উপন্যাসঃ বহুগামী আমি

 


বহুগামী আমি

সৈয়দ আসরার আহমদ

পর্ব-১০৪

 

   মুকুলের সঙ্গে পার্কসার্কাস ময়দানে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত গল্পগুজব করে আমি ২০ নম্বর ট্রাম ধরলাম৷ লর্ড পাড়া স্টপজে নেমে শামিমভাইয়ের ফ্ল্যাটে আটটায় পৌঁছালাম৷ কলিং বেল চাপতেই শামিমভাই কপাট খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বিশ্বজিৎ আসে নি?
- আমি তো মেসবাড়ি থেকে আসছি না৷ পার্কসার্কাস গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে৷ আমি কি বিশুদাকে ডেকে আনবো?
- না যেতে হবে না ও চলে আসবে৷ তুমি ভিতরে গিয়ে বসো৷ বিশ্বজিৎকে বলে দিয়েছিলাম সে যেন বাবুর্চি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আসে৷ তিনি আমাদের মায়ের মতো অন্ন জুগিয়ে গিয়েছেন৷ তাঁর কাছে আমরা ঋণী৷
বাবুর্চিচাচার প্রতি শামিমভাইয়ের শ্রদ্ধাবোধ দেখে যে কোনও মানুষের
  শিক্ষা নেওয়া উচিত৷ একজন পাচকের প্রতি এত উচ্চশিক্ষিত মানুষের বিনম্র আচরণ আমি জীবনেও দেখিনি৷ মেসে থাকাকালীন বাবুর্চিচাচাকে শামিমভাই খুব সম্মান করতেন৷ এ ধরণের ব্যবহার সবাই করতে পারে না সেই ব্যক্তি পারে যে মানব সন্তানকে সম্মানের চোখে দেখে৷
স্বপ্না ভাবি চা আর স্নাকস বিস্কুট এনে দিলেন৷ আমরা খাচ্ছিলাম এমন সময় কলিং বেল বাজল৷ শামিমভাই বললেন, বিশ্বজিৎ এসেছে দরজা খুলে দাও৷ আমি উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম স্বপ্নাভাবি বললেন, তুমি চা খাও আমি যাচ্ছি৷
দরজা খুলে দিয়ে স্বপ্না ভাবি উল্লসিত হয়ে বলে উঠলেন,শামিম দেখ কে এসেছে?
- কে?
- উঠে এসে দেখবে তো৷
শামিমভাইকে আর উঠতে হল না৷ সাখোয়াত ও শ্রাবন্তী ঘরে ঢুকে শামিমভাইকে কদমবুসি করতে যাচ্ছিল তিনি ধমক দিয়ে বললেন, মানুষ হয়ে মানুষের পায়ে হাত দেয় নাকি? বসো বসো৷ যাক আজ ভাল দিনেই এসেছ৷
- ভাল দিনে মানে বুঝলাম না আমি তালতলা লেনে আমার আত্মীয় বাড়ি এসেছিলাম,ভাবলাম শামিমভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে নিই ৷
- ভাল করেছ বসো, বলছি৷
আমাকে দেখে সাখোয়াত আবেগ দমন করতে না পেরে বলল,আরে দেলোয়ার যে কেমন আছিস? কবে এসেছিস বাংলাদেশ থেকে৷
- দিন বিশেক হয়েছে৷ ভাল আছি৷ তোরা কেমন আছিস?
- ভাল আছি৷ তুই আমার কেষ্টপুরের ফ্ল্যাটে ছুটির দিনে আসবি৷ গল্প করা যাবে৷
- যাবো ভাবছিলাম তো, এই রোববার যেতাম৷ আজ স্বপ্নাভাবিকে বলতাম তোকে ফোনে খবরটা দিতে৷ যা'হোক তুই এসে গিয়েছিস৷
-তুই পরের রোববার সকালে চলে আসবি৷ আমাকে কথাটা বলে শ্রাবন্তীকে জিজ্ঞেস করল, তুমি দেলোয়ারকে চেনো?
- নাম শুনেছি কিন্তু দেখি নি কখনও৷
- আমিও সাখুর মুখে আপনার প্রশংসা শুনেছি৷ যাক আপনারা বিয়ে করে দাম্পত্যজীবন শুরু করেছেন বলে শুনেছিলাম শামিম ভাইয়ের মুখে৷
- আপনি রোববার আসুন আপনারা দুই বন্ধুতে গল্প করবেন আমিও থাকব৷ আসছেন তো?
- বলছেন যখন তখন তো যেতে হবে৷
- জানেন তো আমরা কোথায় থাকি?
- হ্যাঁ শুনেছি, কেষ্টপুরে স্বপ্নাভাবিদের এপার্টমেন্টে৷
- চেনেন তো?
