পরিবর্তনের স্রোতধারা
আমি
আবার শুরু করলামঃ সময় যেমন দাঁড়িয়ে থাকেনা, সূর্য তেমন আকাশের এক জায়গায় স্থিরও থাকে
না, চাঁদ যেমন ক্ষয়ে যায় আবার পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলে, নদীর জল যেমন প্রবাহিত হয় নিত্যবেলা;
তেমনি প্রয়োজনের তাগিদে অনবরত ঘুরেই চলে প্রগতির চাকা। সেই চাকায় কেউ পিষ্ট হয় আবার কেউ উন্নতির
শিখরে উঠে যায় অবিরত।
এছাড়া
যখনই মানুষের কাছে প্রকৃতির অভিশাপ নেমে এসেছে, নেমে এসেছে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা, মানুষের
সামনে দাঁড়িয়েছে প্রাকৃতিক সমস্যা; তখনই সেই অভিশাপ, নিষ্ঠুরতা, সমস্যা থেকে উদ্ধার
হওয়ার জন্যে মানুষ পেয়েছে নতুন পথের দিশা। পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তন করেছে লড়াই করে
বেঁচে থাকার পন্থা।
ঠিক
একইভাবে খরার বছরের পরের বছরই কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের সহায়তায় গ্রামে ঢুকে পড়ল ডিজেল
চালিত পাম্প ইঞ্জিন। মাঠে মাঠে পুঁতা হল স্যালো-পাইপ।
যখন
প্রথম পাম্প ইঞ্জিন স্টার্ট করা হল, তখন অনেক লোকই ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জনে সেখান থেকে
পালিয়ে গেল; হয়ত মেশিন বার্স্ট হয়ে মারা যেতে পারে। কিন্তু তা হল না। ধীরে ধীরে মানুষের
মনের ভয় ভাঙ্গল। বুক ভরা সাহস নিয়ে ফিরে সেই এলো সেই মেশিনের কাছে।
আমরাও
পাম্প ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জনকে উপেক্ষা করে ওর আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম।
আব্বাকেও
একটি মেশিন চালাতে দেওয়া হল। আমাদেরই দুটি জমিতে দুটি স্যালো বসানো হল। লোকের কাছে
টাকা নিয়ে লোকের জমিতে জল দেওয়া শুরু হল। যারা মেশিন চালাবে তাদের প্রত্যেককে মেশিন
চালানোর জন্য মাসিক একটা বেতন ধার্য করা হল। ডিজেল থেকে শুরু করে মেসিনের সমস্ত খরচা
ব্যাঙ্ক জোগান দেবে। তার পরিবর্তে ব্যাংক লাভ্যাংশ নেবে। সে নিক। খরায় মানুষ না খেতে
পেয়ে তো আর মারা যাবে না। অন্তত পক্ষে মানুষ তো দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বাঁচবে। বারোমাস
মানুষ তো কাজ পাবে; যা এত দিন পাইনি। এর আগে তো বছরে মাত্র দু-তিন মাস কাজ থাকতো। সারা
বছর কোন কাজ থাকতো না। ফলে প্রায় বাড়িতে খাবারের অভাব, পোষাকের অভাব, কাজের অভাব লেগেই
থাকত। এখন তো আর সেটি হবে না।
মেশিন
চালানোর জন্য আব্বাকে প্রায় মাঠেই পড়ে থাকতে হল। কখনো কখনো সন্ধ্যায়ও খাবার খেতে আসতে
পারতেন না। ফলে যেদিন খাবার খেতে আসতে পারতেন না, সেদিন সাঁঝ বেলায় আমাকেই মাথায় খাবার
নিয়ে মাঠে যেতে হতো। খাবার নিয়ে গিয়ে আমি আর ফিরে আসতাম না। রাতের বেলায় পাটকাঠি বা
ত্রিপলের কুঁড়োতে রাত কাটাতাম।
ও
বলল, তখন তুমি কোন ক্লাসে পড়তে?
