বহুগামী আমি-৯৯ সৈয়দ আসরার আহমদ

 


বহুগামী আমি

সৈয়দ আসরার আহমদ  

পর্ব - ৯৯

 

 বহরমপুর পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল তাই কলেজ ফ্রেণ্ড সোহরাবের বাড়িতে নাইট হল্ট করতে হয়েছিল৷  পুরনো বন্ধুকে দেখে সোহরাবের মন দারুণ খুশিতে নেচে উঠেছিল৷ কি দিয়ে যে সে আমাদের আপ্যায়ন করবে ভেবে পাচ্ছিল না৷ দীর্ঘদিনের পরে আমাকে দেখে প্রথমে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল৷ তারপর চা নাস্তা খেয়ে দুজনে গল্প করতে বসলাম৷ খাজিম, রাজ্জাক, আমিরসহ পুরনো বন্ধুদের খোঁজ খবর নিলাম৷ আমি চার বছর বিদেশে বিভূঁইয়ে কিভাবে কত কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছি সব বললাম৷ রাত আড়াইটা পর্যন্ত দুই বন্ধুতে গল্প করে কাটালাম৷ রাতে ওর বউ পোলাও আর মোরগের কোরমা রান্না করেছিল৷ সোহরাব স্কুলে মাস্টারি পেয়েছে৷ সে তার খালাতো বোন নীলুফারকে বিয়ে করেছে৷ ওর খালু অর্থাৎ ওর শ্বশুর তাঁর বন্ধুকে ধরে ভাবতা স্কুলে চাকরি ঢুকিয়ে দিয়েছেন৷

 যখন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম তখন রাত সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল৷ রাস্তার ধারের ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে বড় বোন রুবি আপা কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ 

 - বুবু আমরা এসেছি৷

- দিলু! দাঁড়া দরজা খুলে দিচ্ছি৷ 

 আমার গলার স্বর সে বুঝে গিয়েছিল৷ টাটকা ঘুমের ঘোর কাটিয়ে মা মাগো দিলুরা এসেছে দেখ্যান বলে আনন্দে কলরব  করে উঠল৷ 

 সবাই কাঁচা ঘুমে উঠে এলো৷ আমি না থাকায় মা খুব মনোকষ্টে ছিলেন৷ মায়ের শারীরিক অক্ষমতার জন্য আব্বা মায়ের অনুমতি নিয়ে আরেকটি বিয়ে করেন৷ সেই বউকে নিয়ে বাগানবাড়িতে একটা তিন কামরার ঘর করে বসবাস করতে শুরু করেন৷ আমি বাংলাদেশ চলে যাওয়ার পরে আব্বা বিয়ে করেন৷ মা মৌখিক অনুমতি দিলেও তাঁর অন্তরাত্মা সায় দেয় নি ফলে দিন দিন রুগ্ন হয়ে পড়ছেন৷ তার উপরে আমার অনুপস্থিতি তাঁর মনোপীড়াকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল৷ মা তো আমাকে দেখে কাঁদতে লাগলেন৷ তাঁর কান্না সবার মধ্যে সংক্রামিত হল৷ আমি বাংলাদেশে গিয়ে আমার স্ত্রীর ইজ্জত সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারি নি বলে তাঁদের কান্নার সঙ্গে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম৷ তবে মুখে কিছু বললাম না৷ আমার কান্না এই প্রথম নাসরিন দেখে ভয়ে খেয়ে গিয়েছিল সে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবছিল এই বুঝি আমি সব বলে দেব ৷ কিন্তু না আমি অত বোকা না৷ সেকথা বললে তো আমাকেই দুষবে সবাই তারা বলবে স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করতে পারো নি, কি ধরণের পুরুষ তুমি? আর নাসরিনকে তালাক দিয়ে দিতে বলবে৷ তালাক দিলে আমার ববির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে৷ আমার সংসার ভেঙে যাবে৷ আমি যে তা চাই না নাসরিন সেটা ভাবতেই পারে না৷ তবে তাকে আমি যে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসি তা সে জানে৷

 এ বাড়িতে কান্নার রোল শুনে আব্বা ও আরেক মা এসে হাজির৷ আমি তাদেরকে কদমবুসি করতেই নাসরিনও করল৷ আব্বার প্রথম প্রশ্ন কি হল বাংলাদেশ ভাল লাগল না?

