বহুগামী আমি-৯৭-সৈয়দ আসরার আহমদ

 


বহুগামী আমি

 সৈয়দ আসরার আহমদ

পর্ব-৯৭

 

ঢাকায় সময় কাটানো বিরক্তিকর হয়ে উঠছে৷ কিছুই ভাল লাগছে না৷ বউ ছেলের জন্য তেমন চিন্তা না হলেও চাকরির জন্য ভয় লাগছে৷ তাই টিপুকে জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন অফিস না করলে চাকরি চলে যাবে না তো?
- আরে না না আমার শ্বশুর সাহেবের অফিসে খুব প্রভাব প্রতিপত্তি৷ তুমি ভাববে না৷ চাকরি যাবার ভয় নাই৷ তাছাড়া ওখানকার M.N.A (সংসদ সদস্য) ডাঃ আকবর আলি খান চৌধুরি আমার শ্বশুরের ঘনিষ্ট বন্ধু ও M.P.A. ডাঃ সারওয়ার আলি মাশুমের বন্ধুর আব্বা৷ স্থানীয় আওয়ামি লিগের নেতা আমার শ্বশুরকে খুব সম্মান করে৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে চলে যান৷ সেখানে বগুড়ার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ সেই ঘটণার পরে তাঁর সুখ্যাতি সারা বগুয়ায় ছড়িয়ে পড়ে৷
  টিপুর কথায় মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কিছুটা হলেও কমল৷ দুশ্চিন্তার পরে কিছুটা হলেও মনে প্রশান্তি এলো৷ তখন টিপু বলল, চলো বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ঘুরে বেড়াব৷ আমার সমগ্র সত্বায় যেন জলতরঙ্গের সূর লহরী বেজে উঠল আমি নেচে উঠে বললাম, চলো যাওয়া যাক৷ গুলিস্তান থেকে রিক্সায় সদরঘাটে গেলাম৷ সদরঘাট পুরনো ঢাকার ঘিন্জি এলাকা৷ রিক্সা, বেবি ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার, বাইক, হোণ্ডা, স্কুটার সাইকেল আর পথচারিতে রাস্তা গিজগিজ করছে ফলে যানবাহন এখানে যেন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে৷ এত বিশ্রী পরিবেশ আমি কোন মহানগরীতে দেখি নি৷ অনেক প্রাচীন শহর অপরিকল্পিত লোকালয় চিপা চিপা গলি খুঁচি৷ আমরা সদরঘাটে পৌঁছানোর পরে টিপু বলল, এখানে একটি হোটেলে ভাল ভুনা গোস্ত পাওয়া যায় চলো দুপুরের লান্চটা ওখানে খেয়ে নিই৷ তন্দুর রুটি আর গরুর গোস্তের ভুনা খেয়ে আমরা নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গায় ভাসতে থাকলাম৷ ধীরে বইছে বুড়ি গঙ্গা আমি এই শহরে আগে দু একবার এসেছি কিন্তু বুড়িগঙ্গায় নৌকায় চাপি নি৷ নৌকায় চেপে সেই একদিনের কথা মনে পড়ে গেল৷ আমি পাবনা থেকে ঢাকা ফিরছিলাম৷ কালিগঙ্গায় ফেরি ডুবে যাওয়ায় পারাপার বন্ধ ছিল৷ নদীর দু'পাশে লোকজন হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছি৷ কি করা যাবে৷ হঠাৎ ফেরেস্তার মতো একটা পানসি নৌকা ঘাটে এসে দাঁড়াল আমি মাঝিকে বললাম, ভাই আমাকে নদী পার করে দিতে হবে৷
- আপনে সাঁতার জানেন?
- জানি৷
- এই নদীতে পানসি নৌকায় পার হওয়া মুশ্কিল৷ নদীতে ঘূর্ণি স্রোতে ছোট নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয় আছে৷
- আল্লাহ ভরসা, আপনি বিসমিল্লাহে মাজরিয়া ওমা ওমর সাহা ইন্না রব্বি রা গফুরুর রাহিম বলে চলুন৷
আমি দোয়া পড়ে নৌকায় উঠলাম৷ মনে ভীতিবোধ কাজ করছিল৷ তবুও সতর্ক হয়েছিলাম হাতে ছোট্ট ব্রিফকেস ছিল৷ নৌকায় বসে আল্লাহ আল্লাহ করছি৷ মাঝ নদী পেরিয়ে অনেকটা গিয়ে একটা ডবল কারেন্টের মধ্যে নৌকাটা বন বন করে দুবার ঘুরে গেল৷ আর মাঝিভাই যার নাম আমি নৌকায় যেতে যেতে জেনেছিলাম জৈনুদ্দি ভাই অসাধারণ দক্ষতা ও নৈপূণ্যে নৌকাটাকে ঘুর্ণির মধ্য থেকে বের করে নিলেন৷ তিনি বললেন, বাই এ যাত্রা বড় বাঁচা বেঁচেছি৷ আমাকে পাড়ে তুলে বিশ টাকা নিয়ে তিনি চলে যাবার আগে আমি সালাম দিলাম তিনি জবাব দিয়ে আবার এপারে দুজন যাত্রীকে নিয়ে রওনা দিলেন৷
