৬
ভোরের বেলায় রাষ্ট্রীয়
সন্ত্রাস
ওই সময় মানুষের কাজকর্ম না থাকার কারণে
মাঝে মাঝে লোকের সঙ্গে লোকের মারপিটও হতো। এদিকে কয়েক বছর আগেই একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের
সমাধির উপরে আর একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্ম নিল। কংগ্রেসের জায়গায় এলো সি,পি,আই
(এম)। আমাদের এলাকায় কংগ্রেস সরে যাওয়ার মূলে কংগ্রেস প্রশাসনই দায়ী ছিল বলে শুনেছি।
কারণ আমাদের এলাকায় কেবল বর্ষায় ধান ফলত। তারপর সেই জমিতে তেমন কোন ফসল ফলত না। কোন
নদী থেকে ক্যানেল কেটে সেচের ব্যবস্থাও ছিল না। আর মাটির উপর থেকে পঁচিশ তিরিশ ফুট
নিচেই পানির লেয়ার পাওয়া যায়। যার কারণে জমিতে পানিও জমত না। এরকম বিভিন্ন সমস্যার
ফলেও যে ধান ফলত তাতে আমাদের এদিকের গ্রামগুলির অধিকাংশ পরিবারের চলত না। বিশেষ করে
যারা গরিবগুরবো মানুষ। যার কারণে ভাগীরথীর ওপারে গিয়ে আজিমগঞ্জ থেকে চাল কিনে নিয়ে
আসার চেষ্টা করত। কিন্তু আজিমগঞ্জ পার হয়ে জিয়াগঞ্জে পা দিলেই সর্বনাশ। পুলিশ তাদের
সব চাল কেড়ে নিত। ফলে কান্না করতে করতে তাদের বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া তাদের কোন উপায় থাকত
না। যারা এদিক ওদিক ঘুরে, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চাল বাড়ি নিয়ে আসতে পারত তারাই
ছিল ভাগ্যবান। তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা কেউ ভাবত না। এমন অবস্থায় কেউ কেই না খেতে পেয়ে
অন্যের কোন ফল চুরে করে খায়। কিন্তু জানতে পারলে তার অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ত। এমন শোনা
গেছে কেউ কেউ না খেতে পেয়ে বিষ পান করে আত্মহত্যা করেছে।
এমন একটি মর্মান্তিক সময়ে দিশার আলো
নিয়ে এল সি, পি, আই (এম) পার্টি। কিন্তু পথ যতই সুন্দর হোক না কেন কারো না কারো পায়ের
আঁচড়ে ধুলো উড়বেই। সেভাবেই বিভিন্ন কৌশলে শুরু হল বিরোধী নেতাদের নিধন যজ্ঞ। একটা সন্ত্রাসের
উপরে আর একটা সন্ত্রাসের পরিবেশ। শুরু হল বিরোধী দলনেতাদের নিধনযজ্ঞ। তবে এই নেতাদের
সরিয়ে দিতে কেউ রাজনৈতিক ছত্রছায়ার আশ্রয় নেয়নি। পারিবারিক কোন্দল বা অন্য কোন উপায়ে
তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেই সময় আমাদের গ্রামের একটি বড়লোকের
বাড়িতে চুরি হয়ে গেল। চুরি করল অন্য গ্রামের চোর; কিন্তু পাশের গ্রামের এক বিরোধী দল
নেতা ও তার ভাই, নুরু আর খাদুর নামে প্রচার হল। অবশ্য ওই দুই ভাইকে তখন এলাকার লোক
ডাকাত আখ্যা দিয়েছিল। ওর আগে ওদের ডাকাটির কাহিনিও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু ওরা নাকি আশপাশের
কোন গ্রামে চুরি ডাকাতি করত না। যা করত তা দূরদূরান্তের কোন গাঁয়ে।
ওই চুরিকে কেন্দ্র করে পুলিশ তাদের
ধরতে এলো। অন্যায়ভাবে ধরতে আসার কারণে খাদু পুলিশকে মারতে গেল। আমি তখন অড়হলের ভুঁইয়ে
