রূপসী/আজিজুল হাকিম

 


রূপসী

আজিজুল হাকিম

 

দুপুর রাতে কারেন্ট চলে যাওয়ায় সলিমুদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। গরম কাল এলেই কারেন্টের এই একটাই রোগ – যখন তখন চলে যাওয়া। এখন মানুষ একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবে তা না। অফিসের লোকেরা রাতদিন কিছুই মানে না।

ও কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে উসখুস করতে লাগল। কি করবে, সে কিছুই বুঝতে পারল না। বিড়ি ধরাবার জন্য ও দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল। পাশে বউটা তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কি গরম আর কি ঠান্ডা ও কিছুই বোঝে না। ঘুম পেলেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সলিমুদ্দিনের ব্যাপারটা আলাদা। ঘামে যদি ঘাড়, গলা একটু ভিজে যায় তাহলেই আর ঘুম আসবে না। তখন হয় বিছানায় পড়ে উসখুস করতে হবে; তা না হলে বিছানা ছেড়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে হবে।

ও বিড়ি ধরিয়ে চৌকি থেকে নিচে নেমে এল। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে উসরার নিচে পড়ে থাকা স্যান্ডেল জোড়ায় পা দুটো গলিয়ে দিল। তারপর আঙ্গিনা পার হয়ে, গলির ঝাপটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে, ঝাপটা পুনরায় লাগিয়ে দিল। 

জ্যৈষ্ঠ মাসের রাত। কোথাও একটুও হাওয়া বইছে না। গাছের পাতাগুলো নড়াচড়া করছে না। শরীরটা একটু ফুরফুরে হবে তার কোন জো নাই। ও হাঁটতে শুরু করল। তখন আকাশে একফালি বাঁকা চাঁদ উঠেছে। চাঁদটা দেখতে কামারের হাপরে পোড়ানো চকচকে বাঁকা লাংল্যার মত মনে হচ্ছে। 

ও আস্তে আস্তে এক পা দু পা করে বিলের দিকে এগিয়ে গেল। যদি ফাঁকা জায়গায় একটু বাতাস পাওয়া যায়; তাই সে ওদিকেই গেল। তারপর দু চারটে বাড়ি পার হয়ে ওই বিলের ধারে মাঠের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। একটু শিরসিরে হাওয়া বিল থেকে খুব কষ্টে উঠে আসছে বলে মনে হচ্ছে। ও দাঁড়িয়ে আবার একটা বিড়ি  ধরাল। দূর থেকে দেখে মনে হবে যে, কোন ভুত; যেন মুখে আগুন জ্বলছে আর নিভাছে।  বিড়িটা শেষ হলে বিড়ির মুঠোটাকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে ও ঘাসের উপরে বসল। 

এটাকে এখন সবাই বিল বলেই ডাকে। কিন্তু এর আলাদা একটি নাম আছে। তার নাম হল রূপসী। একে একসময় রূপসী নামেই ডাকা হত। কিন্তু যেহেতু তার আগের সেই রূপ, সেই সৌন্দর্য নেই; সেহেতু সে এখন রূপসী নাম থেকে বঞ্চিত হয়ে একটি বিল এ পরিণত হয়েছে। 

এখনও ভারী বর্ষণ হলেই এই রূপসীর বুক থৈ থৈ পানিতে ভরে ওঠে। তারপর শীতকাল চলে গেলেই এই পানি কোথায় যে হারিয়ে যায়! বুড়ো মেয়ের জড়সড় মুখশ্রী এবং হাত-পায়ের চামড়াগুলো যেভাবে ফেটে ফেটে খসখসে হয়ে যায়; ঠিক সেই ভাবে এই রূপসীর সারা বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আর এখন সেই অবস্থাতেই ও পড়ে আছে। আজকালের বৃদ্ধ–বৃদ্ধারা যেভাবে ছেলে-মেয়ে আর বউ-ঝির অনাদর, অবহেলা আর লাঞ্ছনা বুকে করে বিছানায় পড়ে থাকে; ঠিক সেইভাবে রূপসীও পড়ে আছে।    