  এপারে ঢাকা যাবার ট্যাক্সিতে একজন যাত্রী কম ছিল বলে দাঁড়িয়েছিল৷ আমি উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলেন৷
বুড়ি গঙ্গা নদী ঢাকার প্রাণ৷ আমি তো ঢাকার কিছুই চিনি না ৷ টিপু সব বলে বলে দিচ্ছিল৷ আমি নৌকার ছইয়ে বসে জেলেদের মাছ ধরা৷ নদীর ধারে বাঁশের গাদার পাশে নৌকায় বসে কয়েকজন ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল৷ শহরের দিকে দেখার চেয়ে এইসব দেখতে আমার ভাল লাগছিল৷ বিভিন্ন জায়গা থেকে যখন বিভিন্ন নামধারি
  স্টিমার,লন্চ ভোঁ বাজিয়ে আসছিল তখন আমাদের নৌকা দোদুল দোলায় দুলে দুলে উঠছিল৷ তাতে যতটা না ভয়ও লাগছিল তার চেয়ে বেশি রোমান্চে মনে শিহরণ জাগছিল৷ প্রায় তিন ঘন্টা নৌকা ভ্রমণের পরে আমরা উঠে এলাম৷ টিপু গুলিস্তানে এসে বলল, তুমি কোথায় যাবে?
আমি বললাম, কোথায় আর যাব? নিউ মার্কেটে বলাকা সিনেমার নীচে বদরুদ্দিন আর সিরাজুলদের দোকানে যাব৷ ওদের সঙ্গে দেখা করে নিউ মার্কেটে আক্তারদের দোকানে কিছুক্ষণ বসে ফিরদৌসের দোকানে যাব৷
ঢাকার নিউ মার্কেট খুব খোলামেলা কলকাতার মতো দর্শনীয় নয়৷ আমি আক্তারের দোকানে গিয়ে বসলাম৷ আক্তার ওর সহকর্মী সামাদভাইকে ৬ টা রোল আনতে বলল৷ রোল খেয়ে চায়ের দোকানে আক্তার নিজে গিয়ে ৬ কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে এলো৷ ও উর্দু রোডে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে৷ আমাকে বলল, আজ রাতে আমার ঘরে থাকবি৷
আমি বললাম, আজ ফিরদৌসদের বাড়িতে মিলাদ আছে অন্যদিন যাবো৷
- হ্যাঁ ঠিক বলেছিস ফিরদৌস আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেছে৷ আমিও যাব৷
আমি বললাম, আমি বদরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে ফিরদৌসের দোকানে যাব৷
- ঠিক আছে তুই যা আমি দোকান বন্ধ করে রাত সাড়ে আটটায় ফিরদৌসদের বাড়ি যাব৷
  আমি বলাকা ফার্মেসিতে সিরাজুলের সঙ্গে দেখা করে নিউ এলিফ্যান্ট রোডে সম্ভার বিপনী বিতানে ফিরদৌসের পাশে গিয়ে বসলাম৷ তার দোকানে যখন কাষ্টমার থাকত না তখন সে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান নীচু গলায় গাইত৷ ওর ছোটভাইকে দোকানে বসিয়ে আমাকে নিয়ে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকানে ঢুকল৷ টেবিলে বসে টক দই আর রসগোল্লা দিতে বলল৷
মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে আবার ফিরদৌসের দোকানে এসে বসলাম৷ ফিরদৌস 555 সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে একটা দিল৷ Ronson সিগারেট লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বলিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আজ আমাদের বাড়িতে মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে মিলাদ মাহফিল আছে৷
- জানি তো খালাজান বলছিলেন৷
- মটন বিরিয়ানি দু দেগ রান্না হচ্ছে৷ আমাদের বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়েছি৷ জানিস তো এদেশে আমাদের তেমন কোন আত্মীয় নেই৷ ফজলু মামা আর বড়ভাইয়ের শ্বশুররা ছাড়া যারা আসবে সবাই এদেশী৷
- তাই৷ এদেশে আমাদের কিন্তু অনেক আত্মীয় স্বজন আছে৷ আমার ভাল লাগে না ওদের কারও বাড়িতে যেতে৷ নিউ মার্কেটের পিছনে আমার একজন নিকট আত্মীয় থাকেন৷ উর্দু রোডে একজন থাকেন৷ এলিফ্যান্ট রোডে আরেকজন থাকেন৷ কারও বাড়ি যাই না৷ তোদের বাড়িতে হোমলি ফিল করি৷
- তোকে তোর আত্মীয়ের বাড়ি কে যেতে বলেছে? আমার সঙ্গে থাকবি৷
-
  তোর আম্মা একজন মহীয়সী মহিলা৷ ওঁর মতো মাতৃময়ী হৃদয়ের মানুষ কম আছে৷
 
                   

চলবে (৯৮)

 

Post a Comment

Previous Post Next Post