আফগান মোনালিসার কাহিনী/ইসমাত রিজুয়ানা

 


আফগান মোনালিসার কাহিনী

         ইসমাত রিজুয়ানা 


সাল ১৯৮৪ ,  ডিসেম্বর মাসের এক হিমেল সকাল। সূর্যের আলো এসে পড়েছে পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের প্রান্তে নাসির বেগ রিফিউজি ক্যাম্পে। রুক্ষ প্রান্তরে কয়েক হাজার তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার আফগান শরণার্থী। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্থান চলে গিয়েছিল রাশিয়ার দখলে। শুরু হয়েছিল  সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে আফগান মুজাহিদিনদের তুমুল লড়াই।  প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন আফগানিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষ।

সেই  রিফিউজি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন চিত্রগ্রাহক স্টিভ মার্কারি। হাতে ছিলো নিকন এফএম-টু ক্যামেরা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ছবি তুলতে এসেছিলেন তিনি।

নাসির বেগ রিফিউজি ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে হাঁটবার সময়, মার্কারির কানে এসেছিল কিছু বালিকার হাসি। একটি  তাঁবুর ভেতর বসেছিল তারা। মার্কারি ঢুকে পড়েছিলেন তাঁবুতে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিল বালিকাগুলি। পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল বারো তেরো বছরের একটি মেয়ে। মার্কারির দিকে মেয়েটি মুখ ফেরাতেই চমকে উঠেছিলেন মার্কারি। দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল ওর চোখে। এরকম ভয়ঙ্কর, এরকম সুন্দর চোখ তিনি এর আগে দেখেননি। অনুমতি নিয়ে মেয়েটির ছবি তুলেছিলেন মার্কারি। ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছিল মাথায় লাল ওড়না দেওয়া কিশোরীটি।  ঘৃণা, অসহায়তা, আক্রোশ ও আতঙ্ক ঝরে পড়ছিল সবুজ চোখ দুটি থেকে। তার হিমশীতল  চাউনি জানান দিচ্ছিল শরণার্থী হওয়ার ব্যাথা। বুঝিয়ে দিচ্ছিল আফগানিস্তানের ভয়াবহ পরিস্থিতি। ছবিটি তোলার পর, ক্যাম্পের আরও কিছু ছবি তুলে রিফিউজি ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মার্কারি। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও রিফিউজি ক্যাম্পগুলির ছবিগুলি মার্কারি পাঠিয়েছিলেন ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন পত্রিকায়। সেগুলির মধ্যে ছিল নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য টাইমস, প্যারিস ম্যাচ ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতো ম্যাগাজিনও। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল বালিকাটির ছবি। সঙ্গে ছাপা হয়েছিল আফগানিস্তানের যুদ্ধ এবং পাকিস্তানের রিফিউজি ক্যাম্প নিয়ে লেখা মার্কারির প্রতিবেদন। প্রকাশিত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ম্যাগাজিনটির সব কটি কপি। পাঠকদের অনুরোধে নতুন করে ছাপাতে হয়েছিল কয়েক লক্ষ কপি। সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমের হেডিংয়ে উঠে এসেছিল নামহীন বালিকাটি। পোস্টার, ক্যালেন্ডার, অনান্য পত্রিকার মাধ্যমে বালিকাটির ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের কোণে কোণে। 'আফগান গার্ল' নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল ছবিটি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলেছিল,'আফগান গার্ল' ছবিটি পত্রিকার ইতিহাসে সবথেকে বিখ্যাত ছবি। খ্যাতির দিক থেকে যার সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার। এরপর নামহীন 'আফগান গার্ল' সংবাদমাধ্যমের কাছে হয়ে গিয়েছিল 'আফগান মোনালিসা'। 

সতেরো বছর পরের কথা । আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পরে মার্কিন সেনারা ঢুকে পড়েছিল আফগানিস্তানে। একসময়ের বন্ধু তালিবান ও মুজাহিদিনদের সঙ্গে শুরু হয়েছিল তুমুল লড়াই। আফগানিস্তান চলে গিয়েছিল আমেরিকার দখলে।  সেই সময় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মনে পড়েছিল আফগান বালিকাটির কথা। আদৌ কি জীবিত আছে আফগান গার্ল? জীবিত থাকলে, কেমন আছে সে? কী রকম দেখতে হয়েছে  তাকে? আফগান গার্লকে খুঁজে বের করার জন্য পাকিস্তানে একটি দল পাঠিয়েছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানে আসা দলটিতে ছিলেন স্টিভ মার্কারিও। 

