পাহাড় যখন ডাকে
(একটি ভ্রমণ কাহিনী)
আজিজুল হাকিম
(এক)
বরাবরই পাহাড় আমাকে ডাকে। পাহাড় আমাকে হাতছানি
দেয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে দূরে-পারে বেড়াতে যাওয়া হয়না। তবে সেলিম কয়েক মাস থেকেই
আমাকে ঝাড়খণ্ড বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে আসছিল । তার সঙ্গে মীর সাহেবেও অনেকটা রাজি ছিল।
কেবল আমার ইচ্ছে থাকলেও বিভিন্ন কারণে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
অবশেষে সেলিমের পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে গেলাম।
কথা হল, সেপ্টেমবরের প্রথম সপ্তাহে আমরা তিন বন্ধুতে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু মীরের স্কুলের
কাজ থাকায় কয়েক দিন পিছিয়ে দিয়ে ১২ই সেপ্টেম্বর ভোর বেলায় যাওয়ার সময় স্থির করা হল।
বেরিয়ে পড়ার দিনক্ষণ হলেও হঠাৎ মীরের আবার
একটা উপসর্গ দেখা দিল বলে আমাকে ফোন লাগাল। সেটি হল ওর দাঁতের ব্যাথা। ডাক্তার নাকি
বলেছে, ওর দাঁত না তুললে সে ব্যাথা যাবে না। এদিকে ব্যাথা না কমলেও দাঁত তুলা যাবে
না। ব্যাথা বেড়ে গেছে। রাস্তায় বেড়িয়ে আরো বাড়লে বা এমন অবস্থায় থাকলেও বেড়ানোর আনন্দ
মাঠেই মারা যাবে। কিন্তু সেলিম নাছোড় বান্দা। যখন ডেট হয়েছে তখন ও যাবেই। কেউ না গেলেও
সে একাই যাবে। আগের দিন সন্ধ্যায় সেলিম আমাকে ফোন লাগাল। আমার মতের কোন নড়চড় হয়েছে
কি না। আমি মীরের ব্যাপারটা ওকে বললাম। ও বলল, “মীরকে নিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
ওকে নিয়ে যাব। প্রয়োজনে ওকে সেখানেই হসপিটালে ভর্তি রেখে আমারা ঘুরবো। এতে তোমার মতামত
কি?” আমি বললাম, “তাই হবে”।
কথা মতো পরের দিন অর্থাৎ ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২১
ভোর পাঁচটায় সেলিম ওর গাড়ি নিয়ে আমার বাড়ির সামনে হাজির। দেখলাম, মীরও এসেছে। আমি আমার
লাগেজ আর হালকা কিছু খাবার গাড়িতে তুললাম। ওই অবস্থাতেই মীরকে জিজ্ঞেস করলাম যে সে
এখন কেমন আছে। মীর বলল, “আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ আছি। তবে যাওয়ার প্রস্তুতি না থাকায়
কোন কিছুই তেমন গুছিয়ে নেওয়া হয়নি। এমনকি মুখটা সেভও করা হয়নি”। আমি মীরের মুখের দিকে
তাকালাম, হালকা চাপা দাড়িতে মুখটা ভর্তি হয়ে আছে । কম করে এক সপ্তাহ সেভ করেনি বলেই
মনে হচ্ছে। সেলিম বলল, তাতে কি হয়েছে? রাস্তার ধারে বড়বড় বিউটি পার্লার পাওয়া যাবে,
সেখানেই তোমাকে ঢুকিয়ে দেব”। সেলিমের কথা শুনে
আমরা বেশ হাসলাম।
ভোর ৫টা ১০ মিনিটে সেলিমের চার চাকায় আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। রাস্তার অবস্থা খারাপের জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার ঘুরে আমরা ছকন্নগর, কুচগিরিয়া হয়ে আমইপাড়া যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু ছক্কন্নগর গিয়ে যেন গাড়ির গতি থমকে গেল। ভোর বেলায় পাড়ার সকল মানুষজন রাস্তায় এসে উপছে পড়েছে। দাঁতান, ব্রাশ করা থেকে রাস্তার উপরে বসে খোশগল্প সবই এখানে রাস্তার উপরে চলে। এছাড়াও পাড়ার সমস্ত ছাগল-মুরগিগুলো পর্যন্ত রাস্তার উপরে বিন্দাস ঘুরে বেরাচ্ছে। গাড়ির হর্ণেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। লোকজন সরতেই চায়ছে না। সেলিম বিরক্ত হয়ে বলল, এরা কবে মানুষ হবে বল? বল, এরা আর কবে সভ্য হবে? যেখানে চল্লিশ বছর থেকে শুনে আসলছিলাম এবার রাস্তা হবে, এবার আর ধুলো-কাদায় স্কুল, কলেজ যেতে হবে না; এমন অবস্থায় তিরিশটি বছর কাটিয়ে দিয়ে যখন রাস্তা পেলাম; তখন ছাত্রজীবন পার করে চলে এসেছি। আর আজ রাস্তা পাওয়ার পরও রাস্তার উপরে গরু বাঁধা, ছাগল বাঁধা আর কোলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষটিও এই রাস্তাটাকে তাদের আড্ডাখানা বানিয়ে ফেলেছে। খেলাধুলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছে। তাহলে এই সব এলাকার লোকের মানসিকতা কত উন্নত সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। তোর বাড়ির সামনের রাস্তায় কি সরকার এসে বাস করবে? বাস করবি তো তুই। তাহলে তোর বাড়ির সামনে গরু ছাগল বেঁধে রাস্তাটাকে নষ্ট করছিস কেন বাবা, এ তো তোরই সম্পত্তি। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তোর। সেলিম বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে গেল। ওর কথায় আমরা সাঁই দিলাম মাত্র।
যাহোক, যেখানে দশমিনিটে আমইপাড়া পৌঁছানোর
কথা, সেখানে প্রায় চল্লিশ মিনিটের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। তারপর ষ্টেট হাইওয়ে হয়ে বহরমপুর।
মাঝেমাঝে ষ্টেট হাইওয়ের অবস্থাও খুব একটা ভাল নেই। কোথাও কোথাও পাথর উঠে বড়বড় গর্ত
হয়ে গেছে। অতি সকালের কারণে বীভৎস জ্যাম ছাড়াই আমরা রাধার ব্রিজ পার হয়ে জাতীয় সড়কের
চরাই উতরাই পার হতে হতে চললাম।
যখন আমরা পলসণ্ডায় পৌঁছিলাম তখন সেলিম আবার
জাতীয় সড়ক থেক রাজ্য সড়কে তার গাড়িটি হাঁকিয়ে নিয়ে চলল।
কিছুটা গিয়েই সেলিম বলল, আজিজুল তোমার সেই প্রিয় বন। তারপরই সে গাড়িটা কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে দিল। গাড়ি থেকেই কয়েক পলক আমার সেই প্রিয় বনের চারিদিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই ছোট্ট বনটি পলসণ্ডা আর নবগ্রামের মধ্যবর্তী মাঠে অবস্থিত। একে প্রিয় বলার অর্থ এই জায়গাটা আমাকে ভীষণ ভাল লাগে। এর আগেও কয়েকবার এখানে এসেছি। আমরা আড্ডা মেরেছি। এমনকি সেলিমের সঙ্গে গ্রীষ্মকালে এখানে এসে আমার ‘মিলনের আনন্দ’ কবিতাটি লিখেছিলাম। সেই কবিতাটি এখানে দিলাম
(পলসণ্ডা ও নবগ্রামের মধ্যবর্তী বন)
মিলনের আনন্দ
------------------------
একটা মন আর একটা
বন
দুজনেই চাইছিল দুজনকে।
ভবঘুরে মন ঘুরে বেড়ায়
পথে পথে ।
হঠাৎ একদিন একের
সাথে অন্যের দেখা
মন বনকে পেয়ে আনন্দে
আছড়ে পড়ল
যদিও মন তখন ভীষণ
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত;
বন তখন ছিল ভীষণ
শান্ত।
যেই মাত্র সে মনকে
পেল
চারিদিক হতে শুরু
হল ঝিরঝিরে হওয়ার পালা
অনাবিল আনন্দে দুলতে
লাগল ডালপালা
শাখায় শাখায় ফুটতে
শুরু করল
বিচিত্র রঙের ফুল।
সুবাসিত হল সারা
বন
উজ্জীবিত হল মন
কোথা থেকে এল এক
ঝাঁক পাখি
শুরু করল তাদের বাসন্তিক
গান।
এখানে চারিদিকেই শালবন । শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণধারার
আদর-সোহাগে গাছ ও পাতাগুলি ধুলোর আস্তরণকে ধুয়ে ফেলে সবুজের উজ্জ্বল হাসিতে যেন আত্মমগ্ন
হয়ে আছে। গ্রীষ্মের খর-প্রখরে দেখা ছোট ছোট পত্রবিহীন গাছগুলো বর্ষার স্নেহধারায় ধন্য
হয়ে কচিপাতার উল্লাসে স্নিগ্ধ বাতাসের পরশে নেচেনেচে উঠছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সেলিম আবার গাড়ি স্টার্ট করল। তারপর ঝাঁ চকচকে রাস্তায় গাড়ি ছুটতে শুরু করল। আমরা নবগ্রাম ছেরে, রাস্তার দুপারে সুবিস্তৃত বসুয়ার বিলের ধারে এলাম।
(বসুয়ার বিলের উপরূপ শোভা)
