বিশ্ব-বাজারে ডলার একচেটিয়া আধিপত্য হারাচ্ছে-আজিজুল হাকিম

 

বিশ্ব-বাজারে ডলার একচেটিয়া আধিপত্য হারাচ্ছে

আজিজুল হাকিম

 

     দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে এক্সচেঞ্জ কারেন্সি হিসাবে ডলার একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে আসছে। ১৯৯৯ সালের পর আর একটি কারেন্সি - সেটি হল ইউরো, ইউরোপ মহাদেশে বেশ কিছু দেশে এক্সচেঞ্জ কারেন্সি হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর ডলার ও ইউরো তাদের একচেটিয়া আধিপত্য হারাচ্ছে। ডলার তার দীর্ঘদিনের সম্মান, একনায়কতন্ত্র লোপ পেতে চলেছে। ডলার আর ইউরোর স্থলে আন্তর্জাতিক বাজারে আসছে রুবল আর ইয়ান।

       আমেরিকা ইচ্ছে করলেই যে কোন দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। সারা বিশ্বের কাছ থেকে সেই দেশকে একঘরে করে ফেলে। ফলে সেই দেশ সার্বিকভাবে পিছুনে হটতে শুরু করে। কারণ জীবন যাত্রার মান, শিক্ষাদীক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি সব দিক থেকে পঙ্গু হতে শুরু করে। দেশের উপরে নেমে আসে সার্বিক হাহাকার। কারণ সবকিছুই অর্থের উপরে নির্ভর করে চলে। আমেরিকা সেই নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে পারে একটাই পথে সেটি হচ্ছে ডলার। আসলে আমরা একটু অন্যভাবে বলতে পারি, সেটি হচ্ছে ‘ডলার সন্ত্রাস’। আমেরিকা এই ভাবে কত সমৃদ্ধশালী দেশকে ভিখারি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। যে দেশ আমেরিকার কথা শুনতে চায় না সেই দেশকেই এইভাবে অক্ষম করে দেওয়া হয়। উদাহরণ হিসাবে আমরা ইরাক আর লিবিয়ার কথা উল্লেখ করতে পারি।

       আমরা বলতে পারি আমেরিকার সেই শক্তির আজ অবসান হচ্ছে। ডলারের জায়গায় আসবে আঞ্চলিক কারেন্সির আদান-প্রদান। ডলার একচেঞ্জের ফলে সারা পৃথিবী থেকে আমেরিকা যে আয় করে আসছে তার অবসান হবে।

       কিভাবে এটি হচ্ছে?

       রাশিয়া যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাল আমেরিকা সহ ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ দেশ, এমনকি অস্ট্রেলিয়া আর জাপানও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করে। ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আর্থিকভাবে রাশিয়াকে পঙ্গু করে দিলে আর আন্তর্জাতিক বাজারে তার ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করতে পারলে রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই ইউক্রেনের উপরে হামলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু ঘটনা ঘটল উলটো। আমেরিকার ছোড়া অস্ত্র আমেরিকার কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ বললেন, বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আসছে এবং নতুন ব্যবস্থায় পশ্চিমাদের আধিপত্য থাকবে না। তিনি আরও বলেন, রিজার্ভ মুদ্রার ওপর আস্থা ভোরের কুয়াশার মতোই ম্লান হয়ে যাচ্ছে এবং ডলার ও ইউরো ত্যাগ করার সম্ভাবনা এখন আর অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে না। আঞ্চলিক মুদ্রার যুগ আসছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। রাশিয়া এর আগে ঘোষণা করেছে, বন্ধু নয়-এমন দেশগুলোকে রুশ মুদ্রা রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। রাশিয়ার অ-বন্ধু দেশগুলোর তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইউনাটেডভুক্ত দেশগুলো রয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, “রুবলে মূল্য পরিশোধ করো নতুবা গ্যাস বন্ধ করে দেব।” এদিকে আবার  চীন ও সৌদি আরব চীনা মুদ্রা ইয়ানে তেল বাণিজ্য করার বিষয়ে আলোচনা করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডলারের এক চাটিয়া আধিপত্য নষ্ট হতে চলেছে।

       এর ফলে অন্য দেশগুলির লাভ কি হবে? এমন প্রশ্ন অনেকের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যারা আমেরিকা সহ তার মিত্রদের রীতিনীতির বিরোধী (প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আদর্শ থাকবে সেটই স্বাভাবিক) তারা আমেরিকার দাদাগিরির হাত থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। নিজের স্বার্থে ঘা লাগলেই কারো বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করার প্রবণতা লোপ পাবে। ডলার এক্সচেঞ্জের কারণে যে কমিশন পায় আমেরিকা সেটি থেকে বঞ্চিত হবে। অনেক দেশের আর্থিক সাশ্রয় ঘটবে। সর্বোপরি বলা যেতে পারে সারা বিশ্বে আমেরিকা সহ তার মিত্র দেশগুলির একক আধিপত্য হারাবে। পরিবর্তে আসবে এক নতুন সকালের সোনালি সূর্যোদয়। স্বতন্ত্রতার গোলাপি স্বপ্নে, শান্তির পরশে শিহরিত হবে এই পৃথিবীর কোল।      

Post a Comment

Previous Post Next Post