AJOB DESH-2/AZIZUL HAKIM

 


আজব দেশ-২   

        আজিজুল হাকিম

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রখর রোদের ঝালাসে দেহ প্রাণ উফ আফ করছিল। এদিকে কারেন্টেরও লোডশেডিং চলছে। গ্রামের কারেন্টের এটি একটি চরম বদ অভ্যাস। গরমের আভাস পেলেই গরম ভাতিতে ঘুমিয়ে পড়ে। কোন রকম সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। গ্রামগুলি বিদ্যুতবিহীন জীবন অতিবাহিত করে রাতদিন। গরমের দাপটে মানুষগুলি কেবল ছটপট করে যায়। রোদে গরমে মাঠে কাজ করে বাড়ি ফিরে ফ্যানের তলায় দেহটি একটু এলিয়ে দেবে তার জো নেই। এমনকি কোন কোন রাত সারা গ্রাম অনিদ্রায় কাটিয়ে দেয়। আবার বর্ষার মরসুমে মেঘ দেখলেই, কখনো বা কয়েক ফোটা বৃষ্টি বিদ্যুতের তারে পড়লেই মাঠের ছাগলগুলির মতো দেয় ছুট। এক দৌড়ে বাড়ি। তারপর ঘন্টার পর ঘণ্টা তার কোন দেখাই পাওয়া যায় না।

       সে দিনটি ছিল তেমনি একটা দিন। কি করি, কি করি ভেবে বট গাছের কথা মনে পড়ে গেল। বটতলায় গিয়ে বসলে মন্দ হয় না। বাতাস না থাকলেও গাছের তলা অবশ্যই ঠাণ্ডা থাকবে।

       সেই আশায় বটতলায় চলে গেলাম। কিন্তু গেলে কি হবে? কপালে এক ফোটা শান্তি লেখা থাকলে তো পাওয়া যাবে? যাকে বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল।

       ওই যে মৃণাল দাদু, যার সংস্পর্শে যেতে ভয় পাই, সেই উনি ওখানে বসে আছেন।

       আমাকে দেখেই এক গাল হাসি হেসে বললেন – আরে আজিজ নাকি! আয়, আয়। কতদিন তোকে দেখিনি! গালগল্পও হয়নি।

-      আপনার গল্প শুনতে এখানে আসিনি, দাদু।

-      আর তা কি কেউ খাস করে আসে? এই এলি। দেখা হল। পাঁচমিশালি

কথা হবে আর কি।

-      কিন্তু আপনার আজগুবি বকম বকম একদম ভাল লাগে না আমাকে।

-      হ্যাঁ সে তো বলবিই। আজ আছি, কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু যেই মরে যাব তখন

অভাব বুঝবি। আমিও নেই আর গল্প শোনানোর লোকও নেই।

-      তা হয় তো হবে; তবে এখন তো হচ্ছে না।

-      তার মানে তুই আমাকে মরে যেতে বলছিস?

-      তা বলব কেন, দাদু? আপনি মরে গেলে সত্যি খুব কষ্ট পাব।

-      সে তো পাবিই। পেতেই হবে। এমন দাদু সারা পৃথিবীতে একটিও পাবি না।

-      তা ঠিক বলেছেন। যাহোক কেমন আছেন বলুন?

-      কেমন আর থাকব? যখন তোদের সঙ্গে একটু গল্প সল্প হয় তখন ভাল থাকি আর

যখন তোদের দেখা পাই না তখন আর ভাল থাকতে পারি না। তাছাড়া ভাল নাতি বল আর ভাল বন্ধুই বল; তুই ছাড়া আমার কেউ নেই।

-      তাহলে আমাকে কি করতে হবে; যাতে আপনার কাছে আরো ভাল হতে পারি?

-      আরে কি আর করবি? কিছুই না। কেবল মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবি আর

একটু গালগল্প হবে আর কি?

-      তাহলে শুরু করুন।

       দাদু প্রসন্ন হলেন। তারপর শুরু করলেন, “কি আর বলব! কিছু দিন আগে একটা দেশ থেকে ঘুরে এলাম।”

-      কি কি দেখলেন?

