নজরুল-প্রমীলা-মোঃ শাহেদুজ্জামান

 

নজরুল পত্নী প্রমীলা দেবী এবং

নজরুল-প্রমীলার প্রেমের ইতিহাস

   মোঃ শাহেদুজ্জামান

     বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রমীলা-নজরুল’ গ্রন্থে লিখেছেন- “আমরা যদি পৃথিবী ব্যাপী কবি সাহিত্যিকদের জীবনীপঞ্জি খুঁজে দেখি, সংগত ভাবেই দেখতে পাবো, পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মেলবন্ধনে সৃজনীশক্তির অসামান্য বিকাশ ঘটেছে দেশে, দেশান্তরে। যে প্রতিভাটি বিকশিত হল তার আড়ালে নিয়ামক শক্তি হিসাবে রয়ে গেল আরো একটি প্রতিভা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আড়ালের এই শক্তিটি লোকচক্ষুর অগোচরে থেকে যায়। মানুষ তার খোঁজ পায় না কখনো। বহুক্ষেত্রে খোঁজ রাখতেও চায় না। ফলে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

জাতীয় কবি, বিদ্রোহী নজরুল জনমানসের কবি। ভারতীয় উপমহাদেশের মুক্তির অন্যতম প্রধান কবি-সারথি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য পর্যালোচনা করলে আমরা উপরোক্ত সত্য-বীক্ষণে স্থিত হতে পারি। তাঁর ঝঞ্ঝাবহুল ও তীব্র গতিময় জীবনে বড়ো একটি অংশে দক্ষ কাণ্ডারীর মত হাল ধরেছিলেন তাঁর সহধর্মিনী প্রমীলা নজরুল ইসলাম।”

       কবি পত্নী নিজেও ছিলেন কবি। কবিতা এবং কবির প্রতি ছিল তার দুর্বার আকর্ষণ।

শুধুমাত্র বাল্যজীবনেই নয়, বিবাহ পরবর্তীতে প্রমীলা দেবী তাঁর সাহিত্য চর্চা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। তাঁর লেখা কবিতা দ্বি মাসিক ‘সাম্যবাদী’ পত্রিকায় ১৩৩২ সালের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।    

 

       এই কবিতাটিই ‘সওগাত’ পত্রিকার মহিলা সংখ্যায় পুণর্মুদ্রিত হয়ঃ

শঙ্কিতা,

কেন আজি প্রাণ মম বেদনায় বিহ্বল

কেন আজি অকারণ চোখে আসে জল।।

সন্ধ্যার সমীরণ হু হু করে বয়ে যায়

বয়ে যায় মোর মন করে কেন হায় হায়।

কেন বেদনায় মম বুক আজি কম্পিত

কে জানে গো হিয়া মাঝে কত ব্যথা সঞ্চিত।।

বেলা শেষে নীলিমায় চেয়ে আছে অনিমিখ্

কে ছড়ালে বিদায়ের সিন্দুর চারিদিক।

কিছুই বুঝিনা হায় কেন প্রাণ ভারাতুর

কে দিল হৃদয়ে বেঁধে মল্লার-রাগসুর।

মনে হয়, এ নিখিলে কেহ নাই, নাই মোর

তুমি বলো কি সন্ধ্যা, কেহ নাই, নাই তোর।।

      

       তার লেখা আরও একটি কবিতা ১৩৩২ সালে আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ঃ

