বহুগামী আমি
সৈয়দ আসরার আহমদ
পর্ব- ৯৪
দিলওয়ার শব্দটি বাংলায়
দেলোয়ার হয়েছে৷ দিলওয়ার অর্থ হচ্ছে দিলওয়ালা৷ সে ইতিহাসে M.A. কমপ্লিট করলো না৷ রাজশাহীর
সিরোইল ঘোড়ামারায় ওর ছোট নানা আর বড় খালা থাকেন তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ চলে
গেল৷ ওখানে গিয়ে প্রথমে ওর খালাতো মেজ বোন বেলিআপার বর কৃষি বিভাগের উপ পরিচালক ছিলেন৷
তাঁর বগুয়ায় পোষ্টিং ছিল৷ তিনি বগুড়ায় তাঁর দফতরে একটা চাকরি করে দিলেন৷ চাকরিতে ঢুকে
সে তার বেলি আপার সরকারি কোয়ার্টারে কিছুদিন থেকে ওই আবাসনে একজনের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট
হয়ে থাকতে শুরু করে৷
দেলোয়ার তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে তার শ্বশুর বাড়িতে রেখে দিয়ে রাজশাহী চলে গিয়েছিল৷ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে বগুড়ায় ঘর ভাড়া করে স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে যায়৷ যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে মুজিবের অপশাসনে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইয়ে চলে যায়৷ শুরু হয় অসৎ ব্যবসায়ীদের ফটকাবাজি৷ সরকারি চাকরি ছেড়ে স্বদেশে ফিরে আসতে তার মন বাধা দিচ্ছে৷ কেননা নিজ জন্মভূমিতে সরকারি চাকরি তো দূরের কথা বেসরকারি সংস্থাগুলো মুসলিমদের চাকরি দেয় না৷ বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ অবাঙালি ব্যবসায়িদের মালিকানাধীন৷ তারা খুবই মুসলিম বিদ্বেষী৷ দেলোয়ারের বাংলাদেশ যাবার কথা জানতে পেরে ওর আব্বা তাকে যেতে নিষেধ করে বলেছিলেন, তুমি এখানে থেকে চাকরির চেষ্টা কর৷ চাকরি না পেলে ব্যবসা করবে৷ সবাই কি আর চাকরি পায়?
সেদিন দেলোয়ার তার আব্বার কথা শোনে নি৷ সে মুর্শিদাবাদ দিয়ে রাজশাহী চলে গিয়েছিল৷ এখন বুঝতে পারছে সে কি বিশাল ভুল করেছে৷ যা বেতন পায় তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার দশও দিন চলে না৷ সে অংকে দুর্বল তাই নবম দশম শ্রেণীর ছাত্রদের টিউশনি করতে পারে না৷ একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্ররা শুধু ইতিহাসে টিউশন নেয় না৷ সেজন্য ইতিহাস অনার্স ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়াদের টিউশন খোঁজে ৷ কিন্তু তেমন ছাত্রছাত্রী পাওয়া যায় না৷ বেশির ভাগ পড়ুয়ারা কলেজ শিক্ষকদের প্রেফার করে৷ বগুড়ায় নতুন এসেছে তাই তেমন জানাশোনা নেই৷ অফিসে শরিফ সাহেবের বাড়ি মুর্শিদাবাদে ছিল৷ দেলোয়ারের কথাবার্তা শুনে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে সে পশ্চিমবঙ্গের যুবক৷ শরিফ সাহেব অফিসের হেড ক্লার্ক৷ তিনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কবে এসেছ বাংলাদেশে?
দেলোয়ারকে ওর বেলিআপার স্বামি বলে দিয়েছিলেন, অফিসে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ১৯৭০ সালে
এসেছি৷ কথাটা ভাগ্যিস মনে পড়েছিল আত্মভোলা দিলওয়ালা দেলোয়ারের৷ তাই সে বলেছিল, ২৫ শে
মার্চের কয়েকদিন আগে এসেছে সে৷ এসে বিপদে পড়ে গিয়েছে৷
শরিফ সাহেব বলেছিলেন, একে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি চুরমার হয়ে গিয়েছে অন্যদিকে
আওয়ামি লিগের লোকেরা টপ টু বটম দূর্নীতিতে ডুবে আছে৷ কি যে হবে দেশের!