বেশি দিন আগের কথা নয়, সলিমুদ্দিন বারোমাস রাত জেগে জেগে এখানে মাছ ধরেছে। সেই মাছ বেচে সংসার চালিয়েছে, কিছু জমি-জিরেত কিনেছে, ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে। সত্য কথা বলতে কি এই রূপসী তার জীবন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু এখন আর হয় না। ভরা বর্ষ নাহলে এই বিলে আর পানি থাকে না। তবুও রাত হলেই যেন এই বিল ওকে ডাকে। কি বর্ষা, কি গ্রীষ্ম, কি শীত - বারোমাস। কোন কোন বছর বর্ষা না হলে ওর বুকটার দিকে তাকালে সলিমুদ্দিনের বুকটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। যে ডোঙায় করে সারারাত ধরে মাছ ধরত সেই  ডোঙাটা রূপসীর ফাটা বুকে মরা মানুষের মতো চুপচাপ পড়ে আছে।

একথা ওকথা ভাবতে ভাবতে কতটা সময় চলে গেছে, সেটা সলিমুদ্দিন বুঝতে পারিনি। চাঁদটাও বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেছে। 

রূপসীর শেষ প্রান্ত থেকে হঠাৎ করে ও ঝড়ের সাঁইসাঁই শব্দ শুনতে পেল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের ঝাপটা সলিমুদ্দুনের গায়ে এসে লাগল; তখন ও ঠান্ডা ফুরফুরে মেজাজে উৎফুল্লিত হয়ে পড়ল। যে দিক থেকে ঝড়টি আসছিল ও সেদিকেই তাকিয়ে থাকল।

কিছুক্ষণ পরে ও আরো একটা বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু না, বারবার চেষ্টা করেও সে বিড়ি ধরাতে পারল না। বাতাসে বারবার দেশলাইয়ের কাঠিকে নিভিয়ে দিচ্ছে। ও বিরক্ত হয়ে বিড়িটাকেই পাশে ছুড়ে ফেলতে গেল আর অমনি ওর নজরে পরল একটি মেয়ে ওর পাশে বসে আছে। পুরো সাদা শাড়িতে আচ্ছাদিত একটি বৃদ্ধ মহিলা। চাঁদের আলোতেও ওর বুঝতে অসুবিধা হল না যে মেয়েটি একসময় অসাধারণ সুন্দরী ছিল। ও চমকে উঠল। বলল, কে তুমি? তোমাকে তো চিনতে পারছি না।

বৃদ্ধাটি খুব কষ্টে মুখে এক ঝলক হাসি নিয়ে বলল, আমাকে চিনতে পারছিস না। অথচ আমার বুকে তুই কতদিন রাত পার কর‍্যা দিয়াছিস, কতদিন আমার বুকে ডোঙা ভাসিয়েছিস, কতদিন খলই ভর্তি মাছ ধর‍্যাছিস আর আজ আমাকে চিনতে পারছিস না?

কথাগুলি শুনে সলিমুদ্দিনের সারা গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। শিরশির করে উঠল ওর সারা শরীর। ও আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। বলল, না, আমি তোমাকে চিনতে পারছি না। 

ও বলল, এড্যাই তো আমার দুর্ভাগ্য রে। তুই আমাকে আজও চিনতে পারলি না। তাহলে কে চিনবে, বল?

আমি তো তোমাকে কোনদিন দেখিনি। তাহলে কি করে চিনব? সলিমুদ্দিনের বুকে একটু সাহস নিয়ে বলল, এসব ন্যাকামি বাদ দিয়ে আসল পরিচয় দাও তো।

আমি রূপসী, এবার চিনতে পারলি?

কোন রূপসী?

