ছোটগল্পঃ এলাকার ছেলে-লেখকঃ আজাহার খান

 

ছোটগল্প

এলাকার ছেলে
লেখকঃ আজাহার খান


বোর্ড মিটিং শেষ করে কেবল
  রুমে এসে বসলাম, এমন সময় পিওন ছেলেটা এসে বললো, স্যার, একটা ছেলে ঘন্টা খানেক ধরে বসে আছে, আপনার সাথে দেখা করবে। একটু বিরক্তি এলো , সারাদিন এত ব্যস্ততায় কেটেছে  এ সময় আবার কে এলো,  বললাম আসতে বলো। ছেলেটা সালাম দিয়ে রুমে ঢুকলো, হাতে একটা ব্যাগ, পড়নে কালো প্যান্টের উপর চেক হাফ শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল, লেখা পড়া কিছুটা করছে বলে মনে হয়, ততোটা স্মার্ট না হলেও  যথেষ্ট ভদ্র মনে হলো।
নাম কি?
মিলন।
কোথা থেকে এসেছ?
সেলিমপুর।
নামটা শুনে আমার গ্রামের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, মনটা ভালো হয়ে গেলো। অনেক দিন গ্রামে যাওয়া হয় না, সেই সাথে এও মনে হলো নিশ্চয়ই বড়ো ভাই পাঠিয়েছেন, উনার এই একটা দোষ, তিনি মানুষের উপকার করে তৃপ্তি পান, নিজের সাধ্যের বাহিরে হলে আমার কাছে পাঠাবেন, তিনি মনে করেন, আমার বিশাল ক্ষমতা, আমি অনায়াসেই কাউকে কোন একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
বাবার নাম কি?
রহিম শেখ।
সেই ছোটবেলার কথা মনে পরে গেলো। রহিম
  আমাদের  সাথে প্রাথমিকে যেতো, এক বছরের জুনিয়র, আমার পুরনো বই নিয়ে পড়তো, ফাইভ পাশ করে ঝরে পড়লো, হাইস্কুলে পড়ার খরচ দেওয়া ওর বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না , রহিমের বাবা বলত,  পড়ালেখা করে কি হবে? কাজ কর, দুটো পয়সা আসবে। আমরা যখন  হাই স্কুলে যেতাম তখন রহিম ঐ বয়সে ওর বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করতে যেতো।
কি জন্য আসছো?
এমন প্রশ্নে ও একটু লজ্জা পেল, বলল, স্যার, বাবা অসুস্থ, কাজ কাম তেমন করতে পারে না সংসার আমাকেই চালাতে হয়, এলাকার মানুষের সাহায্য সহায়তায় গ্রামের কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেছি, বড়ো কাকা বললেন আপনার সাথে দেখা করতে।
আপাতত কি করতে পারি, উঠেছো কোথায়?
আপনার কাছেই আসছি, কোথাও উঠার মত কেউ নাই।
ভেবে ছিলাম দুই এক হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করবো তা আর হলো না, ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলে ওকে নিয়ে নিচে নামলাম।
গাড়ি স্টার্ট দিল, জিনিয়াকে ফোন দিলাম, শুনো বড়ো ভাই গ্রাম থেকে আবার একজনকে পাঠিয়েছেন কি করি বলোতো?
কি আর করবা? এলাকার ছেলে, বাসার কাজে লাগিয়ে দাও, তুমি না কেয়ার টেকার খুঁজতেছ? তা ঠিক বলেছ, কিন্তু ওতো বি এ অনার্স, ওকে বাসায় লাগাবো?
কি যে বলোনা আজকাল কতো মাস্টার্স করা ছেলে পিওনের চাকরি পায় না!
বললাম আচ্ছা দেখা যাক।
আমার বাড়ির নিচ তলা ফাঁকা, গ্যারেজ স্পেস
একপাশে কেয়ার টেকারের রুম, রুমের একপাশে একটা সিঙ্গেল ঘাট, একপাশে একটা ছোট টেবিল সাথে চেয়ার, অপর পাশে রেক। পাশে ড্রাইভারদের রেস্ট রুম, ওয়াশ রুম।
ওকে কেয়ার টেকার রুম দেখিয়ে বললাম, এখানে থাকতে পারবা?
খুব পারবো স্যার, এমন সুন্দর রুম ফ্যান আছে, কোন অসুবিধা হবে না।