দেলোয়ার তাঁকে বলেছিল, এখানে কোন টিউটোরিয়াল হোম নেই? থাকলে আমি ইতিহাস আর ইংরেজি পড়াতাম৷
- আছে তো৷ তুমি যোগাযোগ করতে পার৷ আমার জামাই একটা টিউটোরিয়াল হোম চালায়৷ তোমার সঙ্গে
তার পরিচয় করিয়ে দেব৷
- শুকরিয়া, খুব উপকার হবে আমার৷ দয়া করে কথা বলে নেবেন৷ আমি দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত
ইংরেজি,ইতিহাস,বাংলা পড়াতে পারব৷
- ইন শা আল্লাহ আমি আজই জামাইয়ের সঙ্গে রাত্রে কথা বলব৷
পরের দিন অফিসে টিফিন টাইমে শরিফ সাহেব তাকে ডেকে বললেন, তুমি আমার জামাতার নব দিগন্ত
টিউটোরিয়ালে আজ সন্ধ্যায় আমার সাথে যাবে৷ জামাই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে৷
- জ্বি আচ্ছা, তাই যাবো৷ এখানে এই বেতনে সংসার চালানো খুবই মুশকিল৷ বেতনের টাকায় ঘর ভাড়া দিয়ে দশ দিনও
চলে না৷ বাচ্চার দুধের টাকা থাকে না৷
দেলোয়ারের আর্থিক টানাপোড়েনের কথা শুনে শরিফ উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি মজবুত করার দিকে মুজিব প্রশাসন নির্দ্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা নেয় নি৷ তাঁর সন্তান কামাল ও তাঁর আত্মীয় পরিজনরা গুণ্ডা গর্দি শুরু করেছে৷ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী অথচ সরকারের সেদিকে খেয়াল নেই৷ গরীব মানুষদের খাবার জোটে না৷ অর্ধভুক্ত হয়ে থাকতে হয়৷ গরীব মানুষদের পরনের কাপড় জোটে না৷ বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মুস্তাক আহমদ ওয়েজ আর্নার স্কিমে বিদেশ থেকে পুরনো বস্ত্র আমদানী করে গরীবমানুষদের বস্ত্র সংকট মেটানোর চেষ্টা করেন৷ তা নিয়েও আওয়ামী লিগের সমর্থক এক শ্রেণীর শয়তান ব্যবসায়ীরা ফটকাবাজি শুরু করে দিয়েছে৷
শরিফ সাহেবের কথা শুনে দেলোয়ারের মনে হল 'সুখের লাগিয়া এ দেশে আসিনু পড়িনু দুঃখের সাগরে'৷ এ কি সর্বনাশ করেছে সে৷ দেলোয়ার তার আব্বাজানের নিষেধ অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশে এসে ফিরে যেতে পারছে না৷ মুজিবের আওয়ামী লিগ , যুব লিগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনি এবং ছাত্রলিগের নেতারা অবাঙালিদের সম্পত্তি লুঠতরাজ করছে৷ সারা দেশে অরাজকতা চলছে৷ দুর্বলের উপর লিগের কর্মীদের জোর জুলুম শুরু হয়েছে৷ দেলোয়ার ভাল ভাবে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে পরভূমিতে এসে ভয়াবহ বিপদের সমুখ্খীন হয়ে পড়েছে৷ প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় স্বজনরা নিজেরাই বিড়ম্বনায় দিন কাটাচ্ছে দেলোয়ারকে দেখার তাদের মানসিকতা নেই৷ কিন্তু যখন প্রথম সে বাংলাদেশে আসে তখন সব আত্মীয়দের তুমুল আতিথেয়তায় সে বিভ্রান্ত হয়ে যে ভুল বুঝেছিল তা এখন তার মনকে দগ্ধ করছে আর নিজের আবেগী মনের বাস্তবজ্ঞানহীনতাকে নিজেই দুষছে৷ কিন্তু দুষে কি লাভ হবে? চাকরির বেতন ছাড়া আরও বাড়তি