আমি
বললাম, তখন আমি ক্লাস টু-এ পড়ি। আমি বইও সঙ্গে করে যেতাম। লন্ঠনের আলোয় আব্বার কাছে
পড়তে বসতাম। আব্বা খুব সুন্দর করে পড়াতে পাড়তেন। ফলে খুব সহজেই সব কিছু বুঝতে পারতাম।
সেই সময় সমসাময়িক ছেলে মেয়েদের চেয়ে সাধারণ জ্ঞান আর শিক্ষার দিক দিয়ে আমি অনেকটাই
এগিয়ে গেলাম।
এক
রাতে ওই মাঠের মধ্যেই আমি মহাভারতের কোন একটি অংশ পড়ছিলাম। বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করার
জন্য আব্বা শুরু করলেন, “কুরু আর পাণ্ডু, এরা আপন দুই ভাই। কুরুর পুত্রদের কৌরব আর
পাণ্ডুর পুত্রদের পাণ্ডব বলা হয়। কৌরবরা একশ ভাই আর পাণ্ডবরা মাত্র পাঁচ ভাই। সিংহাসন
ও রাজত্ব পাওয়ার লোভে কৌরবরা পাণ্ডবদের হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন। কৌরবের পক্ষ থেকে
যুধিষ্ঠির পঞ্চপাণ্ডবদের জন্য এক সুন্দর, জাঁকজমকপূর্ণ জতুগৃহ তৈরি করলেন। সেই বাড়ি
এমনভাবে তৈরি করলেন যে সহজেই যেন আগুন লেগে যেতে সহায়ক হয়। সেই কারণে, বাঁশ, শন, মোম,
খড় ইত্যাদি দিয়ে সেই জতুগৃহ তৈরি করা হল।
এক
রাতে কুন্তী জাঁকজমক করে ওই ঘরেই অনুষ্ঠান করছিলেন। সেই রাতে যুধিষ্ঠিরের হুকুমে তার
সেনাপতি সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।
ঘরটি
পুড়ে ছাই হয়ে গেলে পরের দিন সকালে সেই ঘর থেকে পাঁচটি মাথার খুলি এনে কুরুকে পরীক্ষা
করতে দেওয়া হল। কুরু ছিলেন অন্ধ, মাথার খুলিকে টিপেটিপে দেখলেন। দীর্ঘক্ষণ পরখ করার
পর বললেন, এই মাথার খুলিগুলি পঞ্চ পাণ্ডবের নয়। অন্য কারো। পরে জানা গেল সেই অনুষ্ঠানে
মন্ত্রীর ছেলে আর এক মাহুতের মাথার খুলি ছিল। আর পাণ্ডবরা আগেই আগুন জ্বালানোর খবর
পেয়ে গিয়ে ছিল। সেই কারণে দূরে অবস্থিত নদীর ধার পর্যন্ত আগেই সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করে নিয়েছিল।
জতুগৃহে আগুন জ্বলে উঠলে সেই পথ দিয়ে ওরা পালিয়ে যায়।”
আব্বার
মুখে গল্পটি শুনতে শুনতে কল্পনার পাখায় চড়ে আমি সেই জতুগৃহে পৌঁছে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল
সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তখন হয়ত কল্পনাশক্তিও ছিল প্রখর।
আলবেলা
তখন চিত হয়ে শুয়ে আমার কথাগুলি শুনে যাচ্ছিল। এমন সময় ও মাথা ঘুরাল। স্মিত হেসে বলল,
মাঠে রাত কাটানোর আনন্দই আলাদা, তাই না?
আমি
বললাম, একদম ঠিক বলেছ। দারুণ রহস্যময় মনে হতো। বিশেষ করে শীত আর গ্রীষ্মকালেই আব্বার
সঙ্গে মাঠে থাকতাম। কোন কোন সময় পূর্ণিমার রাতে মাঠে থাকলে তার আনন্দই আলাদা ছিল। জ্যোৎস্নার
আলোয় সারা মাঠ ভরে উঠত। যেন রুপোলী পাতলা উর্ণায় সারা মাঠটি ঢেকে আছে। দূরের বাবলা
ঘাছগুলিকে দেখে মনে হতো যেন পাতলা সাদা কাপড় পরে বড় বড় ভূত দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা সঙ্গে
থাকার কারণে সে সব দেখে ভয় লাগত না। বেশ মজাই পেতাম। যদিও অনেক ভুতের গল্প তখন শুনতে
পেতাম। ডাকনি, চুরাচুন্নি, গোদানা, ভোলা আরো কত কি সেই সব ভুতগুলির নাম।
গ্রামে
