ম্যাসাঞ্জোর ভ্রমন-আজিজুল হাকিম

 


ম্যাসাঞ্জোর ড্যামের উপর গিয়ে প্রথমেই অবাক হলাম যখন তোপিডাঙ্গার একটি ছেলেকে সেখানে দেখলাম আর সে আমার সঙ্গে কথা বলল। তারপর আসু আর সহিদুলের সঙ্গে দেখা হল। ওদের সঙ্গে সেলিম আর মীরের পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ওরা দুটি টাটাসুমো ভাড়া করে বেশ কয়েকজন এসেছে। ওরা ইতিমধ্যে ত্রিকূট পাহাড়ও দেখে এসে এখানে নেমেছে। তারপর ওরা ওদের মতো ঘুরতে লাগল আর আমরা আমাদের মতো।

       ম্যাসাঞ্জোর ড্যামটি কিছুটা উত্তর পূর্ব কোণ থেকে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে বিস্তৃত। এর উচ্চতা ১৫৫ ফুট। এর উপর থেকে পূর্ব দিকে অর্থাৎ নদীর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কারণ ড্যাম থেকে নদীকে খুব গভীর দেখাচ্ছে। এদিকে নদীতে কম জল প্রবাহিত হচ্ছে। আবার সারা নদী জুড়ে পড়ে আছে অজস্র নুড়িপাথর। এটি যেহেতু কানাডা সরকারের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত সেই কারণে একে কানাডা ড্যামও বলা হয়ে থাকে।এর দৈর্ঘ ২১০০ ফুট। এর পশ্চিমে একটি বিশাল বিস্তৃত এলাকা নিয়ে অগাধ শান্ত জল থৈথৈ করছে। ড্যামের দু পাড়ে দুটি সুউচ্চ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। লেকটিকে ড্যামের সঙ্গে ধরলে বলা যেতে পারে এর তিন দিকে ভীষণ সুন্দর পাহাড়। লেক ও ড্যামকে ঘিরে আছে। নৈসর্গিক পাহাড়গুলিকে সবুজ সতেজ গাছপালায় ঢেকে আছে। লেকের ওপারের পাহাড়গুলিকে কুয়াশাছন্ন মেঘের মতো দেখায়।

       এখানে লেক গোলাকার দেখালেও উত্তর-পশ্চিম দিকে বহুদূর চলে গিয়েছে। এটি পাঁচ লক্ষ ষাট হাজার একর জমি জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে জলের রঙের ও কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এদিকে ময়ূরাক্ষী নদীর বুকে যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় দুপাড়ের পাহাড়কে ভেদ করে চলে গেছে অসীমের পানে। তবে নদীর প্রস্থ এখানে বেশি নয়। তার বুকে পড়ে আছে ছোট বড় নানান আকারের পাথর। এই নদী বক্ষে, পাথরের উপরে ছেলে-মেয়ারা নানা পোঁজে ছবি তোলায় ব্যস্ত। নদীর বুকে অগভীর জল নুড়িপাথরগুলির উপর হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অনন্তের পানে।  

       আমরা যখন ড্যামের কাছে গিয়ে পৌঁছালাম তখন বিকেল বেলা। এদিকে আকাশ ঘন মেঘের পসরা সাজিয়ে আত্মগোপন করেছে। ফলে সূর্যাস্তের মনোরম শোভা আমরা উপভোগ করতে পারলাম না। মেঘগুলো এত ঘন হয়েছে যে মনে হচ্ছে পাহাড়ের মাথায় বিশাল অধিবেশনে বসেছে। পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে না। একটি পাহাড়ের মাথায় সুন্দর বৃষ্টি পতনের দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল।


    (ম্যাসাঞ্জোরের নৈসর্গিক দৃশ্য) 

       কিছুক্ষণ ড্যামের মাঝে ঘুরে ফিরে আমরা ওপারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক টিয়া পাখি উড়ে গেল। এটাকে টিয়া পাখির স্বর্গরাজ্যও বলা যেতে পারে। ড্যামের নীচে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার আশেপাশের গাছগুলিতে টিয়া পাখি প্রচুর পরিমানে দেখা যায়। এখানে চার মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তার পুরটায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে। এমনকি এই বাঁধের মালিকানাও নাকি আমাদের।  

       আমরা ব্রিজ পেরিয়ে বাম দিকে কেটা গেলাম। রাস্তার ডান পাশে সুউচ্চ পাহাড় আর বাম দিকে গভীর নদী। কিছুটা গিয়ে আবার বাম দিকে পায়ে হাঁটা রাস্তায় নেমে পড়লাম। দুদিকে ঘন জঙ্গল। ডান দিকের জঙ্গলের মাঝে দেখলাম একটি স্মৃতিস্তম্ভ। পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে। সামনে একটি প্রাচীর বিহীন খোলা দরজা। সেটিও পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেই সৌধের কোন দিকে কারো নাম দেখতে পেলাম না। ভাবলাম হয়তো কোন সাঁওতাল নেতার স্মৃতি রক্ষার্থে এই সমাধির পত্তন ঘটেছে।


    (স্মৃতি স্তম্ভ) 

       সেখান থেকে কিছুটা নেমে গিয়ে আমরা নদীর বুকে নামতে শুরু করলাম। পাথরের পর পাথর পেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে আমরা নদীর বুকে নেমে গেলাম। ছোট বড় পাথরের উপরে হেঁটে, লাফিয়ে বেড়াতে বেশ ভাল লাগল। সেখানে একটি বড় পাথরের উপরে গিয়ে বসলাম। চারিপাশ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী। ভীষণ আনন্দে সেখানে পুরো সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম।

       উপরে ফিরে এসে রাত্রি বাসের জন্য আমি আর সেলিম ঝাড়খণ্ড সরকারের আবাস ভবনে গেলাম। কিন্ত লকডাউনের কারণে বন্ধ। সেখানে কোন লাইটও দেখতে পেলাম না। তারপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরটা খোঁজ করতে একজন বললেন, “সেটা আপনারা পাবেন না। সেখানে থাকতে হলে শিউড়ি বা কোলকাতা থেকে বুক করে আসতে হত”। অবশেষে মহামায়া হোটেলে গিয়ে উঠলাম। থাকার রুম ভাল হলেও হোটেলের পরিবেশ ভাল ছিল না।

       পরের দিন সকালে উঠে চারিপাশ বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম; কিন্তু বৃষ্টির কারণে সেটি হল না। কেবল মাত্র ড্যাম থেকে প্রবাহিত জলের ভয়ঙ্কর উচ্ছ্বাস উপভোগ করলাম। তারপর ড্যামের সম্মুখে গিয়ে জনার্ধন ঘোষ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হল। উনার নিকট হতে আমরা হোটেলের মালিক পরদেশী শাহ্‌ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ম্যাসাঞ্জোরে কেবল মাত্র উনার রাজ চলছে। ড্যামের দুপাশে যতগুলি স্টল, হোটেল এবং দোকান চলছে সকলের কাছ থেকে উনি প্রতিদিন একটা বিরাট কমিশন পান। উনার বাবা একজন বাঙালি মানুষ। অনেক দিন আগে বিহার থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। তখন এরকম টুরিস্টদের আনাগোনা ছিল না। তারপর তিনি আশপাশের সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করেন। সেই সূত্রেই তার ছেলে পরদেশী বাবু প্রচুর টাকা আয় করে আসছেন। উনার কলকাতাতেও বিশাল বাড়ি আছে বলে জানা যায়।                            

1 Comments

Previous Post Next Post