১
খোঁজ
আমাকে পাওয়ার জন্যে ব্যকুল হয়ে জন-অরণ্য
ভেদ করে চলতে শুরু করলাম। এ যেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য এক পথিক। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে
চলেই যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, জানি না। কোথায় আমি? কোন রহস্যের ঘূর্ণিতে পড়ে দিশেহারা
হয়ে পড়েছি?
আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম একটি বিশাল
মাঠের সামনে। মাঠের মাঝে বিভিন্ন রকমের বড় বড় ঝাঁকড়া মাথার গাছ। মাঠ কিন্তু সমতল নয়।
ঢেউ খেলানো। অনেকটা চড়াই উতরাই সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত পুরো মাঠ। এখানে কোন ফসল নেই। কোন
মানুষ নেই। যাকে বলে জনশূন্য খাঁখাঁ প্রান্তর।
সেই সব চড়াই উতরাই পার হতে হতে অবশেষে
একটি নদীর ধারে এসে পৌঁছালাম। ততক্ষণে চারিদিক পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঝাঁ চকচকে দিন। কিন্তু
আকাশে সাতটি ছোট ছোট সূর্য একটি বৃত্তের আকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি মনোরম হাসি নিয়ে
দিনটি উদ্ভাসিত হয়ে আছে। মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। আকাশে এক টুকরও মেঘ নেই। নদীর
বুকে তাকালে আকাশটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেবল স্পষ্ট নয়, সরাসরি আকাশ দেখতে যেমন
সুন্দর দেখায় তার চেয়েও আকাশের সৌন্দর্য আরো অনেক অনেক সুন্দর। অনেক অনেক আকর্ষণীয়।
ফুরফুরে বাতাস হালকা শীতলতার পরশ দিয়ে সব সময় একইভাবে বয়ে চলেছে। মাঠে আর আকাশে সুন্দর
পাখিরা আপন খেয়ালে খেলে বেড়াচ্ছে।
মাঠের মধ্যেই নদীটি। ভারি সুন্দর ছোট্ট
একটি নদী। অতি হালকা নীল-সবুজ পানি। এত স্বচ্ছ পানি! নদীর গভীরের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে।
ছোট ছোট ঢেউ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে পানি। তার কোন কূল ভাঙ্গেনি। ভাঙ্গার
কথাও নয়। এত শান্ত পানি! এত সুন্দর নহর! কখনো কি কূল ভাঙ্গতে পারে? দুপারে সারিসারি
নানান প্রকৃতির গাছ, যেন নদীর সাথে সাথে হেঁটেই চলেছে বরাবর। ওরাও কি ওদেরকে খুঁজে
চলেছে? যতদূর চোখ যায় নদীটি তীরের মতো সোজা চলে গেছে। বোঝা যাচ্ছে না এ কোন সাগরের
সাথে মিশেছে, না সোজা আকাশের বুক ভেদ করে অনন্ত লোকে চলে গেছে।
হতাশ হয়ে আমি নদীর ধারে বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পর চোখের সামনে দিয়ে কেবল সাদা সাদা সারসের দল সারি বেঁধে নদীর বুক বরাবর
উড়ে যাচ্ছে। মাঝখানে একটি সারস। তাকে অনুসরণ করে দুদিকে দুটি লাইন ত্রিভুজের মতো চলে
গেছে। একদম বিরাট একটি তীরের ফলা। যেন একটি দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে ভেসে চলেছে। ওরাও
কি তাহলে অনন্ত লোকের দিকে চলে যাচ্ছে!
কাছাকাছি কোন এক গাছ থেকে একটি পাখি
বিষণ্ণ সুরে গেয়ে যাচ্ছে, পিউ কাহা, পিউ কাহা।
আমার মতো সেও কি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে?
না কি ওর একমাত্র প্রিয় সাথীকে হারিয়ে ফেলেছে?
এত সুন্দর পরিবেশেও যেন বিষণ্ণতা থমকে দাঁড়িয়ে আছে কেবলমাত্র ওই পাখিটির জন্যে।
এত সুন্দর পরিবেশেও কি দুঃখ থাকে! বেদনা থাকে! কি জানি, কিছুই বুঝতে পারছি না।
সময় গড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে বোঝা
যাচ্ছে না। হয়তো এখানে সময় বলে কিছুই নেই। এখানে বৃত্তাকার সূর্যমালা এদিক ওদিক ঘুরে
বেড়াচ্ছে। এখানে চাঁদ, তারা আছে কি জানি না। এখানে কি সময় বলে কিছু আছে? কি জানি! হয়ত
আছে অথবা নেই।
আস্তে আস্তে হতাশা আমাকে চরমভাবে গিলতে
শুরু করেছে। এমন সময় বহুদূরে একটা মানুষের চিহ্ন দেখতে পেলাম। আমি ওই মানুষটির দিকেই
তাকিয়ে রইলাম। হয়তো ওটা আমি হতে পারি। অস্পষ্ট মানুষ থেকে ও ধীরে ধীরে স্পষ্ট মানুষে
পরিণত হচ্ছে। আর যতই স্পষ্ট হচ্ছে ততই মনে হচ্ছে ও একটি মেয়ে মানুষ। জানিনা কোথায় যাচ্ছে,
তবে মনে হচ্ছে এদিকেই এগিয়ে আসছে। ও কি আমার দিকেই আসছে? আমার কাছেই বা কেন ও আসতে
যাবে? যেখানে একটি মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই, সেখানে হঠাৎ কিভাবে একটি মেয়ে এ মাঠে একাকি
ঘুরে বেড়াচ্ছে? আমি কোন জগতে বাস করছি? সব কিছুই রহস্য রহস্য ঠেকছে। আর মেয়েটি এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসছে। সে আসুক
বা যাক, তাতে আমার কিইবা যায় আসে? আমি তো আমাকেই পাচ্ছিনা।
মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে
আবার নদীর দিকে তাকালাম। নদীর দিকে তাকালেই অনেকটা প্রশান্তি ফিরে পাচ্ছি। গাছপালা,
আকাশ, পাখির প্রতিচ্ছবি এত সুন্দর ফুটে উঠছে মনে হচ্ছে নদীর বুকেও অন্য একটা জগত আছে।
ওটি হয়তো আরও সুন্দর। আরও জীবন্ত। ওখানেও কি মানুষ আছে? সেখানেও কি যাওয়া যায়?
