চৌদ্দ পোয়া
রাহুল পারভেজ
পর্ব – ৩
খবরটা
সাঁঝ রাতেই মহাজন পাড়ার চৌমুহনীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোদার বিলের দাঁড়ায় মাছে 'গাইন্ধ্যা'লেগেছে।
লুব্ধ জেকেরালী তাই ঝুঁঝকি রাতেই ঈষৎ পান্তা খেয়ে হাঁটা দেয়। হাতে তার পাঁচ-ফলা জোত।
শির
শিরানি শীতল হাওয়া বইছে। ঘামে ভেজা শরীরটাও দ্রুত ফরফরে হয়। হাঁটার ক্লান্তিটাও কেটে
যায়। পুব-আকাশে ধীরে ধীরে হলুদ রঙের আভা ফুটে উঠছে।দূরে জেলেরা মাছ ধরছে বাঁশজালে।
টিকলি চরের দিক থেকে ভেসে আসছে ভোরের আজান। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোয় বিলের চার-পাজর
যেন আলাদা এক মায়াবী জগৎ।
বিলের ধারে এদিক
ওদিক করতে থাকে জেকের। চারপাশে এক তীব্র আঁশটে গন্ধ। হঠাৎ ভ্রাম ভ্রাম শব্দে জল তোলপাড়
হয়ে ওঠে। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ছুটে আসছে ডুবে যাওয়া ধান ক্ষেত তছনছ করে। যেন পিছন থেকে
তাড়া করছে পদ্মা থেকে আসা কোন এক জল শুশুক!
কিন্তু
না। দেখা গেল সরসাবাদের তিন মাছ শিকারী বানে ডুবা ধান ক্ষেতে অনবরত মাছ জোত বিদ্ধ করছে
আর নায়ের খোল ভর্তি করছে।
নায়ের
খোলে জোতবিদ্ধ মাছেদের ছটফটানি আর মাছ শিকারীদের পাঁচ ফলার যৌথ আক্রমণে এক বৃহদাকার
মাছ ছুটে এসে কাশ-ঝাড়ে গোত্তা মেরে ঢুকে পড়ে।
জেকেরালী
দাঁড়িয়ে ছিল হাঁটু জলে। দৃশ্যটি চোখে পড়তেই
উদ্যত ফলা হাতে ছুটে যায় মাছটির দিকে। মাছটিও চকিতে একটি লম্বা রঙধনু জ্যা বানিয়ে
জেকেরালীর গাল ও কানসিকেতে তার বাঁকানো লেজের থাপ্পড় মেরে স্বশব্দে ঝাঁপ দেয় বিলের
গভীর জলে।
মাছটি
অদৃশ্য হতেই জেকেরালী কোমর জলে বেবাক বোকা বনে গিয়ে কাঁপতে থাকে। এটা কি মাছ না অন্য
কিছু!