করুণা,

সেই ভালো তুমি যাও ফিরে যাও

মোর সুখনিশি হয়েছে ভোর

সেধে সেধে কেঁদে থাকি পায়ে বেঁধে

ভেঙ্গেছে সে ভুল ছিঁড়িনি ডোর্।।

জনমের মতো ভুলে যাও মোরে

সহিব নীরবে যাও দূরে সরে

করুণা করিয়া দাঁড়ায়োনা দোরে

পাষাণ এ-হিয়া বাঁধিব গো।।

চিরদিন আমি থাকিব তোমার

কাঁদিবে বেহাগ কণ্ঠে আমার

আপনি একলা কত স্মৃতি হার

গাঁথিব ছিড়িব কাঁদিব গো।।

প্রাণ নাহি চায় দায়ে ঠেকে আসা

একটু আদর কিছু ভালোবাসা

চাইনা কো আমি ঘুমের কুয়াশা

থাকুক জড়ায়ে নয়নে মোর।।

দোষ করে থাকি ক্ষম মোরে ক্ষম

সুখী হও তুমি প্রার্থনা মম

চাহিনাকো সুখ, ভিখারীর সম

সেই ভালো তুমি হও কঠোর।।

 

       কাজী নজরুল যে মাপের মানুষ এবং শিল্পী ছিলেন, সমাজ ও দেশের গঠনে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গী; তা সে সময়ের পশ্চাৎপদ সমাজ যেমন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল, তেমনি আজকের এই মুক্ত এবং তথাকথিত আধুনিক সমাজও তাঁর সেই উদার দৃষ্টিভঙ্গী কতটুকু বুঝতে বা মূল্যায়ন করতে পেরেছে সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে।নজরুল প্রমীলার সাথে সারাজীবন একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবন যাপন করেছেন। প্রতিকূলতার মধ্যে আদর্শিক কারণে নানা অবিচার সহ্য করে তাঁকে বাস করতে হয়েছে। তারপরও দুজন দুজনকে ভালবেসেছেন।

       ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মে (রবিবার ২৭ বৈশাখ, ১৩১৫ বঙ্গাব্দ), মানিকগঞ্জ জেলার শিবলায় উপজেলার তেওতা গ্রামে প্রমীলা নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বসন্তকুমার সেনগুপ্ত, মায়ের নাম গিরিবালা সেনগুপ্তা। শৈশবে পিতৃহারা হলে, গিরিবালা সেনগুপ্তা তাঁর দুলিকে (প্রমীলা) নিয়ে, তাঁর দেবর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।

       প্রমীলার প্রতি নজরুলের প্রেম জেগে ওঠে নার্গিসের সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর। নার্গিসের সাথে নজরুলের বিয়ে ছিল একটা ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের অবসানের পর নজরুল ভীষণ মানসিক কষ্ট পান। এই কষ্টের অবসান ঘটে প্রমীলার সাথে প্রেমের পর। প্রমীলার বয়স যখন ১৩ বছর তখন নজরুলের সাথে পরিচয়। নজরুলের বয়স সেসময় ২১/২২ বছর। সদ্য সেনাবাহিনী থেকে ফিরে আসা তরুণ। নজরুলকে প্রমীলা দেখেছিলেন কলকাতা থেকে বিয়ে করতে আসা বর হিসেবে। বিয়ের জন্য নজরুল এসে ওঠেন তাঁদের বাড়িতেই। তাঁদের বাড়িতে ওঠার কারণ বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত। বীরেন্দ্রকুমারের পিতা ও প্রমীলার পিতা ছিলেন আপন দুই ভাই।

       বীরেন্দ্রকুমার ছিলেন কুমিল্লার দৌলতপুরের আলী আকবর খানের স্কুলের বন্ধু। আলী আকবর খান তখন কলকাতায় থাকতেন। বাচ্চাদের বইয়ের একটা প্রকাশনা ছিল তাঁর। তিনি নজরুলের কাছে থেকে ‘লিচুচোর’ নামে একটি কবিতা লিখিয়ে নেন। এই কবিতায় নজরুলের প্রতিভার পরিচয় জেনেই তাঁকে নিজের কব্জায় রাখার ফন্দি আঁটেন। তাই তিনি নজরুলকে ফুসলিয়ে কলকাতা থেকে কুমিল্লায় সাথে করে নিয়ে আসেন । উদ্দেশ্য নিজের বিধবা বড় বোন আসমাতউন্নেসার মেয়ে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সাথে বিয়ে দেওয়া। নিজের বোনের মেয়ের সাথে নজরুলকে বিয়ে দেয়ার জন্য কলকাতা থেকে এনে নিজের বাড়িতে সরাসরি না উঠে কুমিল্লারই কান্দিরপাড়ে বাল্যবন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে ওঠেন।

