পর্ব-২
একটা আলোর হাতছানি
অনেকক্ষণ পরে ও নদীর দিকে মুখ করে
বসল। পা দুটোকে একটু সামনে বাড়িয়ে দিল। দু হাত দিয়ে হাঁটু দুটিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর
হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে আমার দিকে স্মিত হাসি নিয়ে তাকাতে লাগল। অপলক চোখ। কে এই মেয়ে?
মনের মাঝে প্রশ্ন জাগলেও কিছুই বললাম না। কিছুটা লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে অন্য দিকে তাকালাম।
কিছুক্ষণ পর ও ওর মুখটি তুলল। বলল,
আমাকে চিনতে পারলে না?
আমি বললাম, এত সুন্দর মেয়ে আমি জীবনেই
দেখিনি। কি করে চিনব, বল?
ও হাসতে হাসতে বলল, আমি খুবই সুন্দর,
তাই না?
আমি বললাম, সব মেয়েদের রূপ এক জায়গায়
করলেও তোমার রূপের ধারের কাছে আসতে পারবে না।
ও স্মিত হেসে বলল, তাই নাকি! তুমি
একটা মস্ত পাগল। আমার দিকে তাকাও। আমার চোখের দিকে ভাল করে তাকাও। আমাকে ভাল করে দেখ।
আমি সাহস পেলাম। এবার নির্লজ্জের মত
ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকাতে লাগলাম। কিন্তু আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আস্তে আস্তে মাথার
মধ্যে এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড়ে
ক্ষতবিক্ষত হতে থাকলাম। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছি। চেনার প্রচণ্ড চেষ্টা করলাম। নাঃ! পারলাম
না।
ও আবার হাঁটুতে চিবুক ঠেকাল। আমার
দিকে একইভাবে নিঃসঙ্কোচে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে। আমার মাথা বোঁবোঁ করে ঘুরছে। শেষ পর্যন্ত
আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
তারপর যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম ও
হাতের দুই চোলে করে পানি এনে আমাকে খাওয়াল। আমার চোখ মুখ সব ভেজা। আমি ওর দিকে তাকিয়ে
থাকতে লাগলাম। আস্তে আস্তে আমার স্মৃতি ফিরে আসতে লাগল। ওকে চিনতে পারলাম। বললাম, তুমি
সেই মেয়েটি না?
ওর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল। চোখের পাতায়
অশ্রুকণার বারিধারা। সেই বারিধারা দুই গাল বেয়ে চুয়ে পড়তে লাগল। বলল, তাহলে তুমি আমাকে
চিনতে পেরেছ! আমি সেই মেয়েটি যাকে তুমি অনেক দিন আগে দেখেছিলে। বল তো কোথায়?
আমি বললাম, স্বপ্নে। তবে আজ থেকে অনেক
অনেক বছর আগে।
একদম ঠিক বলেছ। তারপর কত পানি বয়ে
গেছে এই নন্দিতার বুক দিয়ে। কত হাসি কান্না এসেছে। আবার হারিয়ে গেছে। আমার সব চেয়ে
বেশি আনন্দ হচ্ছে এই কারণে যে, আজও তুমি আমাকে মনে রেখেছ।
আমি কিছুই বললাম না। কেবল আনন্দে বিহ্বল
হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম আর ও চেয়ে রইল নদীর দিকে।
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পর আমিও নদীর
দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সেই অনেক কাল আগের কথা। তখন আমার বয়স
সতের বছর। সেটি ছিল শরতের রাত। মাথার উপরে
মেঘহীন উজ্জ্বল নীল আকাশ। কেবল মাত্র পেঁজা তুলোর মতো কয়েক গুচ্ছ মেঘ আকাশের বুকে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে। জ্যোৎস্না প্লাবিত শান্ত নিঝুম রাত। সারা আকাশে অসংখ্য তারা মিটিমিটি করে
হাসছে। সেই শব্দহীন হাসির মধুরিমায় পৃথিবী ভরে উঠেছিল। বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া নির্মল স্বচ্ছ
গাছের সবুজ পাতা বেয়ে জ্যোৎস্নার চন্দনধারা চুয়ে চুয়ে পড়ছিল। উত্তর-পূর্ব দিগন্ত থেকে
দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে চলে যাওয়া ছায়াপথটি অন্য রাতের চেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছিল। হয়ত
সে পথ ধরেই এই মেয়েটি নেমে এসেছিল আমার স্বপ্নের জগতে। স্বচ্ছতার, পবিত্রতার, নির্মলতার,
শুভ্রতার ঝলক আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছিল।
এই মেয়েটি একটি বড় ফুল গাছের ডালে
বসেছিল। গাছটির সমস্ত ডালপালা, শাখা-প্রশাখা নাম না জানা সাদা সাদা ফুলে পরিপূর্ণ ছিল।
বাসর ঘরের সাদা ফুলের মতোই ওই ফুলগুলি ঝুলছিল ওর চারপাশে। তারই মাঝে একটি ডালে ও বসে
ছিল। সেই ডালটি নিশ্চয় বেশ মোটা হবে। তা না হলে ও ওইভাবে বসতে পারতো না। ও বসে পা দুটোকে
সামনে একটু এগিয়ে দিয়ে দুই হাত দিয়ে ধরে থুতনিকে হাঁটুর উপরে রেখে বাঁ দিকে ঘুরে অজস্র
ফুলের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। স্থির, নিস্পলক সে চাহনি। ওই গাছ থেকে একটু
দূরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওর দিকে চেয়ে ছিলাম অবাক বিস্ময়ে।
কালো কুচকুচে ঢেউ খেলানো চুল ওর পিঠে
অবিন্যাস্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাথা থেকে নিতম্বের নিচে নেমে গেছে। ও সালোয়ার কামিজ পরে
আছে। সেগুলো ধবধবে সাদা। বুকের উপর দুধ-সাদা উর্ণা। এক আশ্চর্য সুন্দর তার দৈহিক গঠন।
বেশ ছিমছাম হালকা পাতলা গড়ন। হুর বা পরীর চেয়েও হয়তো সে সুন্দর। ওর কাছে ফুলের দেবী
ফ্লোরা বারবার লজ্জিত হবে। সুন্দরের দেবী ভেনাস মুখ ঢাকবে উর্ণায়। তার কাছে মোনালিশার
হাসি ম্লান হয়ে যায়। মুখের স্ট্রাকচার সামান্য ডিম্বাকৃতি। মুখে অদ্ভূত অনাবিল প্রসন্ন
হাসি। দারুণ সুন্দর স্মাইলিং ফেস। চোখ দুটি অপার কালো। বিস্ময় মাখা। ওর চোখের দিকে
তাকালে মানুষ অন্য এক জগতে হারিয়ে যাবে। দিশেহারা হয়ে পড়বে। জীবনের সমস্ত বাস্তবতা
এখানে এসে লুটোপুটি খাবে। সেই অব্যক্ত, অপলক চাহনিতে ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
ওঃ! কি দারুণ লাগছিল! আমাদের মাঝে
কোন কথা নেই। কেবল দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অনন্তকাল। ওর নিস্পলক চোখ। আমার
চোখে মুখে অবাক বিস্ময়। ওর চোখে মুখে মায়াবিনী হাসি। এক আশ্চর্য সুন্দর প্রতিমা। আমি
প্রকাশহীন আনন্দে নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম।
তারপর ওই মেয়েটি সুনীল আকাশের ছায়াপথ
ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ধীর পদক্ষেপ। আমি স্থিরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ওর চলে যাওয়া
কি নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক! ওর পিঠের উপরে চুলগুলো এপাশ থেকে ওপাশে দুলছে। ওই সুন্দর
ছায়াপথে সেও যেন জ্বলছে। ওঃ! কত সুন্দর উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি! মাঝে মধ্যে আমার দিকে
ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। সেই স্মাইলিং ফেস।