কেউ অকালে মারা গেলে তখন ধরেই নেওয়া হতো তাকে কোন না কোন ভুতে ধরে মেরে দিয়েছে। পাড়ায়
কোন মেয়ের সন্তান হলে তার কাছে নাংল্যা বা কোন লোহা রাখা হতো। কেবল তাই না; চামড়ার
চটকিও রাখা হতো। তখন ধারণা ছিল এসব রাখলে ভুতপেত আসতে পারবে না। তবুও সন্তান প্রসূতির
সময়, প্রসূতির আগে অথবা সন্তান প্রসূতির পরে অনেক মেয়ে অকালে প্রাণ হারাত। সে সব মৃত্যুর
অন্যতম কারণ ছিল টিটিনাশ।
সেই
ছেলেবেলায় সেই সব রাতগুলি খুব ভাল লাগত। বিশেষ করে যেদিন রাসু কাকা গল্পের আসর বসাতেন।
রাত জ্যোৎস্না হলে তো কোন কথাই নেই। আর যদি জ্যোৎস্না না হতো সেদিন হ্যাচাক জ্বেলে
গল্পের আসর বসানো হতো।
সেই
সময় প্রত্যেক বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রাখা হতো। সেই ফাঁকা জায়গাকে আমরা গ্রামের
ভাষায় পানগা বা খল্যান বলতাম। কারণ মাঠে থেকে ফসল তুলে এনে এসব জায়গায় রাখা হতো।
সেই
পানগায় বিশেষ করে যারা পাড়ার মধ্যে বড়োলোক শ্রেণির মানুষ ছিলেন, তাদের বাড়ির সামনে
বসত এই গল্পের আসর। কারণ গল্প করতে রাত জাগার ব্যাপার আছে আর রাত জাগতে হলে চা-মুড়ির
ব্যপার আছে। সকলে সেই চা মুড়ি খাওয়াতে পারবে না। সেই সময় আমাদের দিকে চা মুড়ির প্রচলন
তেমন ছিল না। কোন অতিথি এলে দোকান থেকে চা বিস্কুট কিনে এনে খাওয়ানো হতো। আর যারা নিয়মিত
চা খেত তাদের জন্য স্কুল মোড়ে কেবল দুটি চায়ের দোকান ছিল। তাছাড়া অন্য কোন দোকান ছিল
না।
সেই
গল্পের আসরে রাসু কাকা বসতেন সকলের মধ্যে। সকলেই যেন উনাকে দেখতে পায় এবং উনার কথা
শুনতে পায় এমন জায়গায়। সেই গল্পের আসরে ছোট বড় মিলিয়ে পাড়ার পঞ্চাশ ষাট জন লোক জমা
হয়ে যেত। তিনি অধিকাংশ গল্প করতেন রূপকথা আর যাদু মন্ত্রের উপরে। অলৌকিক গল্পের প্রেক্ষাপটে
বাস্তবে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। উনার কাছে যে গল্প গুলি শুনে ছিলাম তাদের মধ্যে ‘আফাং
আর দুলাল’-এর গল্প। এই গল্পটি ছিল ভীষণ দুঃখের। এই গল্পটি হল এক সৎ মায়ের চক্রান্তে
দুই রাজপুত্রের বাড়ি থেকে বহিষ্কার হওয়া আর তাদের জীবন যুদ্ধের করুণ কাহিনী উল্লেখিত
হয়েছে। গল্পটি শুনতে শুনতে চোখে পানি চলে এসেছিল। আর একটি গল্প হল ‘এক ডাইনি আর এক
রাজকুমারের কাহিনী’।
আলবেলা
বলল, ডাইনির গল্পটি একটু বল, শুনি।
এই
গল্পের প্রেক্ষাপট হল, এক রাজকুমার এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য যাওয়ার পথে একটি ঘন জঙ্গলের
মধ্যে এক বুড়ি মা’র কুটিরে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নেয়। তখন বুড়ি মা’র ছয় ছেলে আর এক
মেয়ে কুটির ছেড়ে শিকারে দূরের জঙ্গলে গিয়েছিল। বুড়ির আশা এই রাজকুমারের কাছে যা আছে
সব কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে সকলে মিলে ওর রক্ত মাংস খেয়ে নেবে। কিন্তু বুড়ির বয়স হওয়ায়
সেই কাজ করতে পারে না। রাজকুমারকে বিভিন্ন গল্প শুনিয়ে, ভুলিয়ের ভালিয়ে ওর কুটিরে রাখার
চেষ্টা করে। কিন্তু চালাক ছেলে বুড়ির কথা বার্তায় কোন অশুভ সংকেত পায়। ঘোড়ায় চড়ে সেখান
থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু বুড়ি কিছু রায়ের দানায় যাদু মন্ত্র পড়ে একটি ছোট্ট ফুটো ন্যাকড়াতে
জড়িয়ে ঘোড়ার ল্যাজে বেঁধে দেয়।
বুড়ির
ছেলে মেয়ে বাড়ি ফিরে এলে তাদেরকে বেশ গালাগাল দেয়। তারপর বলে, এই পথ দিয়ে কিছুটা গেলেই
দেখবি রায়ের ফুল ফুটে আছে। সেই ফুল নিশানা ধরে গেলেই তোরা রাজকুমারকে ধরতে পারবি। তোদেরকে
খুব জোরে যেতে হবে। তা না হলে সামনে একটি গ্রাম আছে সেখানে ঢুকে গেলে আর ফিরিয়ে আনতে
পারবি না।
সেই
সাত ছেলে আর এক মেয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। ওরা যখন রাজপুত্রের ঠিক কাছাকাছি তখন সে গ্রামের
ভিতর ঢুকে পড়ে এবং গ্রামের মোড়লের কাছে আশ্রয়
প্রার্থনা করে। তখন ডাইনীর ছেলে মেয়ে বুদ্ধি খাটাতে শুরু করে কিভাবে রাজকুমারকে গ্রাম
থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ডাইনীর মেয়ে ছিল অপূর্ব সুন্দরী যুবতী। মেয়েটি গ্রামের
মোড়লের কাছে গিয়ে বলল, আমার স্বামী আমাকে আমার মায়ের বাড়িতে রেখে আপনাদের গ্রামে পালিয়ে
এসেছে। আমাকে ওর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না। আমার সঙ্গে প্রতারণা করে আমাকে বিয়ে করেছে। হয়
আমাকে নিয়ে আমার মায়ের বাড়িতে থাকতে হবে; তা না হলে আমাকে ওর বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।
মোড়ল
তখন রাজকুমারকে বলে, তুমি কি এই মেয়েকে বিয়ে করেছ?
রাজকুমার
বলল, না। আমি এই মেয়েকে চিনিই না। এর আগে ওকে কোনদিন দেখিনি।
মেয়েটি
বলল, দেখলেন, কত বড় মিথ্যাবাদী! আমাকে বিয়ে করল। আমার সাথে বাসর রাত কাটাল, আর এখন
বলছে ওকে আমি চিনি না!
মোড়ল
দেখল, কেশ বড় জটিল। তাই সে সত্য মিথ্যা যাচায় করার জন্য বলল, আজ রাতে তোমরা আমার বাড়িতেই
থাকো। কাল একটা মীমাংসা করা হবে।
আলবেলা
এক ঝলক হেসে বলল, দারুণ মজার গল্প তো! চালিয়ে যাও; খুব ভাল লাগছে।
আমি
বলতে লাগলাম, তারপর ওই মেয়েটি আর রাজকুমারকে মোড়ল বাড়ির ভিতরে একটি ঘরে রাখল। মেয়েটির
ভাইদেরকে বৈঠকখানায়।
রাত
গভীর হলে মেয়েটি ও ছেলেটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চুপিচুপি মোড়লকে ডাকল। মেয়েটি সব সত্য
কথা বলল। ছেলেটি বলল, যখন এই মেয়েটি আমার সঙ্গে জীবন কাটাতে চায়; তখন আমি ওকে বিয়ে
করতে রাজি আছি। মেয়েটিও বলল, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু সকাল হলে আমার ভাইয়েরা
আমাকে নিয়ে চলে যাবে। তাই রাতেই আমরা গোপনে এখান থেকে পালিয়ে যাব।
মোড়ল
বলল, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই গেল।
ওরা
দুজনে ওই গভীর রাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে পালিয়ে গেল। তারপর সকাল হলে ডাইনীর ছেলেরা ওদের
বোনকে গাল দিতে দিতে বাড়ি ফিরে গেল।
আলবেলা
বলল, তারপর?
আমি
বললাম, একটি ডাইনীর মেয়ে রাজরানী হয়ে গেল।
ও
বলল, ব্যাস, এখানেই শেষ?
আমি বললাম, আরও অনেক ঘটনা ছিল; কিন্তু মনে নেই। রাসু কাকা বেঁচে থাকলে গল্পটি আবারও শোনা যেত। কিন্তু রাসু কাকাই তো স্বর্গে চলে গেলেন!
(চলতে থাকবে)