিলাত মন্ডল পান্ঠিটা কেড়ে নিয়ে বলে--মারছিস
ক্যানে? চল ওকে নিয়ে চল বৈঠকখানা।
তাকে
টেনে-হিঁচড়ে তারা নিয়ে যায়। হাজি বলেন, এই মাঝ রাইতে একদম গোল-গাভড়া করিস ন্যা।
সকাল বেলা মুড়ল-মাতব্বরগণ যা করার করবে।
বিলাত
মহাজন বৈঠক ঘরে ঘুমিয়ে গেলে তার ডানপিটে ছেলেরা লাচ-পালাঙের পূবের দিকের নিমগাছে তাকে
দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। একজন চৌকিদার কে ডাকতে যায়।
বাতাসের
আগে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সকাল হতে না হতে আবাল-বৃদ্ধা-বনিতার ভীড়ে নাচ-পালাঙ
ভরে যায়।
মোড়ল-মাতুব্বরগণ
হাজির হলে এনায়েত আলী মন্ডলের সভাপতিত্বে সালিশ শুরু হয়। নিয়ম মাফিক বাদী বিবাদীকে
নানান পুছপাছ শেষে জুরীগণের মাথা মুকসুদ মহাজন জেকেরালীর দশ মিনিটের ‘চোদ্দ-পোয়া’র
সাজা ঘোষণা করেন।
এই
শাস্তির প্রয়োগ ঘটে দোষ প্রমাণের পর। দোষীকে দুই পা ফাঁক
করে দাঁড়াতে হয়। হাত দু’টো থাকে সোজা পায়ের সমান্তরাল। তারপর দুই তালুতে দু’খানা
প্রমাণাকৃতির ইঁট চাপানো হয়।যার মোট ওজন সাড়ে তিন সের। পোয়ায় বললে চৌদ্দ-পোয়া।
তাই গাঁ-গঞ্জে এই শাস্তির নামও চোদ্দ-পোয়া।
জেকের
আলীর এই সাজার বাস্তবায়ন ঘটাতে চৌকিদার ফজলে হক এগিয়ে যায়। যথাযথ ভঙ্গীতে দাঁড় শেষ হলে
সভাপতি এনায়েত আলী তাঁর পকেট ঘড়ি হাতে নেন। ইঙ্গিত মাত্র চৌকিদার দু’টো ইঁট দুই হাতে
চাপিয়ে দেয়।
সময়
এগোতে থাকে। পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হতেই জেকেরালীর হাত দু’টো থর থর করে কাঁপতে থাকে।
গলা থেকে চরম কষ্টের কাৎরানি বেরিয়ে আসে। বগলের রগগুলো যেন ছিঁড়ে যাবে। আরো পাঁচ
মিনিট বাকি!
হঠাৎ
বিলাত মহাজন ছুটে গিয়ে জেকেরালীর হাত থেকে ইঁটগুলো নামিয়ে দিয়ে বললেন--সাজা দিতে
গিয়ে আমি এই বুড়াহ বয়সে মার্ডার কেসের আসামি হতে পারব না।
জেকের মাটিতে ধপ
করে বসে পড়ে।পানি পানি করে গোঙাতে থাকে। ভীড় থেকে লালবানু এক লোটা পানি নিয়ে ছুটে
আসে। কিছুটা খাওয়ায়। কিছুটা চোখে মুখে ছিটিয়ে মাথায় ঢালতে থাকে।
জেকের
একটু থিতু হয়।কষ্ট হলেও উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনাদের সাজা আমি পূরণ কত্তে পারি নি।
বিশ্বাস করে, আমার শরীলে আর কুনু শক্তি ছিল না।
হঠাৎ
তার ভিতর থেকে এক প্রবল আবেগ ঘন আবেদন সালিশের জুরীগণের সামনে বলতে থাকে-- আমি বিলাত
মহাজনের বাড়িতে পাঁচ বছর পেট ভাত্তা ছিনু। পাঁচ বছর কিষাণগিরি কোরেছি। বানের পানিতে
ডুব দিয্যা চরের মাঠের ডুবা ধান কাইটা দিয়্যাছি। জমিতে হাল বহেছি। গাছের আম কাঁঠাল
হাট-বাজারে বিক্রি কইরা দিয়্যাছি। তার বদলে আইজ আপনারা এমন জানেমারা পুরস্কার দিলেন
কি কইরা?
কত
পাকা কাঁঠাল তো মাটিতে পইড়্যা থাকে। শিয়াল -কুকুরেও খাই না! আর চাইট্ট্যা কাঁঠালের
জন্যে ঐ হাজির ব্যাটারা আমার পিঠে পান্ঠি মাল্ল্য! অদের তিন ভাইকে কত কোলে পিঠে বহেছি।
ওরা আমাকে গাছের সঙ্গে বাইন্ধ্যা রাইখলো! আর এই যে এই গেরামের যত মহাজন আছেন তারা কত মানুষকে সুদের টাকার নামে
পথের ফকির বানালছে তার বিচার কি আপনারা কত্তে পারবেন?
জেকের
আলী যেন থামতেই চাই না। জুরিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে--আপনারা আমার শেষ কথাডা একটু
শুনেন। আমি ঘোষণা দিছি আজ থাইকা আমি কাউরি বাড়ি কুনু কাজে আর যাব না। বাঁইচা থাকা
পর্যন্ত কাউরি কাঠ-ফাড়াইও করব না।
বিলাত
মন্ডল কিছু বলতে যান। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সালিশের মধ্যেও
নেমে আসে এক আকষ্মিক নীরবতা।
আবেগাহত
জেকের আবার টালমাটাল হয়ে পড়ে। লালবানু তার হাতটা ধরে ফেলে এবং এগিয়ে যায় তাদের
ঝড়ে ভাঙ্গা বাড়ির দিকে।
-
সমাপ্ত -