মাছটির লেজ ও ধড়ের
আঠালো লালারসের তীব্র কু-গন্ধে তার বমি পায়। হঠাৎ সে ভুলে যায় কেন সে দাঁড়িয়ে আছে
বিলের জলে! মুহূর্ত পরে আবারও জল তোলপাড় শব্দ উঠে ‘ভ্রাম’। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ধাক্কায়
জেকেরের হাতের ফলাও টান টান। মৎস্য রাজা আবারও শব্দহীন।
সুবেহ সাদিকের ঠান্ডা
হাওয়া বইছে। তবু জেকের আলী ঘামছে। ঘাম আর আঠালো লালা রসের মিশ্রণ গড়িয়ে পড়ায় চোখ
তার ঝাপসা। গামছা ভিজিয়ে চোখের পাতা মুছে নিতেই দেখে সেই মাছের রাজা আরেক ঢোল কলমির
জঙ্গলে খোশ মেজাজে লেজ নাড়াচ্ছে।
জল
আলোড়ন এড়াতে গুটি গুটি এগুচ্ছে জেকের।
আর
মাত্র পাঁচ হাত। বামহাতের মুঠোয় পেঁচানো পাঁচ ফলার ডোর। ডান হাতে উদ্যত জোত। হাত আকাশ
মুখী হতেই মাছটি লেজে মোচড় দিয়ে দেহটা জেকের আলীর নিকেশ মাথার উপর উড্ডীন। এখনই গভীর
জলে ছুঁড়ে দিবে তার বিশাল বপু। জেকেরালী তড়িদ্বেগে পাঁচফলা জোতখানা আমুল বিদ্ধ করে
তার গর্দানের নরম তুলতুলে নিম্নাংশে।
ক্রুদ্ধ
মৎস্য রাজাও জোত সহ ডুব দেয় বিলের অপেক্ষাকৃত গভীর
জলে। ঢক ঢকিয়ে বিলের কাদাপানি ঢুকতে থাকে জেকের আলীর শূন্য
পেটে।
একটু পরেই মাছটিকে
কোমর জলে দেখা যায়। পাঁচ-ফলার বিষে মাছটি তখন কিছুটা কাতর।
এক জমাট কাশঝাড়ে
তার বিষ জর্জর দেহটা এলায়িত। উদ্গৃত তাজা রক্তে চারপাশের জলও লালে লাল।
জেকেরের
অবস্থাও তদ্রূপ। বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে মাছটিকে যে ডাঙ্গায় টেনে তুলবে সে শক্তিও নাই।
সরসাবাদিয়া মাছ শিকারীদের সে হাঁক দিতে থাকে।
তারা দ্রুত এসে দেখে
মানুষ সমান জোত বিদ্ধ এক রাঘব বোয়াল। তিনজনে মাছটিকে নৌকায় তোলে। মোটা রশি দিয়ে
পাটাতনে বেঁধে ফেলে। একটু জিরিয়ে নিয়ে জেকেরালীও নৌকায় উঠে পড়ে।
নৌকা
রওনা দেয় আখেরীগঞ্জ বাজার। মাছের আড়ত। দেড়মণি বোয়ালটা ডাকের দরে বিক্রি হয় পৌনে
দু’হাজার টাকায়। পঞ্চাশ টাকায় একটা দেড় সেরি ইলিশ কিনে টাঙ্গা চড়ে বাড়ি ফেরে জেকের।
সব
ঘটনা শুনে বিবি লালবানু বলে,তুমি আর কখনো রাইত-বিরেতে
মাছ ধর্ত্তে যাবা না, বুঝলা? মাছ আগে, না জান আগে? যাও গোসল করে আস। রুটি আর পাকা কাঁঠাল
আছে। খাইয়া লাও।
সাঁঝের
আজান আর ইলিশ মাছের গন্ধে ঘুম ভাঙ্গে তার। লালবানু বলে, ঘুম পেড়ে প্যাট ভরেছে?
এখুন একটু মোড়ে
যাও। চিনি নুন লঙ্কা ডাল আর জিরে লিয়ে আস। একটু হাঁটাহাঁটি কইরো, তাইলে শরীলের জংগুলাও
ছুটবে।
জেকেরালী
চায়ের দোকানে চা খায়। মুদিখানার সওদা নিয়ে বাড়ি
ফিরে ওসরায় বসে পড়ে। বলে, লালবিবি শুনছো, গোটা শরীলে আমার খুব ব্যথা।জ্বর জ্বরও করছে।
একটু তেল মালিশ কইরা দিব্যা না?
বিবি বলে--আগে খায়া
লও, তাপ্পর দিচ্ছি। আর এখুনি বল্যা রাখছি, কাইল তুমি খবদ্দার
মাছ ধত্তে যাবা না। উসরার চালাটা কাল মেরামত কৈরা দিও। ম্যাঘ হলেই পানি পড়ে।
ঘটি-বাটি
ধোয়া-মাজা শেষ হয়। লালবানু ঘরের বিছানা কাঁথা ঝেড়ে ডাক দেয়। ঘরে আস, মালিশ কইরা
দিই। জেকের একটু অবাক হয়। কত দিন পর এক বিছানায় ডাক
দিয়েছে লালবানু!
