বহুগামী আমি
সৈয়দ আসরার আহমদ
পর্ব-৯৩
দিবাবসানে
রাত্রী আসে আবার প্রাকৃতিক নিয়মে অন্ধকার কেটে গিয়ে প্রভাতে সূর্য ওঠে৷ তেমনই মানুষের
জীবনে সুখের পরে দুঃখ পুনরায় দুঃখের মেঘ সরে গিয়ে সুখের বর্ষন শুরু হয়৷
শোভার ডেলিভারি হবার
পর একমাসের ম্যাটারনিটি লিভ শেষে অফিসে এলো৷ বাচ্চাটাকে মৌ নিয়ে ওর মায়ের কাছে রেখে
দেয়৷ মৌয়ের মা সুজাতা দেবী শিশুদের খুব ভালবাসেন৷ শোভা ফিডার বটল glaxo চিনি ছাড়া বাচ্চার
জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রসহ তার পুত্র সন্তানকে তাঁর হেফাজতে রেখে মন
মরা হয়ে অফিসে এসে আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল৷
শোভা বলল, আজ জয়েন
করে আগামীকাল থেকে পনের দিনের earned leave নেব৷ আমাকে বলল, একটা দরখাস্ত লিখে দাও৷
- এখনই লিখে দেব?
- টিফিনের পরে লিখবে৷
তোমার টিফিন এনেছি৷ এ কদিন টিফিন খেতে খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?
- স্বাভাবিক ব্যাপার৷
পয়সা বেশি খরচ হলেও মন ভরে নি৷
- আর কয়েকটা দিন
কষ্ট করে টেনে দাও৷
- দিন চলে যাবে৷
তুমি নিজের ও বাবুর যত্ন নেবে৷ মৌ তোমার কাছে ঘুমায়?
- হ্যাঁ ও তো তখন
থেকে আছে৷ তুমি আজ গাঙুলিবাগানে যাবে? গেলে মৌ খুব খুশি হবে৷
- তুমি যেতে বললে
যেতে হবে৷
- যেতে চাইলে যেতে
পারো৷
- এখন কিছুদিন আমি
যেতে চাচ্ছি না৷ তুমি যখন মেডিকেলে ছিলে তখন মৌয়ের সঙ্গে তো তিন রাত ঘুমালাম৷ কেন জানি
না ওর সঙ্গে ঘুমাতে আমার একদম ভাল লাগে না৷
- তাহলে এখন যেতে
হবে না৷ ও থাকছে তো৷ মৌ কিন্তু আমার খুব উপকারে লাগল৷ এখন মনে হচ্ছে মৌ-ই আমার সেরা
বন্ধু৷ রাতে বাবু কাঁদলে ও উঠে পড়ে বাচ্চা সামলায়৷
- মৌ খারাপ মেয়ে
মোটেই নয়৷ সে পরিস্থিতির শিকার৷ ক'দিন মিশেই বুঝেছি৷ আর শরীরেরও তো কিছু চাহিদা থেকেই
যায়৷ সেটা না মেটালে মনে অস্থিরতা চপলতা চান্চল্য দেখা দেয়৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা মেয়ে
বা পুরুষের কারো পক্ষ সম্ভবপর হয় না৷
- ঠিকই বলেছ৷ জানো
আমার খুব দুর্বল লাগে তুমি বিফ কিনে দেবে তো৷
- মৌ জানলে অপপ্রচার
করবে৷
- ধুস সে তো নিজেই
খায়৷
- তাই বুঝি!
- হ্যাঁ বলছিল, বহুবার
নিজামে খেয়েছে৷ তাছাড়া ওর বান্ধবী সারিনা ও মিলিদের বাড়িতে কয়েকবার খেয়েছে৷
- ঠিক আছে আজকে তোমাকে
শিয়ালদহে ট্রেনে সি অফ করার আগে রাজাবাজার থেকে দু কিলো গোস্ত কিনে দেব৷
- তাই দিও৷
আজকে সাদা পোষাকে পুলিশ এসে ঘুষ নেওয়ার
অভিযোগে চারু মিত্র ও নরেন ঘোষকে হাতে নাতে ধরে ফেলে থানায় নিয়ে গেল৷ এই চারু লোকটা
খুব অসৎ৷ অত্যন্ত কমিউন্যাল৷ নরেনও তাই৷ এ রকম অনেকেই আছে৷ এই সব জঘন্য মানসিকতার লোকজনদের
সঙ্গে কাজ করতে আমার একদম ভাল লাগে না৷ তাই আমি মাঝে মধ্যে বড় আপাকে বলি কেরানির চাকরি
করতে ভাল লাগে না৷
এর মধ্যে পার্ট ওয়ান বাংলা অনার্সে
আমি কোয়ালিফায়িং নম্বর পেয়ে পার্ট ওয়ান পাশ করে পার্ট টু'র জন্য পারমিশন নিয়ে বঙ্গবাসি
কলেজের সান্ধ্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম৷ যথা সময়ে পার্ট টু পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ভার্সিটিতে
M.A. ভর্তি হলাম৷
দেখতে দেখতে তিন বছর চাকরি হওয়ায় কোয়াসি
পার্মানেন্ট হয়ে গিয়েছি৷ ভার্সিটিতে ক্লাস করতে ভাল লাগত৷ পড়াশোনা করতে করতে আব্বাজানের
ইন্তেকালের জন্য চাকরিতে জয়েন করেছিলাম৷ এখন মনে হয় সাদিকে চাকরিটা দিলেই ভাল হত৷
আমি অফিসে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছি৷
A.O.গুহ সাহেব আমাকে খুব ভালবাসেন৷ একদিন দৈনিক বসুমতীর প্রাণতোষ ঘটকআমাদের অফিসে তাঁর
সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন৷ তিনি তাঁর পিওন লছমনকে আমাকে ডেকে দিতে বললেন৷ আমি তাঁর