       বীরেন্দ্রকুমারের মায়ের নাম বীরজাসুন্দরী দেবী। তাঁকে আলী আকবর খান মা বলে ডাকতেন। নজরুল তাঁকে প্রথম দেখে এবং আশ্রয়ে থেকে তিনিও তাঁকে মা বলে ডাকেন। কদিন বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে থেকে নজরুলকে বিয়ে করাতে নিয়ে যান দৌলতপুরে আলী আকবর খান তার নিজ গ্রামে। সেখানে মাস দেড়েক থাকার পর ১৯২১ সালে (৩ আষাঢ় ১৩২৮) বিয়ের আয়োজন করার খবর পেয়ে অন্যদের সঙ্গে প্রমীলাও দৌলতপুরে বিয়েবাড়িতে যান।যে রাতে বিয়ে হওয়ার কথা সে রাতেই বিয়েটা ভেঙে যায়। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে অধিকাংশ গবেষকের মত কাবিননামায় নজরুলকে ঘরজামাই থাকার উল্লেখ । তারপরই ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীর ছেলে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তকে সাথে নিয়ে তিনি বিয়ে-বাড়ি ত্যাগ করে আষাঢ়ের কাদামাখা পথ ধরে বৃষ্টিতে ভিজে কান্দিরপাড়ে চলে যান। পরের দিন পরিবারের আর সবার সঙ্গে ফিরে আসেন প্রমীলাও।এই দুর্ঘটনার প্রচণ্ড আঘাতে নজরুল কয়েকদিন জ্বরে ভোগেন এই বাড়িতেই। স্বাভাবিকভাইে মুষড়ে পড়েছিলেন নজরুল । প্রমীলা এবং বীরজাসুন্দরী দেবীর দুই মেয়ে মিলে এবং বাড়ির বড়োরা অকৃপণ স্নেহ দিয়ে নজরুলকে সুস্থ করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তিনি সামলে ওঠেন। তারপর নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে কলকাতায় মুজফফর আহমদকে টেলিগ্রাম করেন। মুজফফর আহমদ সেই টেলিগ্রাম পাওয়ার পর কলকাতা থেকে এসে নজরুলকে নিয়ে যান। বিয়ে ভাঙার মাস তিনেক পরে, ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে, নজরুল আবার কান্দিরপাড়ে বিরজাসুন্দরী দেবীর বা প্রমীলার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। সেবার সেখানে ছিলেন পাঁচ-ছয় সপ্তাহ। তারপর তিনি আবারও প্রমীলাদের বাড়িতে আসেন পরের বছর ১৯২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। প্রমীলার বয়স তখন ১৪ বছরের কাছাকাছি। এই কয়েকবার নজরুল প্রমীলার প্রতি প্রেমের টানে এসেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তিনি প্রমীলার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। একদিন তিনি প্রমীলাকে একটি কবিতা উপহার দেন যার প্রথম পংক্তি-‘হে মোর রানী তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।’ এ কথার মানে প্রমীলা বুঝেছিলেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু নজরুলের প্রেমের প্রতি প্রমীলার সমর্থন শুরু থেকেই ছিল। নার্গিসের সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে আবার ফিরে আসাটাই তার কারণ হিসেবে যথেষ্ট।

