বহুগামী আমি
সৈয়দ আসরার আহমদ
পর্ব-৯৬
স্বার্থপর মানুষরাই
জীবনে ভালাে থাকে! বােকারা তাে কেবল অপরকে ভালাে রাখে! এই বাক্যদ্বয় যে মহাপুরুষ বলেছিলেন,
তাঁকে আমি শতবার সালাম জানাই৷ এ ব্যাপারে আমার জীবনের ঘটণাবলী লক্ষ্য করলেই পাঠক বন্ধুরা
আপনারা সত্য উপলদ্ধি করতে পারবেন৷
আমরা সিনেমা হল থেকে বের হতে টিপু বলল, যশোরের M.N.A. মঈনুদ্দিন মিয়াজি আমার ফুপাতো
বোনের স্বামি শেরে বাংলা নগরে M.N.A. হস্টেলে গেলে তার দেখা পাওয়া যাবে৷ ওকে পেলে উনি
নিজে এবং বগুড়ার বা পাবনার অন্য কোন M.N.A .কে দিয়ে রিকোমেন্ড করিয়ে দেবে৷
- তাহলে এখনই চলো৷
- কখন গেলে তাঁকে পাবো সে কথায় ভাবছি৷
- ভেবে দেখ৷
- দুপুরে লান্চ খাওয়া হয় নি চলো বিরিয়ানী খেয়ে নিই৷
টিপু একটি হোটেলে আমাকে নিয়ে ঢুকলো৷ হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা বেবি ট্যাক্সিতে(অটো) চেপে
চালককে বললো, শেরে বাংলা নগর চলো৷
M.N.A. হস্টেলে দোতলায় মিয়াজির রুমে তাঁকে পাওয়া গেল৷ টিপু ফাইলটা হাতে নিয়ে তাঁকে
বললো, আমি লুব্রিকেন্টের ডিলারশিপের জন্য দরখাস্ত করছি৷
- বেশ ভাল করছ৷ আমাকে কি সুপারিশ করতে হবে?
- হ্যাঁ আপনাকে তো করতেই হবে আরও দু একজনকে দিয়ে রেকমেণ্ড করলে ভাল হয়৷
- ঠিক আছে কই দরখাস্ত খান দাও আমি নিজে recommand করে দেবে৷ আরও দুজন M.N.A.কে দিয়ে
recommand করিয়ে দেব৷ তুমি দুদিন পরে এসে নিয়ে যাবে৷
টিপু বলল, তিনদিন পরে আমি এসে দরখাস্তটা নিয়ে যাব৷ তারপর তোমাকে রায়ের বাজার থেকে তুলে
নিয়ে মিনহাজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করব৷
আমি বললাম, আমি ফিরদৌসের এলিফ্যান্ট রোডের সম্ভার বিপনি বিতানে থাকব৷ তুমি সোজা ওখানে
এলে আমাকে পাবে৷
- O.K. তাই হবে৷
টিপু তিনদিন পরে বেলা এগারটায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো হতাশা মাখা মুখে৷ আমি জানতে
চাইলাম কি হল মুখ কেন কালো হয়ে আছে?
- আরে মিয়াজি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজ সকালে দশদিনের বিদেশ সফরে চলে গেছে৷
- ধেৎ তেরি কা৷ এখন দশদিন হাত পা গুটিয়ে বসে থাকো৷ চলো আজকে বগুড়া চলে যায়৷
টিপু বলল, না একেবারে কাজ সেরেই যাব৷ চলো ঘুরে আসি আমার ছোট ফুপুর বাড়ি থেকে৷
আমি ঘুরতে বেড়াতে ভালবাসি আবেগতাড়িত মন৷ যখন যেখানে থাকি তখন সেখানের কথা ভাবি৷ আমার
আঠার বছরের বউ তিনবছরের ছেলে বগুড়ায় যে কিভাবে
আছে তা একবারও ভাবি নি৷ মানুষ এরকম যে হয় তা আমি কখনও শুনি নি৷ আমার সেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার
শাস্তি আমাকে পেতে হয়েছিল৷ আমি দশদিনের মধ্যে আটদিন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে দুপুরটা
কাটিয়ে রাতে রায়েরবাজারে বন্ধুর বাড়িতে চলে আসতাম৷ খালাজান অর্থাৎ ফিরদৌসের মা বকতেন
উনি বলতেন, ছেলে বউকে বগুড়ায় রেখে তুই ঢাকায় কি করছিস?
