কাটরা মসজিদের একাল ও সেকাল
আজিজুল হাকিম
যার নাম অনুসারে বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী ১৭০০ দশকে মুর্শিদাবাদ হয়েছিল; সেই নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁন-এর সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব হল কাটরা মসজিদ। এটিকে আবার মুর্শিদাবাদের জামে মসজিদও বলা হয়। ‘কাটরা’ শব্দের অর্থ হল বাজার। এটি যেহেতু বাজার কেন্দ্রিক মসজিদ সেই কারণে এর নাম কাটরা মসজিদ হয়েছে। এই মসজিদের চারিপাশে একটি বড় ধরনের বাজারের পত্তন ঘটে ছিল আর এই বাজার থেকে যে আয় আসবে সেই অর্থ থেকে এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করা হবে – এমন ইতিহাস পাওয়া যায়। যা আজ কালের গর্ভে অতীত হয়ে গেছে।
(মসজিদের ভিতর)
এই মসজিদটি অবশ্যই এক অসামান্য ও খুব সুন্দর কাফেলা কেন্দ্রিক মসজিদ। অখণ্ড ভারতের যতগুলো কাফেলা সংবলিত মসজিদ আছে তাদের মধ্যে এটি একটি মুর্শিদাবাদের গৌরবান্বিত নিদর্শন। ইতিহাস থেকে জানা যায় এটি কেবলমাত্র মসজিদ নয়, এটি তৎকালীন সময়ের একটি বিশাল ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র। এই মসজিদে এক সঙ্গে ৭০০ জন কারী বা কোরান পাঠকারী কোরান পাঠ করত। তাছাড়া পথিকদের থাকার আশ্রয়ও ছিল। এখানে এক সঙ্গে ২০০০ জন মুসল্লি (নামাজী) নামাজ আদায় করত। এখানে বড় ইন্দারা ও বড় চৌবাচ্চা ছিল যা নামাজী ও পথিকদের আযু ও স্নান করার জন্য ব্যবহৃত হত। মুর্শিদ কুলী খাঁন তাঁর অবসর সময় এখানে কাটাতেন বলেও জানা যায়। যার জন্যে তোরণদ্বারের পাশে মহাফেজ খানাও দেখা যায়। নবান মুর্শিদ কুলী খাঁনের আদেশে এই মসজিদ চত্বরের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছানোর সিঁড়ির তলায় একটি ঘর নির্মাণ করা হয় এবং উনার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সে ঘরে তাঁর মৃত দেহ সমাহিত করা হয়েছে। উনার বিশ্বাস ছিল, ইহ জগতে উনি যা পাপ করেছেন পুণ্যবান নামাজীদের পায়ের ধুলো-বৃষ্টিতে উনার সমস্ত পাপ ধুয়ে যাবে এবং তিনি জান্নাতবাসী হবেন। কিন্তু আজকের মসজিদ, তাঁর পরিবেশ দেখলে তাঁর শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ বর্তমানে এখানে নামাজ পড়া হয় না। এমন কি কোন ভ্রমণকারীকে জুতো খুলে প্রবেশ করতে বলারও কোন লোক এখানে নেই।
এই কাটরা মসজিদটি তৎকালীন সময়ে শহরের মূল কেন্দ্রে স্থাপিত হয়েছিল। এর ভিত্তি স্থাপন থেকে সমস্ত বিল্ডিং তৈরি করতে ১৭২৩ ও ১৭২৪ এই দুই বছর সময় লাগে। এই মসজিদে কোথাও কড়ি বর্গা নেই। মসজিদের সম্পূর্ণ অংশটাই খিলানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। এই মসজিদ চত্বরে প্রবেশের পথ মূলত তিনটি। রাজ্য সড়ক থেকে নেমে এর বাউন্ডারির ভিতরে প্রবেশ করে উত্তর ও দক্ষিন এই দুই দিকের মধ্যে যে কোন এক দিক দিয়ে মসজিদের বাউন্ডারি ঘুরে পূর্ব দিকে গেলে মসজিদ চত্বরে প্রবেশের মূল ফটক। সেই ফটকে যেতে গেলে ষোলটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে প্রবেশ করতে হয়। আর এই সিঁড়িগুলির তলার একটি ঘরে মুর্শিদ কুলী খাঁনের কবর অবস্থিত। এছাড়াও পশ্চিম দিক থেকে গিয়েও উত্তর বা দক্ষিন কোণ দিয়ে মসজিদে প্রবেশের রাস্তা আছে। মূল মসজিদের চারিপাশে চতুর্ভুজাকৃতি দুতলা সংবলিত পান্থনিবাস। প্রত্যেক দিকে লম্বায় ১৪০ফুট এবং প্রস্থে ২৫ ফুট বিস্তৃতি। এদের মধ্যের ফাঁকা জায়গাগুলো হল ১৩ ফুট। এই পান্থনিবাসের পশ্চিম দিকে অক্ষত ঘরগুলিতে ছোট ছোট গম্বুজ আছে। উত্তর, দক্ষিন এবং পূর্ব দিকে ষোলটি করে গম্বুজ আছে। এই পান্থশালার ভিতরে মূল মসজিদের আঙ্গিনা এবং