ক্যানে, যে রূপসীর ধারে তুই বস্যা আছিস। এই তো, আমি সেই রূপসী।

আমি তো বিলের ধারে বস্যা আছি। তুমি একটা বিল না, মানুষ? একটা বুড়হ্যা মিয়্যা।    

হ্যাঁ, আমি তো এখন বুড়হ্যা হয়ে গেলছি। আমার গাল, হাত-পা – সব জড়োজড়ো হয়্যা গেলছে। হবেই বা না কেনে, আমি তো আর আগের মতো জোয়ান নাই।

আমি তোমার হেঁয়ালি কথা বুঝতে পারছি ন্যা।

ও বলল, বুঝবি, বুঝবি সব বুঝবি। যে নদীকে দেখছিস এই নদী আমি। আজ এই নদী আমি মানুষের রূপ ধরে তোর কাছে আস্যাছি। তোর সাথে দুট্যা সুখদুঃখের কথা বুলবো বুল্যা আনু।

সলিমুদ্দিনের মনে পড়ে গেল, ওকে অনেকে বলেছে গভীর রাতে এই বিলের পানির উপরে নাকি সাদা কাপড় পড়ে একটি মেয়ে হেঁটে বেড়ায়। অনেকে দেখেছে কিন্তু সলিমুদ্দিন কোনদিন দেখেনি। কি করবে বুঝতে পারল না। ও কি উঠে পালিয়ে যাবে? কিন্তু ও তো শুনেছে জিন ভুতের খুব শক্তি। ওরা যে কোন মুহূর্তে জোয়ান মানুষকেও মেরে দিতে পারে। তাই সে অসহায় ভাবে বসে থাকল।

রূপসী বলল, আমার কি কোন কাহিনী তুই জানিস?

সলিমুদ্দিন বলল, না। তোমার কোন কাহিনী জানিনা। কেবল শুনেছি, তোমার নাম রূপসী। এর বেশি কিছু জানিন্যা।

জানিস, আমি এক সময়ে বিশাল বড় নদী ছিনু। ভাগীরথী থাক্যা আমি আস্যাছিনু। তারপর আঁকাবাঁকা পথে পদ্মার একটা শাখা এসে আমার সাথে মিল্যাছিল। তারপরে আমি আরও বড় হনু। তারপর এদিক দিয়্যা আমি ভৈরব নদী গেলছি। আবার ওই মাঠ পার হয়্যা, ঘুর‍্যাফির‍্যা গেলছি গোবরা নালার কাছে। কিন্তু এখন আমি হাত-পা হারা একটা অক্ষম বুড়হ্যা মিয়্যা।  

সলিমুদ্দিনের মনের মধ্যে কৌতুহল জন্মাল। বলল, তারপর?

রূপসী বলতে থাকল, সেই ম্যালাই দিন আগেকার কথা। আমি ম্যালাই উসার ছিনু; তা এক মাইলের কাছাকাছি আর দিঘলের কথা তো তোকে আগেই বুল্যাছি।  আমার বুক দিয়্যা সারা বছর কুলকুল কর‍্যা পানি বহাতক। তখন জোয়ান ছুঁড়ির মতই ছিল আমার রূপ-যৌবন। তখন আশপাশের সারা গা থাক্যা লোকেরা আসতক বাসন-কসন আর পাতল্যার লাগ্যা।

সলিমুদ্দিন বলে উঠল, বাসন কসন ক্যানে? তুমি ওসবের ব্যাবসা করত্যাক নাকি?

রূপসী বলল, ছোড়ার কথা শুন্যা গা জ্বল্যা গ্যাল! আমাকে লিয়্যা ঠাট্টা করছিস?

সলিমুদ্দিন একটু হেসে বলল, ঠাট্টা করছি ন্যা গো? জানতে চাইছি। তোমার কাছে কিসের লাগ্যা থালা বাসন লিতে আসবে?

সে যুগের কথা তো তুই জানিস ন্যা। তখন নদীর কাছেই মানুষ নির্ভর কর‍্যা চলতোক। তখন আশপাশের গাঁয়ে কারো বাড়িতে বিহ্যাশাদীর ঘটা ঘটলে আমার কাছে আস্যা কেবল মুখ ফুট্যা বুললেই যখান থালি বাসনের কথা বুলতোক, ঠিক আমার বুকের মাঝখান থাক্যা একটা বড় ঢেউ তুল্যা তখনই দিতুক। এভাবেই যুগের পর যুগ পার হয়্যা গেলছে। তখনকার মানুষ সহজ সরল ছিল। মনের মধ্যে লোভ লালসা ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে মানুষের স্বভাব বদলাতে লাগল। একদিন একটা লোক আস্যা একশোটা থালি চায়ল। আমি দিয়্যাও দিনু। কিন্তু সেই থালি আর ফ্যারত আসলো না। ওর আগেও কয়কজনা অমন কাজ কর‍্যাছিল। কিন্তু ওরা দু-এখান কর‍্যা লিয়্যা লিয়্যাছিল। তাতে আমি রাগ করিনি। কিন্তু যখন আমার কাছ থাক্যা লিয়্যা যাওয়া সব থালিগুলান লিয়্যা লিলো তখন আমার খুব রাগ হল। আমি আর কাহুকে একটাও কিছু দিনুনা।