পাঠক বন্ধুরা আপনাদের
জানানো হয় নি, ফৌরদৌসদের বাড়ি বাগনানে ছিল৷ ওরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে থাকত৷ ওর আব্বা
লেবার কন্টাক্টরের কাজ করতেন৷ ফিরদৌস আমার সাথে
একই স্কুলে পড়ত৷ ওর মনে বড় হবার অনেক স্বপ্ন ছিল৷ ওর বড় ভাই খায়রুল আর ওর মামা ফজলু
দুজনে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পরে ঢাকা চলে যায়৷ তারপর একজন অবাঙালি মুসলমানের ট্যানারিতে
কাজে যোগ দেয়৷ তারপর ফিরদৌস ১৯৬৮ সালে চলে যায়৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফিরদৌস
কলকাতা এসে ওর মা, আব্বা ও ছোটভাইকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে নিয়ে যায়৷ এদিকে স্বাধীনতার
অব্যাবহিত পরে অবাঙালিদের হত্যাকাণ্ড ও সম্পত্তি লুঠতরাজ শুরু হলে ট্যানারির মালিক
তার ট্যানারি মালিকানা খায়রুল ভাইয়ের নামে হস্তান্তরিত করে দেন৷ তাঁর রায়েরবাজারে পাঁচ
কাঠা জায়গা খায়রুল ভাইয়ের নামে রেজেস্ট্রি করে দেন৷ সেই মানুষটার বদান্যতায় ঢাকা শহরের
ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোডের পিছনে ফিরদৌসরা জায়গার মালিক হয়৷ ফিরদৌস ঢাকার ডেলটা ফার্নিশার্স
এর মালিক রহমতুল্লাহ সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ হয়৷ সে এলিফ্যান্ট রোডে ডেলটা ফার্নিশার্সের
শোরুমের পাশে একটা সম্ভার বিপনি বিতান নামে গিফট আইটেমের দোকান করে৷ আমি ফিরদৌসের সঙ্গে
দোকানে এসে বসে থাকি৷ স্কুল জীবনের বন্ধু হাবিব, হাকিম, আক্তাররা কেউ না কেউ আমার সঙ্গে
এসে দেখা করত৷ আক্তার চার পাঁচজন বাংলাদেশীর সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামি লিগের শ্রমিক নেতা
আব্দুল মান্নানকে ধরে নিউ মার্কেটের অবাঙালি মুসলিমের কাপড়ের দোকান দখল করে চালাত৷
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অরাজক পরিস্থিতি আমি নিজের চোখে দেখেছি আর মানবতার পতন স্বচক্ষে
অবলোকন করেছি৷
একদিন মুহম্মদপুরে আমার মামার বাড়িতে ছিলাম৷ সেদিন টিপু মামার বাড়িতে ফোন করে আমাকে
বলল, তুমি আসাদ গেটের কাছে এসে অপেক্ষা কর আমি বাসাবো থেকে আসছি৷ আমি সকাল সাড়ে সাতটা
নাগাদ আসাদ গেট পেরিয়ে রাস্তার ওপারে দেখছি একজন মানুষ শুয়ে আছে৷ কাছে গিয়ে দেখি সে
মৃত তাকে কিছুক্ষণ আগে কে বা কারা মেরে ফেলে গেছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ভিড় জমে
গেল৷ পুলিশ আসার আগে টিপু চলে এসে বলল, চলো শেরেবাংলা নগরে মিয়াজির কাছে যাব৷ মিয়াজি
খুব ভাল মানুষ তিনি আমাদের দরখাস্তে নিজে, পাবনার সংসদ সদস্য আব্দুর রব (বগা মিয়া)
এবং বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী শেখ মুজিবের ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবতের সুপারিশ
করিয়ে রেখেছিলেন৷ আমরা যেতেই বললেন, তোমাদের ফাইল রেডি করে রেখেছিলাম৷ কিন্তু হঠাৎ
করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর সঙ্গে জাপান সফরে চলে গিয়েছিলাম৷ জাপান দেখার নেকদিনের
শখ ছিল৷
আমি জানতে চাইলাম, জাপান ও জাপানিদের কেমন লাগল?