পেশোয়ারের নাসির বেগ রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়েছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিম। ক্যাম্পটি তখন বন্ধ হওয়ার মুখে। তখনও ক্যাম্পে বাস করা কিছু আফগান শরণার্থীদের দেখানো হয়েছিল বালিকাটির ছবি। এক আফগান বলেছিলেন, বালিকাটি এখন গৃহবধু। বাস করে কাছের এক গ্রামে। সেই গ্রামে গিয়ে মহিলাটিকে দেখেছিলেন মার্কারি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিমকে তিনি জানিয়েছিলেন, এই মহিলা 'আফগান গার্ল' নন। আরও অনেকে দিয়েছিলেন খোঁজ, কিন্তু সবকটি ক্ষেত্রেই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছিল মার্কারিদের। 

অনেক খুঁজেও আফগান গার্লের সন্ধান না পেয়ে দলটি যখন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তখনই এসেছিলেন বছর চল্লিশের এক পাশতুন।  থাকেন পাকিস্তানেই। ব্যাক্তিটি বলেছিলেন ছবির বালিকাটির সঙ্গে তিনি বড় হয়েছিলেন নাসির বেগ ক্যাম্পে। বহুবছর আগে সে চলে গিয়েছে আফগানিস্তানে। তবে আফগান গার্লের ঠিকানা তিনি জানেন। প্রয়োজনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিমকে তিনি সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন। 

সীমান্ত পেরিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিম গিয়েছিল আফগানিস্তানে। টিমটির গন্তব্য ছিলো পূর্ব আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তোরা-বোরা। সেখানকার এক গুহাতেই লুকিয়ে থাকতেন, আমেরিকার ত্রাস ওসামা বিন লাদেন। গা ছম ছমে পাহাড়ি পথে গাড়ি করে তিন ঘণ্টা যাওয়ার পর, আরও তিন ঘণ্টা ধরে পায়ে হেঁটে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিম পৌঁছেছিল এক হত দরিদ্র গ্রামে। তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণীর ঠিক নিচে থাকা গ্রামের প্রান্তে ছিল এক জরাজীর্ণ মাটির বাড়ি। বাড়িটির সামনে গিয়ে থেমেছিল দলটি। ঠিক তখনই আকাশি নীল বোরখা পরা এক মহিলা  বালতি নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। দলটির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বোরখা  দিয়ে ঢেকে নিয়েছিলেন মুখ। মার্কারি অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন 'আফগান মোনালিসা'। কেটে গিয়েছে ১৮ বছর, সময় ও দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি কেড়ে নিয়েছে যৌবন। চোখের তলায় আজ বলিরেখা। কিন্তু  দিশেহারা করে দেওয়া সেই  চাউনি,  মার্কারির শিরদাঁড়া দিয়ে বইয়ে দিয়েছিল এক ঠাণ্ডা স্রোত, প্রথম দিনের মতোই।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দলটির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি বছর তিরিশের 'আফগান গার্ল'। কারণ পরপুরুষের কথা বলা পাশতুন সমাজে নিষিদ্ধ। অনেক কষ্টে দোভাষীর মাধ্যমে রাজি করানো হয়েছিল আফগান গার্লের ভাই কাশর খানকে। দেখানো হয়েছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে ছাপা তাঁর দিদির  বালিকা বয়সের ছবি। ছবিটি দেখেছিলেন আফগান মোনালিসা। যাঁর আসল নাম শরবত গুলা। তাঁর মনে পড়েছিল ছবি তোলার মূহুর্তটি। কারণ সেই প্রথম কেউ তাঁর ছবি তুলেছিল। যখন আফগান গার্ল  শুনেছিলেন তাঁর ছবিটি সারা বিশ্বে অসম্ভব জনপ্রিয়,  ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। অস্ফুটে বলেছিলেন, ছবিটি প্রকাশ করা উচিত হয়নি। এর জন্য তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে রক্ষণশীল সমাজ ভয়ানক শাস্তি দিতে পারে। 