আমার এক মামার সঙ্গে খেলছিলাম। আমার বয়স তখন ছয়-সাত হবে। মামা ছাগল চরাচ্ছিলেন। আমি
কেবল সঙ্গে গিয়েছিলাম। অড়হলের ভুঁই থেকে দুটি ফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম
দূরে রাস্তার উপরে পুলিশ দাঁড়িয়ে। জীবনে প্রথম বন্দুকের শব্দে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম।
বাড়িতে এসে শুনলাম খাদুকে মারার জন্য পুলিশ ফায়ার করেছিল।
কয়েক দিন পর অভাবের তাড়নায় কয়েকজন
লোক খাদুর বাড়িতে কাজে এল। খাদু তাদেরকে নিষেধ করলেও তারা বারণ শুনেনি। পুলিশ এলো।
খাদু পালিয়ে গেল। পুলিশ কাজের মুনিষদের ধরে নিয়ে গেল থানায়। গ্রামের লোকজন গিয়ে ছাড়িয়ে
নিয়ে এল; কিন্তু চুক্তি হল, ওদের দুজনকে ধরে থানায় তুলে দিতে হবে। শুরু হল গ্রামের
সঙ্গে ওই দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব।
গ্রামের লোকের চাপে ওরা গ্রাম ছাড়া
হল। কয়েক দিন পর ভোর বেলায় দেখলাম, ওই নুরু ও খাদু বিভিন্ন গ্রাম থেকে মস্তান এনে নিজের
গ্রামকে আক্রমণ করল। সে কি গোলা গুলি! তির ধনুক নিয়ে মাঠে মাঠে অনেক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তবুও ওরা গ্রামে ঢুকতে পারল না। দেখলাম, নানা সাহস করে একাই গিয়ে নুরু আর খাদুর সঙ্গে
কি সব বলে এলেন। তারপর ওরা সকলে গ্রামের বাইরে দিয়ে অন্য গ্রামের দিকে চলে গেল। বাড়ির
পিছুনের মাঠে গিয়ে এসব দেখেছি। আগেই বলেছি, তখন রাস্তা ঘাট ছিল সম্পূর্ণ মাটির। আর
থানার দূরত্ব ছিল প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে। টেলিফোনের কোন যোগাযোগ ছিল না। ফলে তৎক্ষণাৎ
পুলিশ আসার কোন মানেও ছিল না।
এবার গ্রামের লোক সব একজোট হয়ে পড়ল।
যারা জোট হতে চায়নি তারাও গ্রাম ছাড়ার ভয়ে ওই জোটের পথেই পা দিল। প্ল্যান হল যে কোন
প্রকারে ওদের দুজনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তাতে পুলিশ প্রশাসন গ্রামের সঙ্গে
থাকবে। এমনকি গ্রামের পক্ষে এসপিও থাকবে।
একদিন সুযোগও চলে এলো। সময়টি ছিল ভোর
রাত। নুরু একটি গ্রাম থেকে একাই এক বড় মাঠ ভেঙ্গে অন্য গ্রামে যাচ্ছিল। গ্রামের লোকের
কাছে খবর আগেই ছিল। ফলে গ্রামের কিছু যুবসম্প্রদায় রাত থেকেই ওই মাঠে পাটের জমির আলে
আলে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিল।
নুরু যখন মাঠের মধ্যে তখন চারিদিক
থেকে ওরা ওকে ঘিরে ধরে। সেই বেড়া জাল ভেদ করে সে পালিয়ে এক গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয়
নেয়। ওরাও ছুটে এসে বাড়িটিকে ঘেরাও করে ফেলে। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় বাড়ির মালিক
সহ ওই পরিবারের সকল সদস্যকে। তারা কোন রকম প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। কারণ প্রতীবাদ
করলেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। এক বিশাল জনরোষের সম্মুখে ওরা দাঁড়িয়ে।
নুরু একটি ঘরে লুকিয়ে পড়েছিল। ঘরটি