হঠাৎ মনে হল, এই নদীর নাম কি হতে পারে?
মনের মাঝে প্রশ্নটি উঁকি মারতেই পাশ
থেকে একটি উত্তর ভেসে এল, নন্দিতা।
বাহ! ভারী সুন্দর নাম তো! নদীর নাম
নন্দিতা হয়? প্রশ্নটা করেই পাশ ফিরে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। কে! কে উত্তর দিল!
শিহরে উঠলাম।
আমার সঙ্গে কি কেউ আছে? বিড়বিড় করলাম।
কোন উত্তর নেই। আবারও প্রশ্ন, কে, কে উত্তর দিল? বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগলাম। কাউকে
দেখতে পেলাম না। কণ্ঠটা কোন এক নারীকণ্ঠ বলে মনে হল। তাহলে কি আমার সঙ্গে কেউ আছে?
অদৃশ্য কেউ! আর কোন প্রত্ত্যুতর পেলাম না। হয়ত এভাবেই না থেকেও কেউ অদৃশ্যের অন্তরালে
থেকে যায়। যাকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। তবুও, তবুও থেকে যায়।
বারবার এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে
আবার ওই মেয়েটির উপর চোখ পড়ল। ও অনেক কাছে চলে এসেছে। এখন ওর পোশাকের রঙও বোঝা যাচ্ছে।
সাদা পোশাক। সাদা পোষাকে ওকে দেখতে দারুণ সুন্দর লাগছে।
ও যতই কাছে আসছে ওর পোষাক, ওর দেহ,
ওর মুখ ততই স্পষ্ট দেখাচ্ছে।
ও যখন অনেকটা কাছে চলে এল। দেখলাম,
ওর শরীরটা সাদা সালোয়ার কামিজে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। বুকের উপরে সাদা উর্ণা। ওর হাঁটার
তালে তালে কোমর পর্যন্ত নেমে যাওয়া খোলা চুল উথলে উঠছে। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে পিঠের
উপর আছড়ে পড়ছে। যেন মিশকালো সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ ওর পিছুন পিছুন ধেয়ে আসছে।
আমি অবাক হয়ে দেখছি, কেবল দেখছি। আরো
আশ্চর্যের বিষয়, ও যে গাছের তলা দিয়ে আসছে সেই গাছই সাদা সাদা চমৎকার ফুলে ভরে উঠছে।
এমন কেন হচ্ছে? কি করে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এ যেন এক অদ্ভুত জগত! অদ্ভুত পৃথিবী!
তা না হলে সব কিছুই অদ্ভুত, অদ্ভুত লাগে? চোখের সামনে খেলে বেড়াচ্ছে প্রকৃতির যাদুমাখা
খেলা। ভয় লাগছে আবার ভালও লাগছে।
ওই মেয়ের প্রশন্ন হাসির রেণুতে সারা
মুখ নিঃশব্দ আনন্দধারায় প্রজ্বলিত হচ্ছে। ওর হাঁটার ছন্দই আলাদা। দারুণ সুন্দর তাল-লয়ে
হেঁটে আসছে। এতটা পথ পেরিয়ে এসেও দেহে মুখে কোন ক্লান্তির ছাপ নেই। ঘাম নেই চিবুকের
প্রান্তরেখায়।
শেষপর্যন্ত ও আমার সামনে এসে থমকে
দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে আর ও আমার দিকে। সারা মুখমণ্ডলে বাসন্তিক জ্যোৎস্না।
ও আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে; যেমন আকাশ আর পৃথিবী মুখোমুখি থাকে স্থির।
I am charmed by the first part of this novel.
ReplyDeleteউপন্যাসের প্রথম পর্ব পড়লাম। শুরুটা তো দারুন হয়েছে। জাদু বাস্তবতার মোড়ক বন্দী করে শুরু করেছো।নদীর নাম নন্দীনী! কে! কে! উত্তর দিল! অসাধারণ। By - রাহুল পারভেজ
ReplyDeleteকৃতার্থ হলাম। আপনার আন্তরিক অনুপ্রেরণা সঙ্গে রইল। ধন্যবাদ অনন্ত।
Delete