বহুগামী আমি-১০০-সৈয়দ আসরার আহমদ

 


বহুগামী আমি

  সৈয়দ আসরার আহমদ

পর্ব-১০০

 

আমি সাতদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে কাজের খোঁজে কলকাতা যাবার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম৷ সেদিন সকালে চা খেতে খেতে প্রথমে মাকে বললাম, মা আমি কলকাতায় চাকরির খোঁজে যাব৷ জবাবে মা বললেন, সে তো ভাল কথা তবে তোমার আব্বাকে জানিয়ে যেও৷
- তা তো জানাবো৷
আমার কলকাতা যাবার কথা শুনে নাসরিন বলল, আমাকে মায়ের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে৷ তিন বছর মা ভাই বোনদের কাউকে দেখি নি৷
- ঠিক আছে তোমাকে তোমার মায়ের কাছে রেখে আমি ওদিক দিয়ে কলকাতা চলে যাব৷
আমাদের কথোপকথন শুনে মা বললেন, হ্যাঁ তুমি বউমাকে ওর মায়ের কাছে রেখে ওদিক দিয়ে কলকাতা চলে যাবে৷ সেটাই ভাল হবে৷
আব্বা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বাগান বাড়িতে থাকলেও রান্নাবাটি এ বাড়িতে হয়৷ নতুন মা আমার মাকে কোনও কাজ করতে দেন না৷ তিনি বলেন, বড় বিবি আপনার শরীর ভাল না আপনি আগুন পানিতে যাবেন না৷ আমি সোহাগিকে নিয়ে সব সামলে নেব৷ কাজেই মায়ের কায়িক পরিশ্রম খানিকটা কমেছে৷ তবে সংসারে আরেক অংশীদার আসায় মন ভাল না থাকায় যে মনমরা হয়ে থাকেন তা সহজেই বোঝা যায়৷ ওই দিন রাতের খাবার খাওয়ার সময় আব্বাকে বললাম, আব্বু আমি কলকাতা গিয়ে চাকরির চেষ্টা করবো ভাবছি আপনার পারমিশন চাচ্ছি৷
- ভাল তো৷ কবে যাবে৷
- এই রোববার সকালে যাব৷
- কোথায় উঠবে?
- আমাদের পুরনো মেসবাড়িতে৷
- মাসুদ তো ওখানে থাকে না৷
- মাসুদভাই তো ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন৷ মনে হয় বিশ্বজিৎদা এখনও ওই মেসে থাকেন৷ না থাকলেও কোন অসুবিধা হবে না৷ একটা ব্যবস্থা হবে৷
- ঠিক আছে গিয়ে দেখ৷
- মাসুদভাইকে চাকরির জন্য বলব, তাঁর তো বিশাল যোগাযোগ৷
- আল্লাহ ভরসা৷ রুজির মালিক তিনি, চেষ্টা করলে নিশ্চয় কিছু একটা হবে৷
শণিবার দুপুরে নাসরিন আর ববিকে নিয়ে বর্ধমান জেলার তালিত গ্রামে পৌঁছে দিয়ে রোববার বিকেলে আমি বর্ধমান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে হাওড়া চলে গেলাম৷ হাওড়া স্টেশন থেকে বাস ধরে তালতলা এভিনিউ নেমে মেসে গিয়ে উঠলাম৷ মুজাফফর চাচা বাবুর্চিখানায় বসে ছিলেন আমি সালাম জানালাম৷ তিনি আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠে এসে মোসাপা করলেন৷ তারপর জানতে চাইলেন, কবে এসেছি বাংলাদেশ থেকে৷
আমি বললাম, দশ বারো দিন হয়েছে৷
- আবার কবে যাবে?
- আর যাবো না বাজে দেশ৷ জঘন্য শাসক ও শাসকদলের কর্মীরা৷ জিনিসপত্রের অসম্ভব দাম৷ সাধারণ চাকরিজীবীর পক্ষে সংসার চালানো মুশ্কিল৷
- যাও উপরে যাও৷ এখন বিশ্বজিৎ ছাড়া পুরনোরা কেউ নেই৷
বিশ্বজিৎদা ডান পা ভাঁজ করে রেখে তার উপরে বাম পাকে তুলে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলেন৷ আমি বিশুদা বলে আওয়াজ দিতেই অবাক হয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, আরে দেলোয়ার যে, এসো এসো! কবে ফিরলে বাংলাদেশ থেকে?
- দশ বারো দিন হল৷
_ আবার কবে যাবে?