ছিল পাটকাঠির বেড়ার তৈরি। চারিদিক থেকে শুরু হল বল্লম আর সড়কির খেলা। যদিও ঘরে নুরু
একাই তবুও কেউ সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারল না। কারণ ও নাকি বেশ শক্তিশালী জোয়ান পুরুষ
ছিল। ওরা বাইরে থেকে বল্লম সড়কি চালালেও নুরু অক্ষত ছিল। কিন্তু কয়েকজন দরজা ভেঙ্গে
সাহস করে ঘরে ঢুকে ওর বুকে বর্শা চালিয়ে দিল। ও আর অক্ষত থাকল না। অনবরত বর্শা আর সড়কির
আঘাতে ও একসময় মারা গেল।
কিন্তু ও মারা গেলে কি হবে? লোক তো
তখন রক্ত পিপাসায় উন্মত্ত। ফলে মৃত লাশের উপর চলল চরম নির্যাতন। মুখের কোন ছিরি থাকল
না। শত্রু নাশের চরম উল্লাস গাঁয়ে গাঁয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। নুরুর মা খবর পেয়ে সেখানে
ছুটে গেল। কিন্তু হায়! তার আপন সন্তানকে চিনতে পারল না। বলল, না ও আমার নুরু নয়।
তারপর একদিন শোনা গেল খাদু কোথায় হারিয়ে
গেল। ওই ঘটনার মাসখানের মধ্যে শোনাগেল নুরুর এক ছেলেকে কোন এক মাঠে জীবন্ত পুঁতে ফেলা
হল। অন্য এক ছেলে শত্রুনাশের জন্য বোম বাঁধতে গিয়ে নিজেই উড়ে গেল।
এত বড় এক একটা কাণ্ডেও কারো নামে এফ,
আই, আর হল না। পুলিশ প্রশাসন সব নীরব।
আমাদের গ্রাম থেকে কয়েকটি গ্রাম দূরে
এক শিক্ষককে মার্ডার করা হল। শুনেছিলাম, তার আঙ্গুল কেটে নেওয়া হয়েছিল। কারণ কোর্টে
তার পক্ষে কোন উকিলের প্রয়োজন হতো না।
এ সবই ছিল একটি সাংগঠনিক সুসংবদ্ধ
ও সুপরিকল্পিত হত্যা লীলা। যেদিন নুরু মারা গেছিল সেদিন নাকি মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে
এসেছিল। অনেকে বলেছিল রহমতের বর্ষণ আর কেউ কেউ বলেছিল নুরুর দুঃখে নাকি ওই বর্ষণ।
এমন অনেক ঘটনার পরে শুরু হল সি, পি,
আই (এম) পার্টির একচেটিয়া রাজ।
বিছানায় শুয়ে আলবেলার ঘরের কোঠার দিকে
তাকাতে তাকাতে কখন যেন চোখ বুজে ছোট বেলার সেই হাসি কান্নার দিনগুলিতে হারিয়ে গেছিলাম।
হঠাৎ চোখ মেলে দেখি আলবেলা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঈপ্সিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে
অপলক।
(চলবে)
হৃদয় বিদারক রোমহর্ষক সব বাস্তব ঘটনা। তখনকার সামাজিক দলিল।
ReplyDeleteআন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল।
Deleteনির্বাক হয়ে গেলাম।কোথা আলবেলার কাহিনী নিল মোড় নিল ডাকাত নুরু আর খাঁদুর কাহিনীতে। আরো উঠে আসলে এক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পরিবর্তে অন্য এক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এগিয়ে চল।
ReplyDeleteএভাবেই সমাজের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতির; রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সুস্পষ্ট এবং নির্ভীকভাবে এগিয়ে যাবে এই উপন্যাসের গল্প কাহিনী। ওপারের আয়নায় এপারে এপারের অনেক চিত্রই ফুটে উঠবে। সঙ্গে থাকার অনুরোধ রইলো। তার সঙ্গে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি
ReplyDelete