- বিশ্বের সেরা উন্নত দেশ ও সুসভ্য জাতির সুষ্ঠু বিকাশ স্বচক্ষে দেখে এলাম৷
মিয়াজি টিপুকে আমার সম্পর্কে জানতে চাইলেন৷ টিপু বলল, উনি আমার বন্ধু দেলোয়ার কৃষি
বিভাগে চাকরি করেন৷ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় লোক৷ মিয়াজি তিনজনের জন্য নাস্তার অর্ডার
দিয়ে টিপুকে বললেন, বসো নাস্তা খেয়ে যাবে৷ মিনিট দশেকের মধ্যে ক্যান্টিন বয় একটা ট্রেতে
৯ টা পরোটা, ভুনা খাস্সির গোস্ত, রসগোল্লা, কালাকাঁদ আর গরম জিলিপি নিয়ে এলো৷ মিয়াজি
সাহেব ছেলেটিকে বললেন, একটু পরে তিন কাপ চা দিয়ে যাবে৷
আমরা ফাইলটা নিয়ে
M.N.A. হস্টেল থেকে বেরিয়ে গুলিস্তানে যাবার জন্য পথে নেমে দেখি ভয়াবহ কাণ্ড দুদল ছেলের
মধ্যে বোমাবাজি আর গোলাগুলি চলছে৷ এর মধ্যে পুলিশ এসে পড়ায় দুষ্কৃতিরা গা ঢাকা দিতে
শুরু করেছে৷ টিপু বলল, চলো M.N.A. হস্টেলে গিয়ে বসি না হলে পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে৷
তার কথামতো আমরা 'অতিথি কক্ষে' গিয়ে বসলাম! প্রায় এক ঘন্টা প্রচণ্ড বিরক্তিকর সময় কাটিয়ে
আমরা গুলিস্তানে মিনহাজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম৷ তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি বলল,
সাহেব মিডল ইস্ট ট্যূরে গিয়েছেন৷ তিনি এগার দিন পরে ফিরবেন৷ আবার আমাদের বগুড়া ফেরা
আটকে গেল৷ ওদিকে আমার যুবতী বউ আর শিশু পুত্র সন্তান যে কি অবস্থায় পড়ে আছে তা একবারেও
জন্য আমার ভাবনায় আসে নি৷ আমি কি মানুষ না মানবেতর এক দ্বিপদ জন্তু তা এই বার্ধক্যে
এসে ভেবে কূলকিনারা পাই না৷ আমি আসলে অমানুষ টিপুকে সরল বিশ্বাসে ভ্রাতৃসম ভেবে তার
সাহায্যে সাইড ইনকামের স্বপ্নবিলাসে মোহগ্রস্থ হয়ে চরকির মতো ঘুরছি৷ এই স্বপ্নবিলাসিতাই
আমাকে সব দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে দুঃখরসিক করে রেখেছে৷ স্রস্টা শুধু এই মহৎ গুণটা আমাকে দিয়েছিলেন
তাই আমি অন্যের যে কোনও অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার এক সহজাত ক্ষমতার অধিকারি
একজন হামদর্দি(সহমর্মী) মানুষ হতে পেরেছি৷
যা'হোক আমি টিপুকে বললাম, চলো বগুড়া থেকে ঘুরে আসব৷
টিপু বলল, কাজ করেই যাব৷
- কিন্তু আমার ছেলে বউ বাঁচল কি মরলো কোন খবর পাচ্ছি না৷
- চিন্তা করবে না আমার মা সব সময় খোঁজ খবর নেবে৷ ভয় নেই৷
- ভয় নেই জানি কিন্তু আমার বউয়ের আমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা হবে৷
কি জানি তারা কি অবস্থায় আছে? আল্লাহ জানেন৷ কি সর্বনাশ হচ্ছে না গেলে বোঝা যাবে না৷
তবে তোমার সঙ্গে আসাটা আমার অদূরদর্শিতার পরিচয় মাত্র৷
স্বতঃ-লেখক
চলবে (৯৭)