সলিমুদ্দিন বলল, তাহলে লোকেরা বিহ্যাশাদি কি কর‍্যা দিল?

রূপসী বলল, যা কর‍্যা পারলো দিল। তারপর থাক্যা লোক আসে আর ফির‍্যা যায়। মুনের মাঝে মায়া আসলো। আমার বুকে আস্তে আস্তে পদ্মপাতায় ছাহ্যা গ্যালো। সেই পাতা লিয়্যা লোকেরা খানাপানি দিতে শুরু করল।

সলিমুদ্দিন বলল, কিন্তু আমি তো তোমার বুকে কোনদিন পদ্মপাতা দেখিনি?

রূপসী একটু ঝাঁঝিয়ে বলল, তোদের চৌদ্দপুরুষরা ভাল ছিল? পদ্মফুল, পদ্মের বিচি সব খাতে শুরু করল। রাক্ষসের বাচ্চা সব। তাহলে কি কর‍্যা দেখবি, বোল?

সলিমুদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তাই তো।

রূপসী বলল, তখন আমার সুন্দর রূপ দেখ্যা এক কবিয়াল নাম দিয়্যাছিল, ‘রূপসী’।

সলিমুদ্দিন রূপসীর দিকে তাকাল। কোথায় সেই রূপ! জড়সড় চেহারা।

রূপসী বলল, সেই সব হেমন্ত কালের জোছনায় কত মাঠের পর মাঠ আমি হেসে খেলে ঘুরে ব্যাড়ালছি। গান গাহ্যাছি। কত সুন্দর সুন্দর রঙিন পাখিরা আমার বুকে ডানা মেলেছে। আমার বুকের আয়নায় অরা মুখ দেখ্যাছে। চর‍্যা ব্যাড়ালছে আমার কূলে। তারপর কুঠে থাক্যা ইংরাজরা উড়্যাপুড়্যা আসলো, আমার বুকে পানি আসার সব রাস্তা বান্ধ দিয়্যা বন্ধ কর‍্যা দিল। তখন থাক্যা পানি ব্যাগর আমি মরার মতো হতে লাগনু। তারপর তো তুই সবই দেখলি।

সলিমুদ্দিন রূপসীকে ভাল করে দেখার জন্যে বিড়ি খাওয়ার বাহানায় একটা কাঠি বের করে দিয়াসালাই ধরাতে গেল। আগুন জ্বলে উঠলে একটা নিঃশ্বাসের মতো শব্দে আগুন নিভিয়ে গেল। ওর চোখের সামনে অন্ধকার কিছুক্ষণের জন্যে প্রকট হয়ে গেল। ও পাশে তাকাল। রূপসী নেই। ও চমকে উঠল। তাহলে কি ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল?

হঠাৎ বিলের বুকে চোখ পড়ল। মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত একটি মেয়ে বিলের মাঝ বরাবর হেঁটে চলেছে। মাথার উপরে চাঁদ আর একখণ্ড বিশাল কালো মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে।    

2 Comments

  1. ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগল।মিরা দেহের রূপকের আড়ালে যেটা এককালে বিশালাকার নদী ছিল,সেই নদী প্রবাহিত হত ভৈরব পর্যন্ত, অন্যদিকে গোবরা নালা। বাহাদুরপুর বেনীপুর বাঁধের পর ক্রমে ক্রমে বুজতে থাকে।থালা বাসন দান, তারপর পদ্ম পাতা। এই বিল নানা নামে পরিচিত ছিল।
    লগরা ভালকে বিল,মগরা দহ। হয়তো কুমির থাকতো তাই মগরা দহ।খুব ভাল লাগল।

    ReplyDelete
Previous Post Next Post