মূল মেঝে উচ্চতায় এক তলার উপরে অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিনের যে পান্থশালা আছে সেগুলি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যেতে যেখানে মূল মসজিদের শেষ হচ্ছে সেখান থেকে পূর্ব দিকের কয়েকটি করে গম্বুজ ও দোতলার পিছুনের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। তবে মসজিদ থেকে সরাসরি পূর্ব দিকের গম্বুজগুলি অক্ষত আছে। এই গম্বুজগুলির সংখ্যা হল ১০টি এর চার কোনায় চারটি বড়বড় মিনার থাকলেও বর্তমানে পূর্বের দুটি মিনার এখন আর নেই। সেই মিনার গুলির উচ্চতা ৭০ ফুট আর বিস্তৃতি ২৫ ফুট। এই মিনারগুলির উপরে গম্বুজ ছিল। এখন নেই। ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়েছে। এর ভিতরে সর্পিল আকারের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হতো। এই মিনারগুলির ভিতরে আলো বাতাস ঢোকার জন্য ছোট ছোট জানালা আছে। এখন অবশ্য সেই সিঁড়ির উপরে উঠতে দেওয়া হয় না। এর ভিতরের ব্যাস ২৫ ফুট হলেও উপরের ব্যাস অনেক কম। মূল মসজিদ ঘরের উপরে পাঁচটি বড় বড় গম্বুজ ছিল কিন্তু বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিন দিকে একটি করে দুটি গম্বুজ এখনও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে আর মধ্যের তিনটি গম্বুজ ১৮৯৭ সালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়েছে। পিছুনের দুটি মিনারও ওই বছরই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে পড়ে।
(কাটরা মসজিদের বাইরের দিক)
কাটরা মসজিদে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের নামাজ নিষিদ্ধ করার জন্য
তৎকালীন মৃত প্রায় মুসলিমলীগ পার্টির তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, ‘সরকারকে নামাজ বন্ধের
অঙ্গীকার তুলে নিতে হবে; তা না হলে (১৯৮৮ সালের) আগামী ২৪শে জুন শুক্রবার তারা মসজিদে
নামাজ পড়বে’। এমন ঘোষণা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে; এমন কি পার্শ্ববর্তী
অন্যান্য জেলা থেকেও সাধারণ মুসল্লিরা সেখানে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে নিরস্ত্রভাবে জমায়েত
হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে এই সব লোকজনকে বিভ্রান্ত করে বিভিন্নভাবে
বিভিন্ন দিকে চালিত করে। ফলে অধিকাংশ মানুষই মসজিদ চত্বরে পৌঁছাতে পারেনি। মুষ্টিমেয়
যে কয়েকজন সেখানে পৌঁছে ছিল তারা নামাজ পড়তে গেলে পুলিশ তাদেরকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। এই
বিভ্রান্তপূর্ণ মানুষের দল বিভিন্ন পথে বাড়ি ফিরতে গেলে রিফিউজি অধ্যুষিত এলাকায় রাস্তায়
ধরে তাদের হত্যা করে।
(মুর্শিদ কুলি খানের কবর)
সব চেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছিল নশিপুর স্টেশনে। এটি মুর্শিদাবাদ
ও জিয়াগঞ্জ ষ্টেশনের মধ্যবর্তী স্টেশন। এর চারিপাশে রিফিউজির বাস। ১৯৮৮ সালের ২৪শে
জুন শুক্রবার সন্ধ্যা রাতে মুর্শিদাবাদ স্টেশন থেকে ট্রেনটি লালগোলা যাচ্ছিল। নশিপুর
স্টেশনে ট্রেনকে থামিয়ে প্রচুর লোককে হত্যা করে। বিভিন্ন যানবাহনে সেই সব লাশ বয়ে নিয়ে গিয়ে কাটি
গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সরকারী তরফে জানানো হয়, দাঙ্গায় ২৯জন মারা গেছে। কিন্তু সেদিন
শতাধিক মুসলিম মারা যায়। আর ওটা দাঙ্গা ছিল না। ওটা ছিল রিফিউজিদের সুপরিকল্পিত গনহত্যা।
তখন থেকে এই মসজিদে নামাজ পড়া চিরতরের মতো বন্ধ হয়ে যায়।
এখনও এই মসজিদ কেবল একটি টুরিস্ট স্পট হিসাবেই চিহ্নিত। এর
স্থাপত্ত শিল্প ও কারুকার্য আজও ভ্রমন পিপাসুদের মন জয় করে যাচ্ছে।