- না আর যাব না৷ বিশুদা সে এক অদ্ভুত অসভ্য সরকার দেশ শাসন করছে গরীব মানুষরা অন্নহীন বস্ত্রহীন উলঙ্গ জীবন যাপন করছে৷ সরকার ও শাসক দলের নেতা পাতি নেতারা চুরি চামারি শুরু করেছে৷ চাকরিজীবীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷
- তাই! শেখ মুজিব উৎশৃঙ্খলতা দমন করতে পারছেন না৷
- যে মানুষ নিজেই দুশ্চরিত্র লম্পট সে কি শাসন করবে৷ সে কোনদিন ভাল কাজ করতে পারবে ভাবছেন কিভাবে৷ ওর ছেলে কামাল ভাগ্নে শেখ মনি সব অরাজকতা আর হিংসা ছড়াচ্ছে৷
- যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের স্বাধীনতার পরে সরকার প্রধানকে শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করতে যে হয় একথা কি বঙ্গবন্ধু জানেন না?
- বঙ্গবন্ধু না বঙ্গশত্রু বলা উচিত৷ একবার
  গিয়ে দেখে আসুন কি অবস্থা গরীব মানুষের! খাদ্যাভাবে না খেতে পেয়ে মানুষ মরে যাচ্ছে৷ মেয়েরা অর্ধ নগ্ন হয়ে ইজ্জত আব্রু রক্ষা করতে পারছে না৷ আর তার ড্রেস প্যারিসের লন্ড্রী থেকে ধোলাই হয়ে আসছে৷ রাস্ট্রপ্রধান হয়ে মানুষের দুবেলা পেটের ভাতটা তো নিশ্চিত করতে হবে তা তিনি ভাবেন না৷ বিরোধীদলের নেতা কর্মীদের মুখ বন্ধ করতে খুন ও গুমের রাজত্ব চলছে৷ এমনই অসভ্য সরকার ও শাসকদল যে আপনি নিজে না গেলে বুঝতে পারবেন না৷ পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ রায়ের আমলে নকসাল দমনের নামে যেভাবে বিরোধীদের উপর অত্যাচার করা হয়েছিল তার থেকেও অনেক বেশি নগ্ন আক্রমনের মুখে সে দেশের বিরোধিরা কোণঠাসা৷ সিদ্ধার্থবাবুর আমলে মানুষের অন্ন বস্ত্রের অভাব হয় নি৷ শেখ মুজিবের অপশাসনে মানুষ ধুঁকছে৷ নবীন জাতি মুক্তির আলোকে আনন্দ উল্লাস করবে কি খেতেই পাচ্ছে না৷ মুজিব সরকার তা দেখেও দেখছে না ৷ বাঙালি জাতির মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে৷ শুনলে অবাক হবেন একজন যুবক শেখ মুজিবের নামে সমালোচনা করায় ছাত্রলিগের কর্মীরা বঙ্গভন্ধুর ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে তার একটা কান কেটে নেয়৷ সংবাদটি ইত্তেফাকসহ সব কাগজে বেরিয়েছিল৷ আর সেই ছাত্রলিগের নেতা মুজিবের আরেক ভাগ্নে শেখ শহীদুল ইসলাম৷
- তাহলে তো সর্বনাশ শেখ সাহেব এটা কি করছেন৷
- বিশুদা শেখ মুজিব কখনও কি ভাল মানুষ ছিল বলে মনে হয় আপনার? জানেন আমি সৈয়দ বদ্রুদ্দোজা চাচার মুখে শুনেছিলাম ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর চামচা হিসেবে বিহার থেকে গুণ্ডা এনে দাঙ্গা লাগিয়েছিল৷ এই ধরণের কালপ্রিটরা কখনও ভাল রাস্ট্রনায়ক হতে পারে না৷ তাদের মধ্যে মানবতাবোধ থাকে না৷ আরও শুনবেন শেখ মুজিব একজন দুশ্চরিত্রের মানুষ বলে শুনে এলাম৷
- তাই? কি শুনেছ?
- কুমিল্লার M.N.A. মমতাজ বেগমের সঙ্গে তার affairs অর্থাৎ লটঘট ছিল৷
- কি দুর্ভাগ্য আমাদের এই উপমহাদেশের অধিকাংশ রাস্ট্রনায়কের চারিত্রিক দুর্বলতা এক মারাত্মক ব্যাধির মতো সংক্রামক হয়ে পড়েছে৷ ছিঃ লজ্জা লজ্জা!
- ঠিক বলেছেন বিশুদা৷
- তুমি কি এখন কলকাতায় থাকবে?
- হ্যাঁ থাকার জন্য এসেছি৷ চাকরির চেষ্টা করবো৷