পরের দিন ছিল শুক্রবার, জিনিয়ার সাথে পরামর্শ করে ওকে ডেকে বললাম, শুনো মিলন, তুমি আমার এলাকার ছেলে, শিক্ষিত ছেলে, তার উপর বড়ো ভাই পাঠিয়েছেন, তোমাকে যে কিভাবে বলি! আমার কেয়ার টেকার ছুটি নিয়ে দেশে গেছে, এখন বলছে সে আর আসবেনা, তাই বলছিলাম তুমি যদি আপাতত ওর দায়িত্ব পালন করো! বেতন পাবা বার হাজার, থাকবা ফ্রি, আর ওতো নিজেরটা খেত! তুমি আমার এলাকার ছেলে  তুমি  সকালে নাস্তা বাইরে সেরে নিও, দুপুর ও রাতে বাসা থেকে খাবার দেওয়া হবে, তুমি কি বলো?
একথা শুনে মনে হলো মিলন ভীষন খুশি হয়েছে, খুশিতে ওর চোখে পানি এসে গেল, আমাকে ও জিনিয়াকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললো, স্যার আপনার অনেক দয়া, আপনার কথা যা শুনেছি তার চেয়ে শতগুণ দেখছি।
জিনিয়াকে বললাম, ওকে হাত খরচ বাবদ হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে দাও টুকিটাকি কিছু লাগলে কিনে নিবে।

সেই থেকে মিলন বিশ্বস্ত্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, তবে সময় পেলেই পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে , তবে এটুকু বুঝতে পারছি যে জিনিয়া সহজ সরল ছেলেটা পেয়ে এমনভাব খাটাচ্ছে যে পয়সা পুরোপুরি উসুল করে নিচ্ছে। ওকে কোনো কঠিন কাজ দিলেও ও সুন্দর ভাবে করে আসে। বাড়ির নিচ তলায় বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে নানা জাতের
  ফুলের গাছ লাগিয়েছে আর অন্যান্য স্থানে ফুলের টব এমন সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে বাড়িতে ঢুকলে মনটা ভলো হয়ে  যায়। জিনিয়া ওর কাজে খুব সন্তুষ্ট, ওকে ছাড়তে চাচ্ছে না, আমিও ওকে নিয়ে আর কিছু ভাবি নাই, ভাবছি আছে থাক।
বড়ো ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল, কথা প্রসংগে বলছিল, মিলনের পয়েন্ট অনেক ভালো তুই ওকে দারোয়ানের চাকরি দিলি?
  যদিও আমি কখনো পয়েন্ট শুনতে চাইনি বললাম, আপাতত করুক না ওতো দেখি পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, পড়শুনা শেষ করুক দেখি কি করা যায়, আর ওতো কিছু বলছে না!
আমার সাথে ওর তেমন একটা দেখা হয় না, শুধু ছুটির দিনে
  টুকটাক কথা হয়, দেখা হলে বলি, কি খবর মিলন কোন অসুবিধা নাই তো?
না স্যার খুব ভালো আছি।
বছর দুয়েক কেটে গেলো, একদিন শুক্রবার দশটার দিকে মিলন
  উপরে এলো, হাতে একটা খাম, বললাম মিলন কোন সমস্যা?
ও বললো, স্যার একটা কথা ছিল!
বলো!
ও খামটা আমার হতে দিয়ে বললো, চিঠিটা গতকালই পেয়েছি আপনাকে বলার সুযোগ হয়নি, আমি চলে যাচ্ছি স্যার।
দেখলাম বিসিএস ক্যাডারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
  হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে, রোববার জয়েন।  ও আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে এলে আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোকে আমরা চিনতে পারি নাইরে, তুই একটা জিনিয়াস , তোকে অভিনন্দন, সেই সাথে একটা কথা বলি, কাজের প্রতি তোর যে একগ্রতা নিষ্ঠা ও সততা আমি দেখেছি তা যদি ধরে রাখতে পারিস জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবি, এলাকার মুখ উজ্জ্বল করতে পারবি।
স্যার আমি যাচ্ছি, তবে আপনাদের কথা সারা জীবন মনে থাকবে। দেখলাম রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বের হয়ে গেল।
 

Post a Comment

Previous Post Next Post