- মানে? আমি তো স্বপ্না ভাবিকে বউ সাজিয়ে কেষ্টপুর থেকে এখানে নিয়ে এলাম৷
- ওমা তাই বুঝি! সাখু তো কোনওদিন সে গল্প শোনায় নি৷
- আমি গিয়ে শোনাব৷
এদিকে স্বপ্নাভাবি সাখু ও শ্রাবন্তীর জন্য একটা ট্রেতে দু কাপ চা বিস্কুট চানাচুর মিষ্টি এনে শ্রাবন্তীকে বললেন, তোমরা খাও৷
সাখোয়াত বলল, ভাবি শামিমভাইরা খাবেন না?
শামিমভাই বললেন- আমরা এই মাত্র চা খেলাম৷ তোমরা খাও৷
চা খাওয়া শেষ করে সাখোয়াত শ্রাবন্তীকে বলল, চলো উঠতে হবে৷
স্বপ্না ভাবি কিচেন থেকে ছুটে এসে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, কি বলছ? উঠতে হবে মানে ? জানো না আজ আমাদের ম্যারেজ ডে আমি বিরিয়ানি রাঁধছি৷
  শ্রাবন্তী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানতে চাইল, বৌদি আপনি বিরিয়ানি রান্না কিভাবে শিখলেন?
স্বপ্নাভাবি বলার আগে আগ বাড়িয়ে আমি বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু শামিমভাই আমাকে চোখের ইশারায় নিষেধ করায় নিরস্ত হলাম৷ স্বপ্নাভাবি বললেন, সাখু তো জানে, ওদের মেসের বাবুর্চি সাহেবের কাছ থেকে আমি শিখেছি৷ তোমরা বসো, বিশ্বজিৎ আর বাবুর্চি সাহেব আসছেন৷ বুরহানি বানিয়ে দেবেন৷
- শ্রাবন্তী বুরহানির কথা শুনে বলল, বুরহানি কি বৌদি?
সাখোয়াত বলল, ঘোল খেয়েছ? তাই৷
স্বপ্না বৌদি বললেন, ঘোল ঠিক না দইয়ের সঙ্গে লবণ, গোল মরিচ, জিরা আরও কি সব দিয়ে বানায়৷ হেভি টেস্টি ও গুরুপাককে লঘু করে হজমে সাহায্য করে৷
- তাই? দারুণ জিনিস তো!
আমি বললাম, আজকে তো খাচ্ছ টেস্ট পেয়ে যাবে৷
সাখোয়াত বলল, শামিমভাই আমরা তো বিন বোলায়ে মেহমান৷
- কি হয়েছে তাতে বড়দার বাড়িতে আসার জন্য আবার দাওয়াত লাগে নাকি? স্বপ্নাভাবি জানতে চাইলেন৷
- না না দাওয়াত লাগবে কেন এমনই বলছি সাখোয়াত বিনয়ের সুরে বলল৷
কলিংবেল বেজে ওঠায় শামীমভাই বললেন, দরজা খুলে দাও দেলোয়ার, দেখ বিশ্বজিৎ এলো বুঝি৷
স্বপ্নাভাবি কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর বরকে বকলেন, তুমি পারছ না দরজা খুলতে? দেলোয়ার আজ মেহমান৷
- কি যে বলেন ভাবি, শামিমভাই আমাদের অভিভাবক৷ তাঁর অধিকার আছে আমাদেরকে আদেশ করার৷
- দেখ বাবুর্চিচাচা একা এসেছেন৷
- ওঁকে ভিতরে আসতে বলো৷
- আসসালামু আলায়কুম ওয়া রহমতুল্লাহে বরকাতুহু বলে, মুজাফফর চাচা ঘরে ঢুকলেন৷ তিনি বললেন, বিশ্বজিৎ মুসলিম ইন্সটিটিউট হলের সামনে পেপার স্টলে গেল৷ আমাকে বলল, আপনি যান আমি আসছি৷
আমরা তিনজনে সালামের উত্তর দেবার আগে স্বপ্নাভাবি ওয়া আলায়কুম সালাম বলে দেওয়ায় শ্রাবন্তী বিস্ফোরিত চোখে স্বপ্না ভাবির দিকে তাকিয়ে থাকল৷ তা দেখে সাখু শ্রাবন্তীকে বলল, তোমাকেও স্বপ্নাভাবির মতো শিখতে হবে৷
- তুমি শেখালেই শিখে যাব৷
শামিমভাই বললেন, আসসালামু আলায়কুম শব্দটি আরবী এর মানে হচ্ছে তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক৷ অথচ অমুসলিমরা এর অর্থ জানে না তাই সালাম দিলে নাক সিঁটকাই৷ তোমরা যেমন নমস্কার বলো তার অর্থ পৃথক৷ নমস্কার মানে প্রনাম৷ মধু কবির " নমি তব পদাম্বুজে" পড়ো নি৷" অর্থাৎ পায়ে মাথা ঠেকানো যা কোনও মানুষেরই কাউকে করা উচিত নয় এটা ইসলামিক অনুশাসন৷ সব মানুষ তো একই স্রস্টার সৃষ্টি তারা একজন মানুষ আরেকজনের পায়ে মাথা নত করবে কেন? খৃস্টান ও ইহুদিরা ও করে না৷ প্রাণের ভয় ছাড়া কেউই করবে? তাও অনেক সাহসী মানুষ আছে যারা মৃত্যু ভয়েও মাথা নত করবে না৷ নজরুলের কথা ভেবে দেখ৷