তৃতীয়বার এসে নজরুল কান্দিরপাড়ে ছিলেন প্রায় চার মাস। শেষ দিকে তাই নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দুরা কুৎসা রটাতে আরম্ভ করে, তাঁকে অপমান করতেও উদ্যত হয় । কুমিল্লার মতো জায়গায় কলকাতা থেকে আসা নজরুলের মতো একজন মানুষের চারমাস থাকাটা প্রতিবেশীরা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। আজকের দিনেও কি এটা কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতো? এর মধ্যে কলকাতা থেকে মওলানা আকরম খান সম্পাদিত পত্রিকা ‘সেবক’-এ নজরুলের একটা চাকরির খবর আসে মাসিক দেড়শো টাকা বেতনে। তাই মে মাসের শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। আর সাথে নিয়ে যান প্রমীলার সমগ্র হৃদয়ের ভালোবাসা। তারপর ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁদের আবার দেখা—বিহারের সমস্তিপুরে, প্রমীলার মামার বাড়িতে। নজরুল তখন পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। নজরুলের সম্পাদিত ‘ ধূমকেতু ‘ প্রত্রিকায় তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি ছাপা হওয়ার অপরাধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। যে কোনও সময় নজরুল গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। প্রমীলার হৃদয় আশঙ্কায় দুলে ওঠে। নজরুল সমস্তিপুর থেকে তাঁদের কান্দিরপাড়ে পৌঁছে দেন। কিন্তু সেখানে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লার ঝাউতলা মোড় থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন নজরুল। এরপর মামলায় নজরুলের সাজা হয় এক বছরের। প্রমীলার হৃদয় কি তখন দুমড়েমুচড়ে যায়নি?  নিশ্চয় তাঁর ভালোবাসার মানুষটির জন্য তিনি চোখের জলে ভেসেছিলেন।

       নজরুল এক বছর জেল খেটে মুক্তি পান ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর। তার তিন-চার দিন পরই নজরুল প্রমীলার সাথে সাক্ষাতের জন্য কান্দিরপাড় প্রমীলাদের বাড়ি চলে আসেন । কদিন থাকার পরেই নজরুলের আরো একটা মামলা থাকায় প্রমীলা এবং তাঁর মা গিরিবালা দেবীকে সমস্তিপুরে পৌছে দিয়ে নজরুল কলকাতায় চলে যান। প্রমীলা গভীর আগ্রহ নিয়ে নজরুলের জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকেন। নজরুল কদিনের জন্যে একবার তাঁকে দেখেও আসেন। কিন্তু স্থায়ীভাবে প্রমীলা ও নজরুলের প্রতীক্ষা শেষ হয় তাঁদের বিয়ের মাধ্যমে—১৯২৪ সালের ২৫শে এপ্রিল । এবারেও সমস্তিপুর থেকে প্রমীলা এবং তাঁর মা গিরিবালা দেবীকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন নজরুল।

       নজরুল আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে দোলন, ডাক নাম দুলির নাম দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ মহাকাব্যের এক বীর নারীর নামানুসারে—প্রমীলা। বিয়ের আগে প্রমীলাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। প্রথমেই ছাড়তে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে, যে পরিবারের আশ্রয়ে তিনি বড়ো হয়েছেন, যে পরিবারের লোকেরা ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন। তা ছাড়া, প্রবল বাধা এসেছিল হিন্দু সমাজের তরফ থেকে। কারণ সেকালে হিন্দু আর মুসলমানের বিয়ের কথা ভাবাও যেতো না। তখনকার একাধিক রাজনীতিক এ বিয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করে কলকাতার একটি মুসলমান অধ্যুষিত সড়কের এক বাড়িতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। যে আইনে নজরুল ও প্রমীলার বিয়ে হয়েছিল-প্রমীলার (১৯০৮-১৯৬২) পিতা বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েব। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন গিরিবালা দেবী। বসন্তকুমার সেনগুপ্ত মারা যাওয়ার পর গিরিবালা দেবী একমাত্র সন্তান প্রমীলাকে নিয়ে মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রাম ছেড়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে থাকেন দেবর ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের তত্ত্বাবধানে। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন সে সময় কুমিল্লা কোর্ট অব ওয়ার্ডের ইন্সপেক্টর। তাঁরই স্ত্রীর নাম বিরজাসুন্দরী দেবী যাকে নজরুল মা ডাকতেন । বিরজাসুন্দরী দেবীর ছেলের নাম ছিল বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত যাকে নজরুল ভালোবেসে ডাকতেন রাঙাদা বলে। বিরজাসুন্দরী দেবীর ছেলে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছাড়াও আরো দুই মেয়ে ছিল। মেয়েদের ভবিষ্যৎ ভেবে তিনি প্রমীলার সাথে নজরুলের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। নজরুলের সাথে প্রমীলার বিয়ের দেয়ার জন্য প্রচন্ড মানসিক জোর ছিল গিরিবালা দেবীর আর সে কারণেই সব বাধা অতিক্রম করে এই বিয়ে সম্ভব হয়েছিল। বিরজাসুন্দরী দেবী একটা সময় অনুভব করতে পারেন, নজরুল প্রমীলাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। তাই ধীরে ধীরে নজরুলের উপর অভিমান ম্লান হয়ে যায়। ছেলে বীরেন্দ্রকুমারও নজরুল-প্রমীলার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেন যেমন বোনের বাড়ি যায় তার ভাই।

       ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থটি। বিরজাসুন্দরী দেবীকে নজরুল কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন। ১৯৩৩ সালে কলকাতায় নজরুলের সাথে বিরজাসুন্দরী দেবীর দেখাসাক্ষাৎ হয়। তখন তাঁর মাতৃহৃদয় আগের মতোই নজরুলের প্রতি স্নেহপূর্ণ ছিল। পুনর্মিলনের পরে নজরুল নিয়মিতই তাঁর বাসায় যাতায়াত করতেন। মাতৃসম মমতাময়ী বিরজাসুন্দরী দেবী ১৯৩৮ সালে মারা যাওয়ার সময় মৃত্যুশয্যায় নজরুল তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁকে নজরুল অশেষ শ্রদ্ধা করতেন। নজরুল ও প্রমীলার বিয়ে হয়েছিল আহলুল কিতাব আইনে। আহলুল কিতাব অর্থাৎ যারা কিতাবওয়ালা তাদের মেয়েদের মুসলমানরা ধর্মান্তর গ্রহণ না করিয়ে বিয়ে করতে পারত। এক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার প্রয়োজন ছিল না। স্ত্রী নিজ ধর্ম পালন করবে। স্ত্রী যদি গীর্জায় যেতে চায় তবে স্বামীর কর্তব্য হবে স্ত্রীকে গীর্জায় পৌঁছে দেয়া এবং গীর্জা হতে বাড়ি ফিরিয়ে আনা। গোঁড়া মুসলমানরা মনে করেন ইহুদি, খ্রীস্টান ও ইসলামধর্মে শুধু কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল। উদার মুসলিমরা তা মনে করেন না। মুসলিম মুঘল সম্রাটগণের হিন্দু বেগম ছিল যারা অন্দর মহলে আপন ধর্ম পালন করত। সেই হিসেবে ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতার ৬ নম্বর হাজী লেনে মিসেস এম রহমানের বাড়িতে নজরুল ও প্রমীলার বিয়ে হয়। বিয়ে সম্পন্ন হয় যাঁর যাঁর ধর্ম ঠিক রেখেই। বিয়ের পর ব্রাহ্মণরা এই বিয়ের প্রচন্ড বিরোধীতা করে। এক্ষেত্রে ‘প্রবাসী ‘ গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণদের প্রকাশিত ‘ শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা ছিল অগ্রণী ভুমিকায়। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় কবিতা ছাপা হলে নজরুল টাকা পেতেন। কিন্তু এই বিয়ের পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকা নজরুলের কবিতা ছাপা বন্ধ করে দেয়।

       ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগষ্ট (শুক্রবার ৬ ভাদ্র ১৩৩১) নজরুলের প্রথম সন্তানের জন্ম। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন তথা জন্মাষ্টমীতে (কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি) এই পুত্রের জন্ম হয়েছিল, তাই তাঁর নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পুত্রের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ। অবশ্য পুত্রের জন্য তিনি আরও একটি ইসলামী নাম রেখেছিল। তাহ হলো আজাদ কামাল। ডিসেম্বর মাসে আজাদ কামালের মৃত্যু হয়।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে (রবিবার ১৯ পৌষ ১৩৩২) নজরুল ইসলাম হুগলী থেকে বসবাসের জন্য সপরিবারে কৃষ্ণনগরে চলে আসেন। আগষ্ট মাসে নজরুল কৃষ্ণনগরের গোলাপপট্টির বাসা ছেড়ে চাঁদ সড়ক এলাকার ‘গ্রস কটেজ’-এ চলে আসেন। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ডা. আবুল কাসেমের আমন্ত্রণে খুলনায় যান এবং সেখান থেকে তিনি খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, দৌলতপুর, বনগ্রাম প্রভৃতি স্থান ঘুরে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসেন ৯ই অক্টোবর (শনিবার ২২ আশ্বিন ১৩৩৩)। এই দিন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদের (বুলবুল) জন্ম হয়। নজরুল বাসায় ফিরে তাঁর সন্তানকে দেখতে পান। এই দিনই তিনি মুরলীধর বসুকে পুত্র সন্তান লাভের সংবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন।

“প্রিয় মুরলীদা!

আজ সকালে ৬টায় একটি ‘পুত্ররত্ন’ প্রসব করেছেন শ্রীমতী গিন্নি। ছেলেটা খুব ‘হেলদি’ হয়েছে। শ্রীমতীও ভালো। আমি উপস্থিত ছিলাম না। হয়ে যাওয়ার পর এলাম খুলনা হতে। খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, দৌলতপুর, বনগ্রাম প্রভৃতি ঘুরে ফিরলাম আজ।...”

       ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ (রবিবার ২৯ ফাল্গুন ১৩৩৩) কৃষ্ণনগরে পুত্র বুলবুলের অন্নপ্রাসন হয়।

       ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের শুরুর দিকে নজরুল কণ্ঠের ক্ষত রোগে আক্রান্ত হন। এই কারণে ৬ই মার্চ (মঙ্গলবার, ২৩ ফাল্গুন ১৩৩৪) তিনি সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৫ জেলিয়াটোলা স্ট্রিটের নলিনীকান্ত সরকারের বাড়িতে ওঠেন। এখানে নানা রকম অসুবিধার কারণে তিনি সওগাত পত্রিকার ১১নং ওয়েলসলি স্ট্রিটে অফিসের নিচ তলায় উঠে আসেন। এই সময় নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা সন্তানসম্ভবা ছিলেন। ১১নং ওয়েলসলি স্ট্রিটের বাসায় প্রমীলার অসুবিধা হওয়ায়, তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই অক্টোবর (আশ্বিন ১৩৩৬), ৮/১ পানবাগান লেনের দোতলা বাসায় নজরুলের তৃতীয় সন্তান সব্যসাচী জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, চৈনিক দার্শনিক সান ইয়াৎ সান-এর নামানুসারে নজরুল এই সন্তানের ডাকনাম রেখেছিলেন সানি।

       ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে (বুধবার ২৪ মে ১৯৩০) নজরুল-প্রমীলার দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের বসন্ত রোগে আক্রান্ত মৃত্যু হয়।

       ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রমীলা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। এই বছরের শেষের দিকে তিনি এই রোগে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হন। এই সময় নজরুল স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও কোনো লাভ হয়নি। স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহের জন্য নজরুল তার শেষ সম্বল বালিগঞ্জের জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

       ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘকাল ডাক্তাররা তার রোগ ধরতে পারেননি। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন (বুধবার ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৯), প্রমীলা নজরুল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর মৃতদেহ নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়ায় শরপুকুরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post