- যাক ভাল হল এখানে একজন সম্প্রতি সিট ছেড়ে চলে গিয়েছে তুমি ওই সিটটাই থাকতে পারবে৷ অবশিষ্ট পাঁচজনই বিভিন্ন ভার্সিটির ছাত্র৷ তারা খুবই ভাল ছেলে এবং মেধাবি ছাত্র৷ তুমি এখন যেকোন কাজ পেলে গেলে যাবে৷ টিউশনও করতে পারো৷
- সেটাই, তবে শামিমভাইয়ের সঙ্গে আগামীকাল দেখা করে চাকরির জন্য বলব৷
- হ্যাঁ শামিমদা তোমার একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিক করে দেবেন৷ যাও কাপড় ছাড়ো মুখ হাত ধুঁয়ে বসো৷ বাবুর্চি সাহেবকে চা দিতে বলি৷
- আমি বলছি৷
- না তোমাকে বলতে হবে না আমি বলে দিচ্ছি৷
বিশুদা বাবুর্চি চাচাকে দুকাপ চা বানিয়ে আনতে বললেন৷ আমি ফ্রেস হয়ে এসে ফাঁকা তক্তপোষে বিছানা পাতলাম৷ এই সেই পুরনো আস্তানা যেখানে আমরা পাঁচ বন্ধু শামিমভাই আর বিশুদার সঙ্গে কমবেশি তিন বছর কাটিয়েছি৷ বিশুদা ছাড়া অন্যরা সবাই চলে গিয়েছে৷ এই চার বছরে ওরা কে কোথায় আছে জানি না৷ বিশুদা হয়তো জানেন৷ ওদের খোঁজ খবর পরে বিশুদার কাছে শোনা যাবে৷
বাবুর্চিচাচা চা দিয়ে গেলেন৷ শামিমা ভাই চলে গেছেন এখন বিশুদা টেবিলের উপর শামিমভাইয়ের মতো কৌটোতে বিস্কুট রাখেন৷ তিনি দুটো বিস্কুট আমাকে দিলেন নিজে একটা নিলেন৷ চা খেতে খেতে বিশুদা বললেন, সাখোয়াত M.A.তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে Phd করে কলেজে পড়ায়৷ সে শ্রাবন্তীকে সিভিল ম্যারেজ করেছে৷ শ্রাবন্তী আট নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পায় নি৷ শারমিন ৬ নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস পায় নি৷ নাজনিন দশ নম্বর কম পেয়েছিল৷ ওরা চারজনে Phd করেছে৷
- সাখোয়াত কোথায় থাকে কোন কলেজে পড়ায়?
- সিটি কলেজ মেন আর শ্রাবন্তী জয়পুরিয়া৷ শারমিন লেডি ব্রাবোর্নে আর
  নাজনিন সুরেন্দ্রনাথ গার্লসে লেকচারার৷
- দারুণ খবর৷ কিন্তু সাখু তো শারমিনকে বিয়ে করবে বলত৷ শ্রাবন্তীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে সম্পর্ক কেটে গিয়েছিল৷
- কি জানি বাপু অতশত জানি নে৷ সাখোয়াত তার বউভাতের নিমন্ত্রণ করতে
  কার্ড দিতে এসেছিল তখনই গল্প করছিল৷
- সাখোয়াত শারমিনকে বিয়ে না করে তাকে বন্চিত করল৷ আমার স্বগতোক্তি শুনে বিশুদা প্রশ্ন করলেন, সাখোয়াত কি শারমিনকে বিয়ে করবো বলেছিল?
- আঁ..হ্যা..না মানে...
- মানে কি? যা জানতে চাচ্ছি তার জবাব দাও৷ বিশুদার কন্ঠে বিরক্তির ভাব মিশেছিল৷
- আমি বললাম, শুনেছিলাম শারমিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্যে শ্রাবন্তী সাখোয়াতের সঙ্গে রিশেলন কাট অফ করে দিয়েছিল৷
- তাই! শেষে সেই শ্রাবন্তীকেই বিয়ে করেছ৷ Very interesting matter indeed! Surprising এই অবক্ষয়ের ঘুগে এসবই হচ্ছে ওসুল৷
- পুরো বিষয়টা জানতে হবে তারপর আপনাকে বলব৷ তবে বিশুদা আপনি কি জানেন, সাখোয়াত কোথায় ফ্ল্যাট নিয়েছে৷
- আরে সে আরেক মজার ব্যাপার তোমার স্বপ্না বৌদিদের কেষ্টপুরের এপার্টমেন্টে সাখোয়াতরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে৷
- এতো নাটকীয় ব্যাপার৷ তাহলে সাখুকে কেষ্টপুরে পেয়ে যাব৷ ও কি এদিকে আর আসে না৷
- Rare হয়তো ছ মাস ন মাস পরে খেয়াল হলে আসে৷

 

Post a Comment

Previous Post Next Post