-      তেমন কিছুই না। আবার অবাক করার মতই কাণ্ড।

-      কি রকম?

       দাদু এবার নড়ে চড়ে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, “ওই রকম দেশ আমি লাইফেও দেখিনি।”

       আমি বললাম, “কেন, দাদু?”

       দাদু বললেন, “সে কথা আর বলিস না। আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সেকি আর রাস্তা! আমাদের মতো ঝাঁ চকচকে রাস্তা না। রাস্তার মাঝে বড়বড় পুকুর। সেই পুকুর রীতিমত জলে ভর্তি। জল এত ঘোলা যে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে পাড়ার ছেলে মেয়েরা জলে নেমে মাছ ধরে নিয়ে গেল। আমার সামনেই একটি গাড়ি রাস্তা দিয়ে যেতে পুকুরে নামল। তারপর কি কাণ্ড! গাড়ি আর উঠে না। আর সেই গাড়ির গোঁ গোঁ করে কি গর্জন! মনে হচ্ছে কোথাকার দানব এসে ভয়ঙ্কর চিৎকার শুরু করেছে। যেন সব কিছু ভেঙ্গেচুরে লণ্ডভণ্ড করে দেবে।

       যাহোক, অবশেষে খুব কষ্ট করে যখন গাড়িটি প্রায় রাস্তার উপরে উঠছে; ঠিক তখন গাড়ি গেল পাল্টি খেয়ে। আবার সেই খাঁদে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল। গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মারা গেল গোটা দশেক মানুষ। যারা হাত-পা ভেঙ্গে উঠার চেষ্টা করল তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে কাদার তৈরি হুনুমানের দল। কাদা জলের মধ্যে চভাং চভাং করে পড়ছে। আমি সব বসে বসে দেখলাম। কি আনন্দ বল?”

       আমি বললাম, “আনন্দ না, ছাই! মানুষ কষ্ট করছে আর আপনার আনন্দ, তাই না?”

       দাদু বললেন, “অমন অদ্ভুত মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। যখন কান্না করছে তখন দাতগুলো ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

       আমি বললাম, “ওসব কথা বাদ দিন, দাদু,। অন্য গল্প বলুন।”

       দাদু মৃদু হাসি হেসে বললেন, “তাহলে শুনবি আর একটি মজার দেশের কথা?”

       আমি বললাম, হুঁ, শুনবো।”