- জঘন্য শাসকের অপশাসনে মানুষ ধুঁকছে৷ ওদেশে আমার পক্ষে সংসার ম্যানেজ করা অসম্ভব৷ 

- যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে তোমাকে যেতে আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম তুমি শুনো নি৷ 

  আমি আব্বার কথার কোনও জবাব দিলাম না৷ আমার বদলে মা বললেন, ভুল করেছে ছেলেকে আর যেতে দেব না৷ এই খানে করে কর্মে খাবে৷ 

- সেকথা তো আমি আগেই বলেছিলাম চাকরি কি সবাই পাচ্ছে? চাকরি ছাড়া মানুষ বেঁচে নেই? কত রকম ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবন নির্বাহ করা যায়৷ তখন শোনে নি মানা৷ যাক গে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলো৷ চিন্তা করিস না রে বাবা আল্লাহ রুজি দেবেন৷

 সেই রাতে মা রান্নাশালে গিয়ে স্টোভে ডালে চালে খিচরি চাপিয়ে দিতে বললেন কাজের মেয়ে সোহাগীকে৷

 আমি চার বছর পরে ফিরে সবচেয়ে ছোট ভাইটাকে কোলে বসিয়ে নিলাম৷ ও শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাই স্বরভঙ্গ হয়েছে৷ তার কথায়র স্বরে তা প্রতীয়মান হল৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাল করে করে পড়ছো তো ভাই৷

- জ্বি ভাইয়া৷

 মা বললেন, খোকন সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে ফার্স্ট হয়ে৷

- তাই? আমি খোকনকে আদর করে কপালে চুমু খেলাম৷ আমি জানতে চাইলাম, ইংরেজিতে কত পেয়েছ?

- ভাইয়া, আমি ইংরেজিতে ৯২ পেয়েছি৷

- অংকে?

- ভাইয়া, আমি অংকে ১০০ পেয়েছি৷

- বাংলায়?

- ভাইয়া, বাংলায় ভাল হয় নি ৭৫ পেয়েছি৷

- ইতিহাসে?

- ভাইয়া, ইতিহাসে ৮২ পেয়েছি৷

- ভূগোলে?

- ভাইয়া, ভূগোলে গণ্ডগোল হয়েছে ৭০ পেয়েছি৷

- বিজ্ঞানে?

- ভাইয়া ১০০ তে একশো৷

- মাশ আল্লাহ ! 

মা'কে জিজ্ঞেস করলাম ছোটবোন তুলি কই?

- তুলি তোমার খালার বাড়ি বর্ধমানে বেড়াতে গেছে৷

- কবে ফিরবে?

তোমার আব্বার আজকে আনতে যাবার কথা ছিল কিন্তু তোমার খালু ওকে ফোন করে বলেছে৷ সে দু একদিনের মধ্যে তুলিকে নিয়ে আসবে৷

 আমরা দুই ভাই দু বোন৷ বড় বোনের বিয়ে হয়েছে বীরভুমে ওর স্বামি আর্মিতে কাজ করে৷ মা বললেন, ছবি তিনদিন হল এসেছে৷ ওর বেবি হবে৷ 

- তাই! সুখবর! আমি মামা হব৷

- ঠিক বলেছেন ভাইয়া আমিও হব৷

- হ্যাঁ ভাই, আমরা দুজনে মামা হবো৷ তুলি খালা হবে৷ মা আব্বা নানা নানি হবেন৷

- দারুণ মজা হবে না ভাইয়া? বাবুটাকে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াব৷ আব্বাকে বলব, বাবুর জন্য একটা তিন চাকার সাইকেল কিনে দিতে৷

- হ্যাঁ ঠিক বলেছ৷ সাইকেল কেনা হবে৷

 মধ্যরাত্রে আমাদের বাড়িতে কান্নার রোল শুনে মেজ ও ছোট চাচা চাচি ও চাচাতো ভাই বোনেরা উঠে এসেছিলেন৷ মেজ চাচা বললেন, বাপের কথা শুনো নি তাই চার চারটে বছর নষ্ট করে এলে৷

 আব্বা ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, ঠিকই বলেছ কিন্তু বাচ্চা তো ভুল করে কষ্ট পেয়েছে অভিজ্ঞতা হল৷ কি আর করা যাবে!

 আমি মনে মনে বললাম, কষ্ট বলে কষ্ট যে কষ্ট আমার বুকে বাসা বেঁধেছে তা কাউকে কখনও কোনও অবস্থাতে বলা যাবে না৷

 মা রান্নাশালে গিয়ে রাতের খাবার বেড়ে আমাদের ডাকলেন৷ আমরা রান্না ঘরে গিয়ে খেতে বসলাম৷ খোকন আমাদের সঙ্গে বসল তবে খেলো না৷ সে শুধু বসে বসে আমাকে আর ববিকে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল৷ আর আমিও আমার প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইটার আমার অবর্তমানে শারীরিক বির্বতন লক্ষ্য করছিলাম আর নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল৷ আমি কোন শয়তানের প্ররোচনায় এদের ফেলে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম, সেকথা ভাবছিলাম৷ আর ভাবছিলাম কি পাপ আমি করেছিলাম যে এত বড় শাস্তি পেলাম৷ আমার কান্না এসে গেল রাতের খাবারের সামনে কাঁদলাম৷ অনেকক্ষণ ধরে হাহাকার করে কাঁদলাম৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এবং উচ্চস্বরে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে গেলাম৷ আমার কান্নার সঙ্গে মা কাঁদছিলেন তা দেখে নাসরিন ও ববি কাঁদতে থাকল৷ কিন্তু কেউ আমার কান্নার প্রকৃত কারণ জানল না৷

চলবে………………  

Post a Comment

Previous Post Next Post