চৌদ্দ-পোয়া-৪/রাহুল পারভেজ

 


গল্প

চৌদ্দ-পোয়া

রাহুল পারভেজ

পর্ব-৪

রাতে পাঁচমিশালী মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল জেকের। কিন্তু বড় বড় মাছগুলো বেছে নিয়ে ন্যায্য দামটা পর্যন্ত দিল না বিলাত মহাজন। ভিতরটা তার রাগে গর গর করছিল। এরকম ছ্যাচড়া মানুষদের একেবারেই সহ্য হয় না তার। 

ওসরার এক দিকে লালবানু নাক ডাকাচ্ছে। 

খড়ের চালার ছিদ্র দিয়ে চাঁদের আলোয় তার চোখ মুখ মাখামাখি। লালবানু খড়ের চালাটা মেরামত করতে বলেছিল। জেকেরের সময় হইনি। এখন তার মনে হয় ছ্যাদাগুলো থাকাই ভালো। চাঁদের আলায় লালবানুর মুখ খানা যেন পরীর মত দেখাচ্ছে।

রাত দুপুরের মোরগ ডাকে ঘুম ভাঙ্গে জেকের আলীর।

পুবের ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরটাও বেশ তরতাজা। কেবল বিলাত মন্ডলের বেয়াদবীটা মাথার মধ্যে খচ খচ করছে। আবার দিনের বেলা তার হাজারী গাছের পাকা কাঁঠালের গন্ধও তাকে টানতে থাকে।

একটা চটের বস্তা, দড়ি আর ছোট্ট হাঁসুয়া নিয়ে সে কাঁঠাল তলায় পৌঁছে যায়।

গাছে পা দিতেই হঠাৎ গোরস্থানের দিক থেকে ধপ ধপ শব্দে কি যেন গড়িয়ে এসে তার পায়ে ঠেকে। জেকের আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে দেখে একটি পাকা বেল। ওদিকে শুকনো পাতায় মচ মচ শব্দ তুলে কবরস্থানের দিক থেকে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে তার দিকেই। 

কাছে এসে হি হি করে হেসে উঠে বলে--

কি গো নাগর! ডরে কেঁইচা হয়্যা গেইল্যা নাকি? নুরনেহারের গলাটা একটুও চিনতে পাল্ল্যা না!

সেই ঝড়-বিষ্টির রাইতে আম কুড়্যাত্তে আইস্যা  বাজের গজ্জনে থর থরিয়ে আমাকে জাপটে ধরনি? সেদিন বাঁধা না দিলে কি হতক! বইল্যাছিলে, আমাকে ছাড়া দুনিয়ার অন্য কুনু মায়াকে বিহ্যা করবা না!

জেকের তখনও আতঙ্কে থর থর। তবু বাল্যকালের সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতটা মনে পড়তেই সাহস হয়।

--তুমি কি সত্যিই নুরনেহার? আমার তো দম যায় যায়! শুনো, বাপ দাদারা না দিলে আমার কি করার ছিল বল! দাদু বইল্যাছিল ঐ লাঠিবাজ গোয়াল বংশে পোতার বিহ্যা দিব না। দুনিয়ায় বিটি ছেইল্যার কুনু অভাব নাই। আর দাদি বইল্যাছিল, মদ্দানি মায়ার সাথে বিহ্যাডা কে দেয় দেখছি!

আর সত্যিই তো তুমি কি তখন আমহারে সাথে কাবাডি চিক্কা বর্ধন খাইটা খেলার উস্তাদ। লোকে তো মদ্দানিই বইল তো! আর সেজন্য তো বিহ্যাটা ভেস্ত্যা গেল!

--থাক..থাক..ডরপুক কুথাকার! আর গেল্লা কত্তে হবে না। তুমার সাথে বিহ্যা হয় নি তো আমি কি পইড়্যা ছিল্যাম! তুমি তো কালা পাহাড়! আমার বাড়িঅলা কুদ্দুস আলী তুমার চায়া মেলা সুন্দর ছিল। মেলা ফরসা ছিল।

কিন্তুক আমার কপাল খারাব। বিহ্যার ছ'মাস পরেই চোদ্দ রইষ্যার মাঠে বানে ডুবা ধান কাটতে গিয়া কাল খরিষের ছোবল খাইয়্যা চইল্যা গেল। আর আমি হল্যাম আঁড়ি।

ছাড়ো উসব কথা। দুপ্পহরে মুড়লের বাগানে দেখনু তুমি ইদিক উদিক তাকাছ্ ছো। তখন মুনটা বুলল, তুমি রাইতের বেলা বাগানখানে হামলাবা!

আমারও তো রাইতে নিদ হয় ন্যা। চাঁদের আলো দেইখ্যা হাঁটা দিলাম। যাক, যেইড্যা কত্তে আইস্যাছো সেইড্যা চটপট কইরা ফ্যাল। নাইলে বিলাত মুড়ল কখন লাঠি পাশলি নিয়্যা তাইড়া আসবে।

জেকের ধীরে ধীরে গাছের গুঁড়ি পেরিয়ে এ ডাল সে ডাল পরখ করে দু'টো পাকা কাঁঠাল দড়ি বেঁধে ধরিয়ে দেয়। পরে আধ-পাকা কিছু কাঁঠাল ফেলতে থাকে। বৃষ্টি ভেজা নরম মাটি। ধপ ধপ শব্দ হতেই দ্রুত নেমে আসে।

একটা পাকা কাঁঠাল নুরনেহারের হাতে দিয়ে বলে, তুমি এক্ষুনি এহান হতে চইল্যা যাও।

নাইলে আমি চুরি আর ফ্যালসানি দুইট্যা কেসের আসামি হয়্যা যাব। যাও যাও দৌড় লাগাও। 

Post a Comment

Previous Post Next Post