       উনি শুরু করলেন, “আমি আর একটি দেশের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। চারিদিকে সবুজ ফসলে ভরে উঠা বিশাল মাঠ। সেই মাঠ পার হয়ে একটি গ্রাম। সেই গ্রামে ঢুকেই দেখলাম একটি লোক। লোকটি নেঙ্কটি মেড়ে লুঙ্গি পড়ে আছে। মাথায় ঝুড়ি। ও চিৎকার করে হাঁক দিয়ে বলছে, ‘চাকরি নেবে গো…চাকরি!’ আমি বললাম, ‘বাবা, ঝুড়িতে কি আছে বললে?’ ও বলল, দাদু আপনার বয়স শেষ। এসব দিকে মাথা ঘামিয়ে কোন লাভ নেই।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ ও বলল, ‘আরে মশায়, এই ঝুড়িতে চাকরির কাগজপত্র আছে। ঝুড়িতে হরেক রকম চাকুরী। বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন রঙের চাকরি। একেকটা রঙের চাকরির দাম একেক রকম। আমি বললাম, ‘চাকরির দাম কেমন?’ ও বলল, ‘এক একটা চাকরির দাম এক এক রকম। পাঁচ লাখ থেকে শুরু আর পঞ্চাশ লাখ টাকায় শেষ।’ আমি ওকে বললাম, ‘তুমি কতদূর পড়াশুনা করেছ?’ ও মাথাটা নিচু করে বলল, ‘আরে দাদু, আমি তো স্কুলের মুখই দেখিনি। চাকরি বক্রির ঠিকাদারি নিয়েছি। এতে আমারও কমিশন থাকবে আবার ওই যে রাজা, উজির, নাজির ওদেরও থাকবে।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা তুমি তো পড়াশুনাই জানো না; তাহলে চাকরি বেচার ঠিকাদারি কিভাবে পেয়েছ?’ আরে দাদু, আপনি হচ্ছেন সেকেলে লোক আপনি ওসব কিছু বুঝবেন না। এসব ঠিকাদারী পেতে পার্টিতে নাম লেখাতে হয়। মস্তানি করতে হয়। প্রয়োজনে কিছু মানুষকে এই জগত থেকে ছুটি দিয়ে ওই উপরে পাঠিয়ে দিতে হয়। কিছু বুঝলেন?’ কিছুক্ষণ থেমে বলল, ‘ওসব ছাড়ুন তো। আমার সময়ের প্রচুর দাম।’ আমি কিছুক্ষণ থেমে বললাম, ‘এসব কাজ শিক্ষিতরা করছে না কেন?’ ও হেসে বলল, ‘ওদের দিয়ে কোন কাজ হবে না। শিক্ষিতদেরকে এসব কাজ দেওয়া হবে না। দিলে অনেক হ্যাঙ্গামা। ওরা তো কাগজ-পত্র সব বুঝে, কখন যে কি করে বসবে তার হিসেব থাকবে না। তখন বাবুদের চেয়ার হেলতে দুলতে লাগবে। তার চেয়ে আমাদেরকে দিয়ে কাজ করালেই সেফটি। দেখছেন না কোন অফিস দালাল ছাড়া চলছে না। আর সেই দালাল কারা জানেন? যারা স্কুলের দরজা চোখেই দেখেনি তারাই।’ এই বলেই সে চলে যাচ্ছিল, আমি ডেকে বললাম, ‘আর একটা কথার উত্তর দিয়ে যাও, ভাই।’ ও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আরে মশায়, আমার বকম বকম করার মতো ফালতু সময় নেই। বলুন, আর কি বলবেন?’ আমি বললাম, ‘তাহলে তো গরীবের শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা আর যোগ্য ব্যক্তিরা চাকরি পাবে না? তাছারা যদি অযোগ্য লোকের হাতে চাকরি যায় তাহলে তো কোন দপ্তরের কাজ সঠিকভাবে হবে না?” ও বলল, মাথা খারাপ? সঠিক কাজ হবে? এই দেখুন একটা ছেলেকে চাকরি দিয়েছি। শালা, কারোরই নাম সঠিক করে লিখতে জানে না। আমাদের পাড়ার আস্ফাকুল হকের নাম ভোটের ছবিতে কোন দিন ঠিক এল না। কখন এলো আসোফাকুল, কখন এলো আফফাকুল আবার কখন ওর নামের জায়গায় ওর বাবার নাম আর বাবার নামের জায়গায় ওর নাম দিচ্ছে। বেচারি অফিসারদের গোষ্ঠীকে গাল দিতে দিতে মারা গেল। আশি বছরে মারা গেল তবুও বার্ধক্য ভাতা পেল না। এই হচ্ছে আমাদের দেশের দশা। বুঝলেন? এর পর থেকে দেখবেন অফিসের সামনে লম্বা লাইন; কিন্তু কারো কাজ সঠিক হবে না। মানুষ রাতদিন কেবল কাগজ নিয়ে দৌড়াবে। আর সেই সুযোগে রাজা খাঁজা চুরি করে খেয়েই যাবে।”

       আমি বললাম, তাহলে তো দেশে শিক্ষিত লোক খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আর রাজারা ভগবান হয়ে বসে থাকবে।

       দাদু বললেন, আর বলছিস! সেদিন ওই দেশেই দেখলাম যত ধর্মগুরুরা রাস্তার ধারে বিশাল সমাবেশ করে বলছে, রাজাই মোদের ভগবান, রাজাই মোদের আশা / রাজা ছাড়া এই জগতে মোরা ভাগ্যনাশা।"

       আমি বললাম, দাদু অমন মূর্খ, মেরুদণ্ডহীন দেশের কথা আর বলবেন না। ওই সব দেশ পৃথিবীতে না থাকাই ভাল।

Post a Comment

Previous Post Next Post