ইনকামের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এই চিন্তায় সে নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে৷ সে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কার রিক্রুটমেন্ট কমিটির প্রবেশনারি অফিসার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিল৷ সেই পরীক্ষার admit card তার খালার বাসার চলে এসেছিল৷ ঢাকায় তার মামা থাকতেন৷ তাঁর বাসায় উঠেছিল পরীক্ষা দিতে গিয়ে৷ পরীক্ষা হলে তার পাশে M.Sc (Math) টাঙ্গাইলের সুশান্ত সিনহা নামে একজন পরীক্ষার্থীর সিট পড়েছিল৷ দেলোয়ার অঙ্কে খুব দুর্বল কিন্তু ইংরেজি ও জেনারেল নলেজে দক্ষ৷ সে সুশান্তকে বলেছিল, তোমাকে আমি G.K. ও ইংরেজিতে সাহায্য করব তুমি আমাকে অঙ্কে সহযোগিতা করবে৷ সুশান্ত তাতে রাজি হয়৷ দেলোয়ার ইংরেজি টু বেঙ্গলি ও বেঙ্গলি টু ইংলিশ সুশান্তকে দেখিয়েছিল৷ তার পরিবর্তে সুশান্ত তাকে অঙ্কের ৮০ নম্বরের উত্তর দেখিয়েছিল৷ দেলোয়ার তাকে G.K. উত্তরও বলে দিয়েছিল৷ সুশান্ত সেই পরীক্ষায় পাশ করে দেলোয়ারও করেছিল৷ প্রবেশনারি পিরিয়ডে স্টাইফেন তিন শো টাকা৷ বর্তমানে ও যেখানে চাকরি করছে সেখানে পায় চার শো টাকার কিছু বেশি৷ তাই ব্যাংকে জয়েন করে নি৷
অফিস শেষে শরিফ সাহেব দেলোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে জামাইয়ের বাড়ি গেলেন৷ উনি যাবার আগে অফিস
থেকে মেয়ে সেলিনাকে ফোন করে সন্ধ্যায় যে তাদের বাড়ি যাচ্ছেন তা অগ্রিম জানিয়ে দেন৷
তাঁর জামাই মাসুম ঘরে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ মাসুমরা বগুড়ার স্থানীয় লোক হলেও
ওদের আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীতে ছিল৷ স্বাধীনতার সময় ওর আব্বা অপশন দিয়ে পূর্ব
পাকিস্তান চলে আসেন৷ পরে সম্পত্তি এক্সচেন্জ করে বগুড়ায় স্থায়ী হন৷ শহরের অভিজাত এলাকা
দত্তবাড়ির দত্তবাড়ি রোডে ওদের তিনতলা বাড়ি৷ বাড়ির দোতলায় মাসুমের নব দিগন্ত টিউটোরিয়াল
হোম ৷ রাস্তা থেকে সাইন বোর্ড দেখা যাচ্ছে৷ শরিফ সাহেব দরজায় কলিং বেল টিপতেই মাসুম
দরজা খুলে সালাম দিল৷
শরিফ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে মোসাফা করে ঘরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসলেন৷
দেলোয়ার সোফায় বসার সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি মাসুম মাহমুদ৷
দেলোয়ার হ্যান্ডসেক করতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি দেলোয়ার হোসেন৷ খুব খুশি হলাম আপনার
সঙ্গে পরিচিত হয়ে৷
শরিফ সাহেবকে দেখে ওর মেয়ে সেলিনা এসে সোফায় তাঁর পাশে বসল৷ শরিফ সাহেব মেয়ের সঙ্গে
দেলোয়ারের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷
পাঠক বন্ধুরা আমি দেলোয়ারের সম্পর্কে যতটা সম্ভব বললাম এবার দেলোয়ার নিজেই বলবে তাঁর আত্মকথন৷ আর জীবন যন্ত্রণার কথাকাহিনী৷
স্বত্বাধিকারীঃ লেখক
চলবে