চেম্বারের দরজা খুলতেই তিনি বললেন, মিস্টার আমেদ ইনি প্রাণতোষ ঘটক মাসিক বসুমতীর সম্পাদক৷
আমি নমস্কার করায় উনি বললেন, তুমি
আমাদের কাগজের অফিসে গিয়ে একটা ছোট গল্প দিলীপের হাতে দিও৷
- ঠিক আছে লিখে দিয়ে
আসব৷ নমস্কার বলে আমি এসে সিটে বসলাম৷
এর মধ্যে একদিন কাগজ কলম নিয়ে বসলাম৷
কাগজে ঝর্ণা কলমে হিজিবিজি কাটাকুটি করতে করতে আমার নিজের মামাজান টুকুনকে আমার নানাজান
ও নানিজান অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা শিখিয়েছিলেন৷ তারপর দেশ বিভাগের সময় ঢাকা চলে যান৷
আমি আমার নানাজানের মনোকষ্ট দেখার অবকাশ পাই নি যেহেতু তিনি ইন্তেকাল করেন৷ তবে নানিজানের
দুর্ভোগ দেখেছি৷ সেই মামাজানের বিদেশ গমনে নানাজানের যন্ত্রণাকে ভিত্তি করে 'কবুতরের
বাচ্চা' নামে একটা তাৎক্ষণিক তাৎপর্যের উপরে একটা ছোটগল্প লিখলাম৷ তারপর কমসে কম পাঁচবার
সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে একদিন বসুমতী অফিসে গিয়ে সাপ্তাহিক বসুমতীর দফতরে
লেখাটা দিয়ে এলাম৷ সেদিন তখন প্রাণতোষ ঘটক অফিসে এসে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ তাঁর সঙ্গে
আমার দেখা হয় নি৷ গল্পটা ১০ অক্টোবর ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হবার আগে দৈনিক বষুমতীতে বিজ্ঞাপন
বেরিয়েছিল৷ বিজ্ঞাপনটা পড়ে মনে চান্চল্য জেগেছিল৷ সাপ্তাহিক বসুমতী প্রকাশের দিনক্ষণ
গুণতে গুণতে রাত ভোর হয়ে যেত৷ পত্রিকাটা হাতে পেয়ে প্রথমে বড় দোলাভাই ল্যাডলা মিয়াকে
দেখাতে উনি বললেন, হ্যাঁ এবার তুমি লেখক হলে৷
সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলাম৷ আমি দু
কপি সাপ্তাহিক বসুমতী কিনেছিলাম৷
তারপরে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজভাই সমবায়
সংস্থার মুখপত্র 'ভাণ্ডার' পত্রিকায় 'লালবাড়ির কাহিনী' নামে আমার একটি গল্প প্রকাশ
করে দেন৷ এই গল্পটা প্রাচীন কথা কাহিনীর আদলে লেখা৷ এর পর 'বন্দুকের গুলি' নামে একটা
তাৎক্ষণিক তাৎপর্যের উপরে লেখা সুন্দর গল্প 'আলো' নামে একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷
তার অনেক আগে আরও একটি গল্প সিউড়ির থেকে প্রকাশিত "শান্তিদূত' পত্রিকায় 'মৃত্যুর
প্রথম সিঁড়ি' নামে বেরিয়ে ছিল৷ ওই পত্রিকায় লেখা দিতে গিয়ে অসংখ্য গল্পের লেখক আব্দুল
মান্নাফ ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়৷
লেখালেখি আর ভার্সিটিতে পড়ার নেশা
আমার মগজে চেপে বসে৷ আমি আবেগের শিকার হতে থাকি৷ বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে গল্প মাঝে
মধ্যে লেখা প্রকাশিত হচ্ছিল৷ এর মধ্যে নায়কের 'পালাবদল' নামে একটা উপন্যাস লিখে ফেলি৷
তারপর 'ফিরে এসে' নামে আরেকটি উপন্যাস লিখতে শুরু করি৷ লেখক হওয়ার বাতিক পেয়ে বসে৷
বাস্তব বুদ্ধি লোপ পায়৷ আমি অস্থিরতায় ভুগতে থাকি৷ এর মধ্যে অফিসার পদে প্রমোশনের জন্য
ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা হয়৷ আমি পরীক্ষা দিই৷ সত্যি বলতে দোষ নেই, আমি কমার্সের কিছুই
জানি না আমি পরীক্ষার খাতা বাইরে বের করে দিই৷ নূরুজ্জামান তখন Chartered
Accountat স্টুডেন্ট ও আধ ঘন্টায় সব উত্তর দিয়ে দেয় আমি জমা করে দিই৷ পরীক্ষার ফলে
দেখা যায়,এই প্রদেশে আমি প্রথম হয়েছি৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশ মুক্তি সগ্রামের জন্য
ইন্দিরা গান্ধি ইন্টারন্যাল এমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করেন৷ ফলে সব appointment বাতিল
করা হয়েছে বলে establish department জানায়৷ তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হল৷ আমি আরও এক
বছর অনিচ্ছা সত্বেও চাকরি করলাম৷ তারপর আর অফিসে যাই নি৷ পদত্যাগ পত্রও দিই নি৷ একটা
অনিশ্চয়তার সাগরে ঝাঁপ দিলাম৷
স্বত্বাধিকারীঃ লেখক
চলবে (৯৪)