আফগান মোনালিসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্টিভ মার্কারির। চরম ঘৃণায় মার্কারির সঙ্গে একটি কথাও বলেননি 'আফগান গার্ল' শরবত গুলা। কিন্তু কথা বলেছিলেন অন্য সবার সঙ্গে। জানিয়েছিলেন তাঁর জীবনকাহিনি। শরবত গুলাদের আদি বাড়ি ছিল আফগানিস্তানের পূর্ব নানগরহর এলাকার এক গ্রামে। শরবতের বয়স তখন ছয়, সারা রাত  গ্রামের ওপর বোমা ফেলেছিল রাশিয়া। অসংখ্য গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলেন শরবতের বাবা ও মা'ও। সেই রাতেই শরবত, তার তিন বোন এক ভাইকে নিয়ে তাদের দিদিমা এক বস্ত্রে পালিয়েছিলেন গ্রাম ছেড়ে। দুর্গম গিরিপথ ধরে এগোতে শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের দিকে। বিমান হানার ভয়ে সারাদিন ছ'জন লুকিয়ে থাকতেন পাহাড়ের গুহায়। বিকেল বেলায় হাঁটতেন তুষারাচ্ছাদিত পাহাড়ি পথ ধরে। রাতের বেলা হয় কোনও গুহায় বা কোনও পাহাড়ি গ্রামের গোয়ালে আশ্রয় নিতেন তাঁরা। কেউ দয়া করে খেতে দিলে জুটত খাবার, কোনও কোনও দিন কম্বলও। এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ হাঁটার পর তাঁরা কোনওমতে এসে পৌঁছেছিলেন পাকিস্তানের পেশোয়ারে। ভাগ্য ভালো ছিল তাঁদের, পেশোয়ারেই আফগান রিফিউজিদের জন্য ক্যাম্প খুলেছিল পাকিস্তান। সেই ক্যাম্পেই আশ্রয় পেয়েছিলেন শরবত, দিদিমা ও ভাই বোনেদের সঙ্গে। 

মার্কারি ছবিটি তোলার তিনবছর পরেই শরবতের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল রহমত গুলের সঙ্গে। রহমত কাজ করতেন পেশোয়ারের একটি পাউরুটি কারখানায়। একে একে জন্ম নিয়েছিল তিন কন্যা রবিনা, জাহিদা ও আলিয়া। জন্মের পরই মারা গিয়েছিল চতুর্থ কন্যা সন্তান। ১৯৯২ সালে আফগান শরণার্থীদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠাতে শুরু করেছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। পরিবার নিয়ে শরবত গুলাও ফিরে গিয়েছিলেন আফগানিস্তানে।  

শরবতই যে আফগান গার্ল তার প্রমাণ কী! শরবত গুলার সঙ্গে কথা বলার পরও নিশ্চিত হতে পারেনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টিম। শরবত গুলাই যে আফগান মোনালিসা সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য সাহায্য নিয়েছিল আধুনিক প্রযুক্তির। প্রথমেই তোলা হয়েছিল শরবত গুলার আরও কিছু ছবি। ১৮ বছর আগে ও পরে তোলা ছবিগুলি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের চক্ষু বিশেষজ্ঞ মুস্তাফা ইকবাল ও আমেরিকার জন ডাগম্যান। তাঁরা বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে ছবিতে থাকা বালিকা ও নারীর চোখের তারার মিল খোঁজা শুরু করেছিলে। কারণ এই পৃথিবীতে দুটি মানুষের চেহারার মধ্যে অস্বাভাবিক মিল থাকলেও, চোখের তারার গঠন ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আলাদা হবেই।

ছবিগুলি নিয়ে একই সঙ্গে গবেষণা শুরু করেছিলেন এফবিআইয়ের ফরেন্সিক টিমের প্রধান থমাস মুশেনো। ১৮ বছর আগে তোলা ছবি দেখে, আফগান গার্লের বর্তমান মুখ আঁকা শুরু করেছিলেন গোয়েন্দা দফতরে সেরা শিল্পী ফ্র্যাঙ্ক বেন্ডার। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এসেছিল ফলাফল। বিশেষজ্ঞেরা সবাই একমত হয়েছিলেন, জানিয়েছিলেন শরবত গুলাই হলেন সেই বিশ্ববিখ্যাত 'আফগান গার্ল'। এরপর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তরফে আফগান মোনালিসাকে দেওয়া হয়েছিল অ্যাজমা আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসা ও হজে যাওয়ার খরচ। 

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের ২০০২ সালের এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদে, আবার দেখা দিয়েছিলেন বোরখা পরা আফগান মোনালিসা। ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল তাঁকে খুঁজে পাওয়া সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন,  'The Afghan Girl: A Life Revealed'। সাড়া পড়ে গিয়েছিল বিশ্বে। এবার কিন্তু আফগানিস্তানেও বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন অজানা অচেনা শরবত গুলা। কারণ দ্বিতীয়বারের ছবিগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল সে দেশের সংবাদ মাধ্যমে। কিন্তু পশ্চিমের সামনে শরবতের বেপর্দা হওয়াটা মেনে নিতে পারেনি রক্ষণশীল পাশতুন সমাজ ও তালিবানেরা। প্রতিকূলতার হাওয়া চরমে উঠলে এক রাতে পরিবার নিয়ে দেশ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন শরবত গুলা। 