শ্রাবন্তী বলল, নমস্কার বলি কিন্তু তার মানে কখনও জানতে চাই নি! আজ জানো হল৷ কথা নেই বার্তা নেই পদতলে মাথা ঠেকানো মোটেই কাঙ্খিত নয়৷ সে সাখুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ইসলামিক অনুশাসন সম্পর্কে আমি জানতে আগ্রহী তুমি আমাকে কয়েকটা এ বিষয়ক বই এনে দেবে৷
শামিমভাই বললেন, বই আমি তোমাকে দেব তবে একটা শর্তে পড়ে ফেরৎ দিতে হবে৷
শ্রাবন্তী বলল, কিনে নেয়া সবচেয়ে ভাল নয় কি শামীমভাই ? ওগুলো তো মূল্যবান এসেট হবে৷ ঘরে থাকলে যখন তখন পড়া যাবে৷
- যথার্থ৷ সাখোয়াত তুমি সম্ভব হলে ওকে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ আর হাদিস শরিফ এনে দিও৷ তার আগে অহম চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, বোম্বাই; প্রকাশিত পাঁচ মিনিটের মাদরাসা বইটা কিনে দিও৷ খুব মূল্যবান গ্রন্থ৷
- আপনি ঠিকানা দেবেন আমার ছোট ভাই বোম্বাই থাকে ওকে বলবো এনে দেবে৷ - ঠিক আছে আমি বলছি তুমি লিখে নাও৷
শামিমভাই বইয়ের আলমারি থেকে বইটা নামিয়ে এনে কাগজ কলম দিয়ে বললেন, লিখে নাও৷ Ahm Charitable Trust, 1st floor,Moosa Manzil,Tank Pahadi Road,Bombay-11.
বইটা হাতে নিয়ে সাখোয়াত বলল, এটা তো উর্দুতে লেখা৷
-
  আপনি উর্দুও জানেন শামিমদা? শ্রাবন্তী কৌতূহলী হল৷
সাখোয়াত বলল, শামিমভাই অনেকগুলো ভাষা জানেন৷
শামিমভাই বললেন, বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করবে বলে ট্রাস্ট থেকে জানানো হয়েছিল৷ এতদিনে নিশ্চয় বের করেছে৷
- আচ্ছা আমি ভাইকে এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলব৷
- যদি বাংলায় পাওয়া যায় তাহলে দুটো আনতে বলবে৷ আমি একটার দাম দিয়ে দেব৷ স্বপ্নার আগ্রহ খুব ইসলামকে জানার৷ আমি এ বিষয়ে তাকে কিছু বলি না সে নিজেই আমাকে বলে ইসলামিক অনুশাসনের বইপত্র নিয়ে আনতে৷
এবার সাখোয়াত মুজাফফর চাচাকে জিজ্ঞেস করল,কেমন আছেন চাচা?
- আলহামদুলিল্লাহ, ভাল৷ তোমরা কেমন আছো? বউমা আপনি কেমন আছেন?
শ্রাবন্তী প্রথমেই বাবুর্চিচাচাকে বলল, চাচা আপনি সাখুকে তুমি বলছেন, আর আমাকে পরের মতো আপনি করে বলছেন৷
তার কথা শুনে বাবুর্চিচাচা যে খুব খুশি হলেন তা তাঁর চোখে মুখে দীপ্তমান হল৷ তিনি বললেন, নতুন মা'কে আপনি করে বলতে হয়৷
- নাহ, চাচা; আমাকে তুমি করে বলবেন৷
- আচ্ছা বউমা এবার থেকে তুমি করেই বলব৷
স্বপ্না বৌদি ওদের দুজনকে চা বিস্কুট চানাচুর মিষ্টি দিয়ে বললেন, চাচা
  খেয়ে নিয়ে বুরহানি বানিয়ে দেবেন৷ কিভাবে তৈরি করেন আমি শিখে নেব৷
- ঠিক আছে বউমা৷
শ্রাবন্তীও আবেগ দমন করতে না পেরে বলে উঠল, চাচা আমিও শিখে নেব৷
- আচ্ছা মা জননী তুমিও শিখে নিও ৷

(চলবে)

 

Post a Comment

Previous Post Next Post