হাত-পা-কোমর-জঙ্ঘা-গর্দান
মালিশ করতে থাকে লালবানু। শিরদাঁড়া বেয়ে উত্তেজনার ঢেউ ফুঁসতে থাকে। নিঃশ্বাসে তার
উত্তপ্ত আগুনের হল্কা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না জেকের। লালবানুর শ্বাস-প্রশ্বাসেও
ঝড়ের ঈঙ্গিত স্পষ্ট। সেই উথাল পাথাল ঝড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয় দু’টি দুখী প্রাণ।
রাতের
সুখ নিদ্রার পর লালবানুর কথাগুলো জেকেরালী বেমালুম ভুলে যায়। আর এখন সে তো নাক ডাকিয়ে
ঘুমাচ্ছে। হাঁড়ির তলায় পড়ে থাকা পান্তা খেয়ে ক্ষেপ
জালখানা ঘাড়ে ঝুলিয়ে সে বেরিয়ে যায়।
রাস্তায়
পা দিতেই বিলাত মহাজনের সাথে দেখা।
--কি
রে, ভোর-পহাতে ভুমরি ঘাড়ে চললি কতি?
--যাব
ঐ চুলকাটির দাঁড়া। দেখি মাছ-টাছ কিছু পাই কিনা।
--যাচ্ছিস
যা, তবে একটা কথা শুইন্যা যা। আগামী জুম্বাবার
তোর আর লালবানুর জিয়াফত থাকলো। ঐ দিন বড় পোতার খাতনার খানা হবে। তাই কাল-পরশুর মইধ্যে
কাঠগুলান তোকে ফাইড়া দিতে হবে। বুঝলি?
--আচ্ছা..
আর দুইট্যা দিন আমাকে সময় দেন।
চুলকাটি
দাঁড়া আর শিয়ালগাড়ার জোলে খুব মাছ নামছে। রোজ রোজ তো আর মাছ হবে না? আপনার কাজটা
ঠিক সুমায়ে কইরা দিব।
--আচ্ছা,
কথাডা আবার ভুইল্যা যাস নে যেনে।
জেকের
চুল কাটির দাঁড়ায় জাল ফেলে ফেলে ক্লান্ত। রাত ভোর বানভাসি মাছ ফিরে গেছে ভৈরবে।
মাত্র
পোয়া তিনেক খুচরো মাছ নিয়ে ফিরতে হয় তাকে।
পর
দিন কাক ভোরে শিয়ালগাড়ার জোলে জাল ফেলেও একই হাল। এখানেও মাছের দেখা নাই। বিরক্ত
জেকেরালী গাব গাছের ছায়ায় বসে বিড়ি ধরায়। হঠাৎ দেখে এক ঝাঁক মাছ খলবল করে ঘুরপাক
দিচ্ছে এদিক ওদিক। ঝাঁকের উপর জাল ছুঁড়তেই সের দু'য়েক মাছ জালবন্দি হয়। আরও কয়েক
ক্ষেপ জাল ফেলে সের খানেক মাছ নিয়ে জেকের আমবাগানের পথ ধরে।
বিলাত
মহাজন ধরাটে বসে ছিলেন। তাকে দেখেই হাঁক দেন, কিরে জেকের
কি রকম মাছ পেলি? আয়, এদিকে আয় দেখি।
কাছে
যেতেই খলুয়ে হাত ঢুকিয়ে সিয়ানা মাছগুলো তুলে নিয়ে বলেন, এখন বাড়ি যা। কাইল কে
কাঠ ফাড়াই শেষ হলে মজুরির সাথে আরও দশ টাকা ধইরা দিব।
--এইডা
কি বুলছেন চাচা! কম কইরা দেড় সের মাছ। কুড়ি টাকা তো হবেই।
-- আমারে বিশ্বাস নাই! কাইল কাঠ-ফাড়াইটা ঠিক ঠাক কইরা দিস। তোর মাছের দাম পনের টাকা দিয়া দিব।