অনেক দূরে গিয়ে সে দাঁড়াল। পিছুনে
ঘুরলো। হাতের ইশারায় জানালো বিদায় সম্ভাষণ। ওর চারিপাশে অনন্দের অগুনিত উল্লাস। আমার
চারিপাশে বিষাদ বেদনায় কম্পমান বুক। সর্বহারার নিরব সঙ্গীত।
আমি চিৎকার করে বললাম, তোমার নামটা
তো বলে যাও।
সেও চিৎকার করে বলল, আলবেলা……।
আমার হৃদয়ের মাঝে কে যেন বলে যাচ্ছে,
আমাকে এই নির্জন পরিত্যক্ত পৃথিবীর বুকে একাই ফেলে তুমি চলে যাচ্ছ? আমি নির্মমভাবে
একাকি। আমাকেও নিয়ে চল তোমার ওই স্বপ্ন মাখা নীল জগতে। প্লীজ! দেখ, আমি ভীষণ অসহায়।
ফিরে এসো ডার্লিং। কেনই বা এলে, কেনই বা চলে যাচ্ছ। অন্তত তোমার অ্যাড্রেসটুকু আমাকে
দিয়ে যাও।
ও হাঁটছে অসীম ছায়াপথ বরাবর। নিঃসীম
ছায়াপথের কোন এক নির্জন প্রান্তের দিকে ও চলে যাচ্ছে।
আমি আর নিজেকে কনট্রোল না করতে পেরে
ওর পিছুনে ছুটতে গেলাম। স্বপ্নটি ভেঙে গেল!
আমি জানালা দিয়ে উজ্জ্বল ঝকঝকে আকাশের
দিকে তাকালাম। চাঁদ হাসছে। তারাগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। সেই ছায়াপথ ওই রকমই আছে। কেবল
আলবেলা নেই।
আমি চমকে পাশে তাকালাম। আলবেলা আমার
দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নদীর দিকে হাসছে। বলল, এতক্ষণ কি ভাবছিলে?
আমি বললাম, তোমাকে আমার প্রথম দেখার
স্মৃতি মন্থন করছিলাম।
খুব ভাল। এখন ওঠা যাক।
আমি বললাম, কোথায় যাব?
আলবেলা বলল, আমি যেখানে যাব। যাবে
না আমার সাথে?
আমি যাব কি যাব না বুঝতে পারলাম না।
এই মেয়ের বাড়ি কোথায়? কি তার পরিচয় কিছুই তো জানলাম না। কিন্তু এই অজানা, অপরিচিত জায়গায়
আমি যাবই বা কোথায়! তাছাড়া আমার তো কোন ঠিকানা নেই। তাহলে? বললাম, যাব।
আমরা নদীর ধার বরাবর হাঁটতে লাগলাম।
সেই সব চড়াই উতরাই পার হতে হতে অনেক
দূর হেঁটে গেলাম। তারপরও আমরা হাঁটছি। কোথাও কোন গ্রাম বা শহরের চিহ্ন দেখতে পেলাম
না। কেবল সুবিস্তৃত সবুজ মাঠ চারিদিকে গিয়ে আকাশটাকে ধরে আছে। আরো আরও অনেকটা পথ হেঁটে
গেলাম। সামনে বিস্তৃত পাহাড় চোখে পড়ল।
এক সময় আমরা ওই পাহাড়ের কোলে পৌঁছে
গেলাম। সেখানে দেখলাম দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নদী চলে গেছে। আমরাও দুই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
হেঁটে যাচ্ছি।
ভারি সুন্দর পাহাড়। নানান সবুজ গাছপালায়
পাহাড় দুটিকে ঢেকে আছে। মনে হচ্ছে এখানে প্রকৃতি সবুজ আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে। নানান
পাখিদের চিৎকারে পাহাড়ি বনকে মুখরিত করে তুলেছে। আলবেলা তেমন কোন দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে
চলেছে। আর আমি নানান কৌতূহলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যেই সে হেসে উঠে বলছে,
সত্যি তুমি একটি পাগল।
আমি ওর কথায় কান না দিয়ে কখনো গাছ,
কখনও পাখি দেখতে দেখতে থমকে দাঁড়াচ্ছি। আবার হাঁটছি।
অবশেষে বিরাট একটি গুহার সামনে চলে
এলাম। ভয়ঙ্কর সুন্দর গুহাটি। এখানে দুটি পাহাড় এক জায়গায় মিলিত হয়ে একটায় পরিণত হয়ে
গেছে। তার তলা দিয়ে গোলাকার বিশাল সুড়ঙ্গটি। অপার রহস্য নিয়ে সুড়ঙ্গ পথ ধরে বাইরে এসেছে
নন্দিতা।
আলবেলা বলল, আমাদেরকে এই সুড়ঙ্গ পথ
ধরে যেতে হবে।
আমি এবার থমকে দাঁড়ালাম। কে এই মেয়ে?
