Kobitar Atmokatha/কবিতার আত্মকথা

 


কবিতার আত্মকথা
 আজিজুল হাকিম


কবিবর,
আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ
আমাকে নিয়ে আর টানা হ্যাচড়া করবেন না।

বলুন তো, সেই কোন কাল থেকে!
সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই আমাকে লিখতে শুরু।
যখন পিরামিডের কল্পনামাত্র ছিলনা,
যখন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটেনি,
অলিম্পিয়াসের বুকে হয়নি শুরু খেলা,
মহেঞ্জোদারো ছিল স্বপ্নাতীত,
নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা আসেনি,
অন্ধকারের জঠরে লুকিয়ে ছিল আমেরিকা,
আদিম সরল নগ্নতায় মজে ছিল আফ্রিকা;
ঠিক তখন কোন এক ষোড়শীর উথলে উঠা বুকে
আপনার চোখ আটকে পড়েছিল,
অথাবা বনানীর গহীনে কোন এক গাছের আড়ালে
কোন এক তন্বী নয়না উঁকি মেরে হারিয়ে গেছিল,
হয়তো বা কোন এক অদৃশ্য নারীর হাসির ঝংকারে
আমাকে পেয়েছিলেন,
নতুবা অখ্যাত কোন এক নদীর টলমলে জলে
পূর্ণিমার চাঁদের নিঃশব্দ উল্লাস
হৃদয়ের গভীরে গেঁথেছি।
না হয় কোন এক মরুদ্যানে আয়নার মত সচ্ছ জলাশয়ে
কোন এক কিশোরীর অনাবৃত দেহ দেখে
আমাকে সাজিয়ে ছিলেন
আপনার মন ও কণ্ঠের সুরে,
কিংবা সিক্ত বসনা নারী দেহের অব্যক্ত উল্লাসে
বিভোর হয়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন,
অথবা বাংলার আদিগন্ত সবুজ মাঠে
এলোমেলো বাতাসে কোন নারীর
উড়ে যাওয়া চুল আর আঁচল বেসামাল দেখে
আপনার হৃদয় মন্দিরে এসেছিলাম,
অথবা কোন এক যুবকের দেহের সুঘ্রাণ
কোন এক নারীর হৃদয় সাগরে তোলপাড় করে
হারিয়ে গেছিল চিরন্তন।
তারই এক শোকগাথায় হয়তো আমার জন্ম।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বা সৃষ্টির উল্লাসে
ঈশ্বরের অনুগ্রহে সুগভীর ভক্তি আর শ্রদ্ধায়
সাধারণ মানুষের সুর তুলেছিল ঝংকার,
হয়তো বা অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে
প্রজা সকলকে সমবেত করতে
অস্ত্র হিসাবে আমি রচিত হয়ে ছিলাম।
হাজারো যুদ্ধের জয় পরাজয়
আমার হাত ধরেই ঘটেছে।
সহস্র বিপ্লবীরা পেয়েছে প্রেরণা -
আমার কথায় হাসতে হাসতে দিয়েছে প্রাণ।
আমার ছন্দ আর কথার তুড়িতে
কত নগরীর উত্থান পতন।
আমার বাণী বুকে গেঁথে কত প্রেমিক প্রেমিকা
পরস্পরের হাত ধরে, পরিচিত পথ ফেলে
অচেনা পথে দিয়েছে পাড়ি।
তাই অগণিত হাসি কান্নার সাক্ষী আমি।

কখনও বা পাহাড়ের গুহায়,
কখনও বা পাথরের গায়ে,
কখনও বা মুখেমুখে ফিরেছি সৃষ্টি আমি।

হতাসার আগুনে জ্বলে মরতে চেয়েও
অসহায় মানুষ ফিরে এসেছে আমার কথায়।
অনেক দুঃখী মানুষ পেয়েছে বাঁচার ইন্ধন।
আমার ছন্দে ভুলে গেছে তার অব্যক্ত যন্ত্রণা।
আমাকে বুকে নিয়েই সভ্যতার চাকা ঘুরেছে অবিরত।
আমার মন্ত্রের বলে হাজার তন্ত্রের আসা যাওয়া।

তবে সকল ক্ষেত্রেই সফলতার সীমা ছুঁতে পারিনি
কখনও ব্যর্থতা এসেছিল হয়তো;
কিন্তু আমার প্রকাশেই সফলতার চূড়া ছুঁয়েছিল সর্বত্র।

প্রিয় কবি, আমি লজ্জিত হই!
আপনার কলমের ডগায় ময়লা জমেছে -
প্রতিবাদ আর বিপ্লবের লাভা নির্গত হয় না।
আজকের যুবক যুবতীরা আমাকে দেখে নাক সিটকায়,
এছাড়া কলমও আমাকে দুর্বোধ্য করে তুলেছে।
যান্ত্রিকতার ছাপ সমাজের প্রতি স্তরে।
পিঁপড়ের সারির মতো সকলে অর্থ আর ক্ষমতার পিছনে পড়ে।

প্রিয় কবি,
আপনার কবিতা যদি দুর্ভেদ্য মনে হয়,
যদি রেখাপাত করতে না পারে সমাজের বুকে,
যদি ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকা না পায় বাঁচার আশ্বাস,
যদি বঞ্চিত, দুর্বল, অসহায় না পায় বাঁচার প্রেরণা,
যদি স্বৈরাচারী শাসকের বুকে
আঘাত করতে না পারে কোন কুঠার,
যদি দানবের বিরুদ্ধে কলম না চলে,
যদি ধার্মিক পাণ্ডাদের ভয়ে কলম থমকে দাঁড়ায়,
যদি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে না পারে,
যদি অশান্ত দেশে শান্তির পায়রা উড়াতে না পারে,
তবে কেন, কেন আমাকে নিয়ে এত টানা হ্যাচড়া?
কেন আমাকে নিয়ে এত মাতামাতি?

আর যদি না পারেন,
আমাকে লেখালেখি বন্ধ করুন।
এমন নপুংসক, ভীতু, কাপুরুষ কবি আমি চাইনা।

রচনাঃ ২০/১১/২০১৮

Post a Comment

Previous Post Next Post