বহুগামী আমি
সৈয়দ আসরার আহমদ
পর্ব-৯৮
মিনহাজউদ্দিন সাহেব
ঢাকায় ফেরার দুদিন পরে আমাদের ডিলারশিপের অনুমোদন দিলেন৷ এ দিকে এ কাজ করতে এক মাসের
বেশি সময় অতিবাহিত হল৷ আমরা অনুমোদন পত্র হাতে পেয়ে বিকেলে বগুড়া যাবার বাসে চাপলাম৷
রাত্রী তিনটে কোয়ার্টারে ফিরে দরজার কড়া নাড়লাম৷ নাসরিন দরজা খুলে দিল ঘরে ঢুকে দেখি
সফিকুল মশারির মধ্যে শুয়ে ববিকে এক পাশে দিয়ে নাসরিনের কাছে ঘুমিয়েছিল৷ আমি ব্যাপারটা
দেখে হতবাক হয়ে গেলাম৷ সিন ক্রিয়েট করলে অপমানিত আমি হব৷ নাসরিনের দুর্নাম হবে৷ এক্ষেত্রে
সবচেয়ে বেশি নিন্দনীয় হচ্ছে আমারই অপরিণামদর্শীতা আর অযোগ্যতা৷ যারা শুনবে তারা তো
আমাকেই দুষবে৷ তারা বলবে, তুমি আসলে একজন ননসেন্স বউ ছেলের হেফাজত করতে পারো না৷
এই সব সাত সতেরো ভেবে চুপ করে থাকলাম৷ আমার সে রাতে আর ঘুম আসে নি৷ এক মাসের বেশি সময়
ধরে সফিকুল মনে হয় ব্ল্যাক মেইল করেছে৷ সে জানত বগুড়ায় আমাদের দুজনের কেউ আপনজন নেই৷
নাসরিনকে হয়তো ভয় দেখিয়েছে যে দেহ না নিলে ববিকে মেয়ে ফেলবে৷ কিংবা দেহ দিতে রাজি না
হলে টিপুর মায়ের দেওয়া খাবার এনে দেবে না৷ খাবার এনে না দিলে মা ও সন্তান অভূক্ত থাকবে৷
প্রকৃত ঘটণা কি হয়েছিল যে সফিকুলকে পাশে শোয়াতে বাধ্য হয়েছিল৷ সে সব কথা আমার জানতে
ইচ্ছে করলো না৷ আমি স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে একা রেখে যে চলে গিয়ে ভুল করেছিলাম তার
শাস্তি পেয়েছি৷ শুধু নিজের ভুল সিদ্ধান্তকে দোষারোপ করে চুপ থাকলাম৷ আর নাসরিনকে বললাম,
কখনও কোনদিন আমি জানতে চাইলে কি কারণে তুমি সফিকুলকে শরীর ভোগ করতে দিতে বাধ্য হয়েছিলে
তা বলবে না৷ কেননা তোমার উপরে আমার অগাঢ বিশ্বাস এখনও আছে যে,তুমি ইচ্ছে করে তাকে শরীর
দাও নি৷
পাঠক বন্ধুরা আমি জানি, আমার কথা আপনারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে
চাইবেন না৷ আপনাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, এমন নপুংসক পুরুষ পৃথিবীতে কি কেউ আছে! আপনাদের
অনেকের মনে হতে পারে ওই দুষ্কৃতিটাকে আমি শাস্তি দিলাম না কেন? আমি মেরে ফেললাম না
কেন? তাকে মেরে ফেলার চিন্তা যে মাথায় আসে নি তা নয়৷ আমি খুব সহজেই মেরে ফেলতে পারতাম৷
তাকে মারলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যেত৷ আমি না থাকলে নাসরিন ও ববিকে কে খাওয়াবে৷ তাদের
কথা ভেবে আমি যে রাগ সংবরণ করেছিলাম তাতে একবিন্দু মিথ্যা নেই ৷ ঘটণার সাক্ষী বিধাতা৷
সমাজে নিজেকে ও নাসরিনকে দুর্নামের হাত থেকে বাঁচাতে সেসঙ্গে ববির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা
করে আমি মুখ বন্ধ রেখেছিলাম৷ আর আজ বলতে লজ্জা নেই যে, সফিকুলের সঙ্গে মাসাধিককাল সঙ্গমের