কোথায় আমাকে নিয়ে চলেছে? এই ভয়ঙ্কর গুহার মধ্যেই বা কেন?
আলবেলা রহস্যময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে
আছে। মুখে সেই প্রসন্ন হাসি। আমি তাকিয়ে আছি এক বুক সংশয় নিয়ে। চোখে মুখে এক আতঙ্কের
ছাপ।
আমি বললাম, আমরা কোথায় যাব?
আলবেলা বলল, আমাদের বাড়ি।
গুহার মধ্যে কেন! গুহার মধ্যে কারো
বাড়ি হয়?
কেন, আদিম কালে মানুষ গুহাতে বাস করেনি?
ওরা তো ঘরবাড়ি তৈরি করতে শিখে ছিল
না, তাই। তোমার বাবা-মাও কি তাই? ঘর বানাতে শেখেনি? কথাটি বলেই আমার মনে প্রশ্ন জাগল,
আমি কি আদিম যুগে চলে এসেছি। এই মেয়ে কি প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন মেয়ে? তাহলে পরনে
আধুনিক যুগের পোষাক কেন? এক অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হ্যা, আমরা গুহার মধ্যে বাস করি। তুমি
যাবে কি না বল? কথাটি বলেই ও আমার দিকে দুষ্টুমি হাসিতে তাকাল।
আমি বললাম, আমার ভয় করছে। আমি যাব
না।
আলবেলা বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসো না?
এই তোমার ভালোবাসা?
কিন্তু তবুও……।
কোন কিন্তু নয়। তোমাকে যেতেই হবে।
আর যদি না যাও তাহলে জানব তুমি আমাকে ভালোবাসো না।
ভালবাসার সঙ্গে যাওয়া না যাওয়ার সম্পর্ক
কি? তাছাড়া আজও গুহার ভিতরে মানুষ বাস করে এই কথাটি বিশ্বাসই করতে পারছি না।
ও হাসতে লাগল, তুমি সত্যি একটি পাগল।
গুহার ভিতরে আমরা থাকি না। গুহার ওপারে আমাদের বাড়ি। গুহা পার হলেই সেখানে পৌঁছে যাব।
আমি বললাম, অন্য কোন ঘুরপথ নেই?
ও বলল, না। বিকল্প কোন পথ নেই। আমাদেরকে
এই পথ দিয়েই যেতে হবে।
তুমি কি সত্যি আলবেলা? না আলবেলার
রূপে অন্য কোন ছলনাময়ী নারী?
ও বলল, আমার দিকে তাকাও। আবার ভাল
করে দেখ। আমি সেই মেয়ে যাকে তুমি ভালোবাস। অনেক মেয়েকে ভুলে গেলেও যাকে তুমি এখনো ভুলতে
পারনি।
আমি ওর দিকে আবার তাকালাম। ও ছাড়া
ওকে অন্য কোন মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও মনের মধ্যে সংশয় রয়ে গেল।
চল যাই, বলেই ও আমার হাত ধরে টানটে
লাগল। আমিও বাধ্য শিশুর মতোই দুরুদুরু বুকে ওকে অনুসরণ করতে থাকলাম।