Jahan Kosha Cannon, Lalbagh, Murshidabad/তোপখানা জাহান কোষা কামান

 

(মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ-৩)

তোপখানাঃ জাহান কোষা কামান

    আজিজুল হাকিম

 

সেদিন পড়ন্ত বিকেলে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম তোপখানায়। চারিদিকে সবুজ গাছপালা আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা একটি নির্জন, নিরিবিলি পরিবেশ। নবাবী আমলের তৈরি এই বিশাল কামনাটি দুটি স্তম্ভের উপরে শুয়ে আছে একাকি। যেন আজও অতীত গৌরবান্বিত স্মৃতি বুকে নিয়ে আত্মমগ্নতায় বিভোর হয়ে আছে।

কাটরা মসজিদ থেকে পূর্ব-দক্ষিণ কোনে প্রায় এক কিলোমিটার আর মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গোবরা নালার পাশে বিশাল কামানের অবস্থান। এখানে গোবরা নালাকে আবার কাটরা ঝিলও বলা হয়ে থাকে। এই জায়গাটির আসল নাম হল তোপখানা।

(ব্রিটিশ আমলে নদীর ধারে বট গাছের শিকড়ের উপরে কামনা)

 এর ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা অনেক কিছুই দেখতে পাই। এই কামানটির নাম ‘জাহান কোষা’। ‘জাহান কোষা’  শব্দের অর্থ ‘বিশ্বজয়ী’। নবাবী আমলে এটি নদীর ধারে চারটি চাকার উপরে থাকত। পরে কোন ক্রমে এগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর এই কামানের পাশে একটি বট গাছের জন্ম হয়। বট গাছটি বড় হলে এর শিকড় দিয়ে কামানটিকে ধরে থাকে। এমনকি এই গাছটি শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উপরে তুলে ধরে ছিল। এভাবে চলে যায় বছরের পর বছর। নদী তার গতিপথ বদলে ফেলে। কামান থেকে কিছুটা উত্তরে চলে যায়। কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যায় সেই বট গাছ। তারপর অনাদর আর অবহেলায় কিছু কাল মাটির উপর পড়ে থাকে সেই বিশ্বজয়ী কামান। পরবর্তীতে পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। ফলে এর চারিপাশের কিছুটা অংশ ঘিরে এটিকে দুটি খুঁটির উপরে তুলে রাখা হয়।



এটি মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করা হয়। সেই সময় বাংলার সুবেদার ছিলেন ইসলাম খান। সেই সুবেদারের অধিনস্ত কর্মচারী দারোগা শেরে মোহাম্মদের নির্দেশে জনার্ধন কর্মকার জাহান কোষা কামনটি তৈরি করেন। এর তত্তবধায়ক ছিলেন হারা বল্লভ দাস।



(কামনার উপরে ফার্সীতে লেখা ফলক)

এই বিশ্বজয়ী কামানের সব চেয়ে বড় বিষয় হল এটি অষ্ট ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি হয়। অর্থাৎ আট প্রকার ধাতুকে মিশিয়ে এই কামানটিকে তৈরি করা হয়। এতে আছে সোনা, রুপো, তামা, দস্তা, সীসা, পারদ, লোহা আর টিন। এর পিঠের উপরে সুন্দর ফুলের কাজ করা আছে। সামনে এবং পিছুনে সুন্দর করে খাঁজ কাটা আছে যেন সহজেই শিকল দিয়ে কামানটিকে কোন যানবাহনে তোলা আর নামানো যায়। এছাড়াও পিছুন দিকে চারিদিক বেড় দিয়ে ফুলের মতো কাজ করা আছে। তাছাড়া এর উপরে টিনের ফালিতে ফারসি শব্দে এই কামানের তৈরির ইতিহাস সংক্ষেপে লেখা হয়েছে।



এই কামানটি ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা। এর বেড় ৫ ফুট। এর ওজুন ২২৮ পাউন্ড। এর ভিতরে ২৮ সের গোলা বারুদ ভর্তি করে শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হতো।

এক সময় সাধারণ মানুষেরা এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করত। এই কামানের দেহে তেল আর পারদ মাখিয়ে দেওয়া হতো। এমন কি গভীর শ্রদ্ধায় এটিকে উদ্দেশ্যে ফুল, দুধ আর মিষ্টি দেওয়া হতো। ছোটবেলায় শুনতাম এটি জীবন্ত একটি কামান। এর বালাগুলি নাকি এখন বড় হয়। অবাক হতে হয় যে আজও খালি হাতে সামনে থেকে পিছুনে বা পিছুন থেকে সামনে মাপলে কম করে ছয় ইঞ্চি ছোট বড় হয়ে যায়।



         

 

Post a Comment

Previous Post Next Post