ফলে স্বাভাবিকভাবে নাসরিন গর্ভধারণ করেছিল৷ সেকথা জেনেও আমি একটা জীবন নষ্ট করতে গর্ভপাত
করাই নি৷ নাসরিন বলেছিল abortion করাতে৷ তার জবাবে আমি বলেছিলাম, থাক একটা জীবন আমি
সৃষ্টি করতে পারি না যখন, তখন মারার অধিকার আমার নেই৷ ও তোমার সন্তান হয়ে থাকবে৷
আমি জানি, আমার
একথা পৃথিবীর কেউ আজ বিশ্বাস করবে না৷
যা'হোক যথাসময়ে নাসরিনের প্রসব বেদনা ওঠে ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় ৷ দুদিন পরে
পূত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়৷ তার সেবা যত্নে কোন প্রকার অবহেলা করা হয় নি৷ শুধু যেদিন বাংলাদেশ
থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়ে রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে আসছিলাম সেদিন
পদ্মানদীতে নৌকায় ওঠার সময় মনে হয়েছিল বাচ্চাটাকে নদীতে ফেলে দিই৷ কিন্তু নিজেকে সামলে
নিয়েছিলাম এই ভেবে যে বাচ্চাটাকে মেরে ফেললে নাসরিন খুব মনোকষ্ট পাবে৷ ফলে আমি তার
বিরাগভাজন হবো৷ আর এই মানব শিশু আমার কি অপরাধ করেছে যে, তাকে আমি খুন করবো? এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্বে
আমার বিবেকের জয় হল, আমি সস্নেহে নবজাতকটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি আমার ঘরের মেহমান তোমার
হেফাজত করা আমার একান্ত কর্তব্য৷ তোমার আর কোনও ভয় নেই৷ তুমি এখন ফেরেস্তার মতো নিষ্পাপ৷
আমার অসৎ চিন্তা করাটা ভুল হয়েছে মার্জনা করবে৷ কথাগুলো আমি নিজের অজান্তে বিড়বিড় করে
বলছিলেন নাসরিন উৎকর্ন হয়ে যে শুনছিল তা আমি একদম খেয়াল করি নি৷
যেদিন বগুড়া থেকে
স্বদেশভূমিকে ফিরে আসার জন্য রাজশাহীতে খালার বাড়িতে উঠেছিলাম সেদিন সাইদা খালা প্রশ্ন
করেছিলেন, কি ব্যাপার কোথায় যাবার জন্য বেরিয়েছ?
আমি বলেছিলাম, খালাজান এত অল্প বেতনে সংসার চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব তাই দেশে ফিরে
যাব৷ এখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লিগের অপশাসন আর অরাজকতায় নিত্য প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্রের যা দাম আমার বেতনে দশদিন চলে না৷
পাশের চেয়ারে খালুজান বসেছিলেন, ঠিকই বলেছে দেলোয়ার খুব সংকটজনক পরিস্থিতি প্রচুর মানুষ
না খেয়ে মরে যাবে? ঠিক আছে তোমরা ফিরে যাও৷ আমি ভাল লোক দিয়ে দেব তোমাদের বর্ডার পার
করে দেবে৷
খালুজান পুলিশের অফিসার তাঁর অফিসের একজন কনস্টেবল আমাদের সুষ্ঠুভাবে বর্ডার পার করে
নৌকায় উঠিয়ে দিলেন৷
বিদায় বাংলাদেশ বলে পদ্মা পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদে পৌঁছে গেলাম৷
চলবে….. (৯৯)