আজিমগঞ্জ চার বাঙলা মন্দির-আজিজুল হাকিম/ Char Bangla Terakota Temple

 


টেরাকোটার অসাধারণ নিদর্শন আজিমগঞ্জ বড়নগরের চার বাঙ্গলা মন্দিরাবলি

      আজিজুল হাকিম

পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন প্রকার ঐতিহাসিক নিদর্শন উজ্জ্বল মহিমায় জ্বলজ্বল করছে। তাদের মধ্যে আজিমগঞ্জ বড়নগরের চার বাংলা মন্দিরাবলি। আজিমগঞ্জ সিটি ষ্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে টটো বা অটোতে যাওয়ার পথ। গ্রামের নাম বড়নগর। খুব শান্ত ও নির্জন পরিবেশে চারদিক থেকে চারটি মন্দির চারটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলিও টেরাকোটার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন। এগুলিকে রাঢ় বাঙ্গলার মাটির বাড়ির আদলে দুচালা করা হয়েছে। মন্দিরগুলি দেখতে দারুণ সুন্দর।

চার বাঙ্গলা বলার কারণ এখানে চারটি মন্দির একই রকমভাবে তৈরি করা হয়েছে। মাঝখানে একটি আঙ্গিনা। তার চারিদিকে চারটি মন্দির। প্রতি দুটি মন্দিরের পাশে একটি করে প্রবেশ পথ। তার মানে চারটি প্রবেশ ও বহির্গমনের পথ আছে। এখানে প্রবেশের সময় যে মন্দিরটি সামনে পড়ে তাঁর মুখটি পশ্চিম দুয়ারি। এভাবেই পরস্পর পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিন দুয়ারি মন্দির। এর বাইরের দিকে ইষ্টকের কারুকাজ তেমন দেখা না গেলেও প্রতি মন্দিরের সামনের দিকের কাজ দারুণ সুন্দর। প্রত্যেক মন্দিরে তিনটি করে খিলান যুক্ত প্রবেশ পথ আছে। এই মন্দিরের ভিতরে তিনটি করে শিব লিঙ্গ আছে।     

কথিত আছে বর্তমান বাংলাদেশের নাটোরের রানী ভবানী ১৭০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই মন্দিরগুলি তৈরি করেছেন। এই মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট হল, এই মন্দিরের দেয়ালে এবং স্তম্ভে টেরাকোটার অসাধারণ নিদর্শন। টেরাকোটা বলতে কাদাকে বিভিন্ন ছাঁচে ফেলে বিভিন্ন আকৃতির নকশা, লতাপাতা-গাছ, বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি তৈরি করে সেগুলিকে রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। তারপর সেগুলিকে চুনসুরকির মসলা দিয়ে দেয়ালের গায়ে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়।

এখানে মৃৎশিল্পীদের স্থাপত্য শিল্পের এক চমৎকার কারুকাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই মন্দিরগুলির সামনের দিকে চালার নীচে বিভিন্ন লতাপাতার কারুকাজ মালার মতো করে সাজানো হয়েছে। তার নীচে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। তার নীচে আবারো ফুল ও লতাপাতার শিল্প। এই মন্দিরগুলিতে চারটি খিলান যুক্ত তিনটি প্রবেশ পথ আছে। এই দরজাগুলির উপরে রামায়ন, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে অনেক ঘটনার চিত্রাঙ্কন নজর কাড়ার মতো। বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় অঙ্কিত হয়েছে। প্রত্যেক দরজার উপরের চিত্রগুলো অবাক করার মতো। এছাড়াও বিভিন্ন জন্তদের ছবি চোখে পড়ে। স্তম্ভগুলির চারিদিকে প্রচলিত রীতিনীতি, তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট, নারী-পুরুষের রমণ ক্রিয়া চিত্রিত হয়েছে। তার সঙ্গে ফুটে উঠেছে তৎকালীন গ্রাম্যজীবনের নারীপুরুষের চিত্র। সেই সময় পালকীর ব্যবহার যে ছিল তারও সুন্দর প্রতিফলন এই ছবিগুলির মাধ্যমে প্রস্ফুতিত হয়। এখানে তৎকালীন যুদ্ধ গমনেরও প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া ঘোড়ায় টানা গাড়ি, হাতির পিঠে ভ্রমণ, উপঢৌকন বহন, বাংলার নারীদের মাথায় জলের কলশি এজাতীয় অনেক কিছু চোখে পড়ার মতো। মানুষের জীবনের বিভিন্ন অবস্থা, রামায়ণ মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে কিছু ছবি অসামান্যভাবে অঙ্কিত হয়েছে। এই মন্দিরগুলির এক একটার দেয়ালে আলাদা আলাদা মৃৎশিল্পের নিখুঁত কারুকাজ প্রশংসার যোগ্য। এগুলি সবই পোড়া মাটির তৈরি। ঝাড়খণ্ডের মুলটি গ্রামের যে টেরাকোটার মন্দির দেখা যায় তার চায়তে এই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ অনেক সুন্দর ও জীবন্ত দেখায়।

এই মন্দিরগুলির প্রত্যেকটি ঘরে তিনটি করে শিব লিঙ্গ আছে।

এখানে আসার পথ হল জিয়াগঞ্জ ষ্টেশন থেকে নেমে সদর ঘাট পার হয়ে অটো বা টোটো ধরে উত্তরে এক কিলো মিটারের পথ। এছাড়া হাওড়া থেকে আজিমগঞ্জ, মালদা থেকে আজিমগঞ্জ, নলহাটি থেকে আজিমগঞ্জ সিটি বা আজিমগঞ্জ জংশনে নেমে অটো বা টোটো ওয়ালাদেরকে বললেই তারা পৌঁছে দেয়।

ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের মনোরম শান্ত পরিবেশে স্থাপিত এই মন্দিরগুলি ইতিহাসের নানান সাক্ষী বহন করে আসছে।   

Post a Comment

Previous Post Next Post