বিশ্ব আবার পেয়েছিল শরবতের খোঁজ ! অবৈধ পরিচয়পত্র নিয়ে পাকিস্তানে বসবাস করার জন্য, ২০১৬ সালে শরবত গুলাকে গ্রেফতার করেছিল পাকিস্তানের পুলিশ। স্বামী রহমত মারা গিয়েছিলেন আগেই, ২০১২ সালে। তারপর থেকে সেলাইয়ের কাজ করে, অনেক কষ্টে পাকিস্তানে সংসার চালাচ্ছিলেন শরবত গুলা। মেয়েরা শিখছিল পড়াশুনা। শরবতকে ধরিয়ে দিয়েছিল দ্বিতীয়বার তোলা ছবিগুলিই। বিচারে শরবতের ১৪ বছর জেল ও ৫০০০ ডলার জরিমানা হয়েছিল। প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল সারাবিশ্বে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলির চাপে  দুই সপ্তাহ পরেই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল শরবতকে। পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আফগানিস্তানে। 

আফগানিস্তানে তখন আশরাফ ঘানির সরকার। শরবত গুলাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন আশরাফ ঘানি। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে শরবত গুলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একটি ভাড়া বাড়ির চাবি। দেওয়া হয়েছিল পর্যাপ্ত মাসোহারার প্রতিশ্রুতি। কাবুলের  অভিজাত স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেছিল শরবত গুলার মেয়েরা। কিন্তু কয়েকমাস পর, কোনও অজ্ঞাতকারণে বাড়ি ভাড়া ও মাসোহারা দেওয়া হঠাৎই বন্ধ করে দিয়েছিল আফগান সরকার। সেলিব্রেটি হয়ে দেশে ফিরে আসা শরবত গুলার কাছে আসতে শুরু করেছিল প্রাণনাশের একের পর এক হুমকি। দ্বিতীয়বার ছবি তোলার জন্য নিজেকেই অভিশাপ দিতে শুরু করেছিলেন আফগান মোনালিসা। 

এক রাতে, মেয়েদের নিয়ে আফগানিস্তানের রুক্ষ বুকে আবার হারিয়ে গিয়েছিলেন শরবত গুলা। এখন কোথায় আছেন বিশ্ববিখ্যাত 'আফগান গার্ল'! ২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালিবান দখল করে নিয়েছিল আফগানিস্তান। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল লক্ষ লক্ষ আতঙ্কিত আফগান। 

এরই মাঝে, এক রাতে কাবুল এয়ারপোর্টে নেমেছিল ইতালির যুদ্ধবিমান। নামার পরেও বন্ধ করা হয়নি বিমানের ইঞ্জিন। অন্ধকারে বসে থাকা কিছু আফগান নারী পুরুষ, কিশোর কিশোরী উঠে পড়েছিল সেই বিমানে। যাত্রীরা বিমানে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই রানওয়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল বিমানটি। কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই ডানা মেলেছিল আকাশে। সেই বিমানে তিন মেয়ের সঙ্গে ছিলেন ৪৯ বছরের শরবত গুলা। এশিয়ার মোনালিসা উড়ে চলেছিলেন ইউরোপের দিকে। আতঙ্কহীন জীবনের সন্ধানে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির দফতর  ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জানিয়েছিল, সে দেশেই আছেন 'আফগান গার্ল' শরবত গুলা। তবে কোথায় আছেন, তা বলা যাবে না। 

আফগান গার্লের ছবি নিয়ে ভবিষ্যতেও আলোড়িত হবে বিশ্ব। তবুও বিশ্ববিখ্যাত শরণার্থী  শরবতকে শরণার্থী হয়েই কাটাতে হবে বাকি জীবন। বাকি পথটুকু চলার সময় আফগান মোনালিসাকে কুরে কুরে খাবে একটিই প্রশ্ন, দেশ থাকতেও তাঁকে আজীবন পালিয়ে বেড়াতে হলো কেন? দায়ী কে! আফগানিস্তান! রক্ষণশীল সমাজ! নাকি তাঁকে বিশ্ববিখ্যাত করে দেওয়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও ফটোগ্রাফার স্টিভ মার্কারি!

Post a Comment

Previous Post Next Post