এর আগে একদিন আমিও সেলিম সন্ধ্যার আগে এখানে এসেছিলাম। একটি জেলেকে নৌকা থেকে মাছ ধরতে দেখে সেলিম ওকে অনুরোধ করে দুশো টাকা দিলে ওর নৌকাতে আমদেরকে নিয়ে বেড়িয়েছিল। সূর্য ডোবার পর আকশের হালকা সোনালি আভা এবং বিলের শান্ত জলে তার প্রতিফলন আমাদেরকে ভীষণভাবে বিমোহিত করেছিল। তখন এই বিলের চারিদিকে কেবল জল আর জল থৈথৈ করছিল।
সেলিম বিলের ধারে গিয়ে ওর গাড়ি স্লো করেছিল।
বিলটি পার হলেই আবার আগের গতিতে গাড়ি ছুটতে শুরু করল। তারপর আমরা পঞ্চগ্রাম মোড়ে গিয়ে
পৌঁছালাম। সেখান থেকে ডান দিকে কেটে ছায়াঘন রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল উত্তর দিকে।
কিছুক্ষণ রাস্তার দুপারের মাঠকে পিছনে ফেলা আমরা নিধিয়া নামক ছোট্ট একটা মোড়ে গিয়ে
থামলাম। সেখানে নেমে একটি চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট খেলাম। একজন আধাবাঙ্গালি ধরণের বয়স্ক
লোকের সঙ্গে হিন্দি-ইংরাজি-বাঙ্গলা মেশানো ভাষায় কথা বলতে শুনলাম। তার সঙ্গে কথা বলতে
গিয়ে জানলাম, তিনি এক সময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন। এখন বয়স হওয়ায় তিনি অবসরে
আছেন। উনার ফিগার দেখলেই বোঝা যায় যৌবনে উনার খুব সুন্দর চেহারা ছিল।
যাহোক, সেখান থেকে আমরা আবার আমাদের যাত্রা
শুরু করলাম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নাকপুর মোড়ে মোড়গ্রাম পানাগড় স্টেট ওয়েতে পৌঁছে
গেলাম। সেখান থেকে বামে ঘুরে সোজা পশ্চিম দিকে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল। কিন্তু গাড়ির
গতি কোনভাবেই বাড়ানো গেল না। রাস্তার হাল একদম বেহাল অবস্থা। ছোট গাড়ি চলার মতো রাস্তার
অবস্থা নেই। রাস্তার পিচ তো দূরের কথা রাস্তা থেকে পাথর উঠে চলে গেছে। রাস্তার মাঝে
মাঝে পাথর উঠে বড় বড় খাদ গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যারা রাস্তার এমন কন্ডিশনের কথা জানেন
তারা কখনোই এমন রাস্তায় এসে সর্বনাশের মুখমুখি হতে পারেন না। সেই কারণে ছোট গাড়ি চোখেই
পড়ছে না। একটি স্টেট ওয়ের অবস্থা দেখেই বোঝা যায় রাজ্যের অবস্থা কেমন আছে। যে রাস্তা
দিয়ে এতো গাড়ি চলাচল করে সেই রাস্তা মোড়গ্রাম থেকে সুদূর নলহাটি পর্যন্ত কিভাবে চরম
খারাপ অবস্থায় থাকে? এসব বিষয় আলোচনা করতে করতে প্রায় গরুর গাড়ির মতোই আমরা সামনে এগিয়ে
চলছি। সেলিম ড্রাইভ করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়ছে। কখনো এদিক দিয়ে ঘুরিয়ে কখনো ওদিক দিয়ে
ঘুরিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলছে। কখনো কখনো বড় গর্ত দেখলেই আমাদেরকে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা
পরখ করে আসতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ ধরে ভাবতে হচ্ছে রাস্তার কোন পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া
যায়। ভয় হচ্ছে গাড়ি উল্টে বা পাল্টি খেয়ে যেতে পারে। অথবা গাড়ির ধুরি কোন পাথরের ঢিবিতে
ধাক্কা মেরে ভেঙ্গে যেতে পারে।
(মোড়গ্রাম-পানাগড় রাজ্যসড়কের ভয়ঙ্কর অবস্থা)
গাড়ি হেলতে দুলতে চলতেই থাকল। তবে রাস্তায়
যেখানে লোক দেখি তাকেই জিজ্ঞেস করি, আর কতদূর গেলে রাস্তা ভাল পাওয়া যাবে? সকলের একই
উত্তর, আর কিছুটা গেলেই ভাল রাস্তা পাবেন। কিন্ত আমরা যতই সামনে এগিয়ে যাই রাস্তার
অবস্থা একই থেকে যায়। আসলে এসব লোকের কাছে ভালর সংজ্ঞা বলে কিছুই নেই। এই খারাপটাই
এদের কাছে ভাল হয়ে গেছে।
কিন্তু কোথাও রাস্তার ভাল অবস্থা দেখতে পেলাম
না। ওই অবস্থায় চলতে চলতেই শেষের দিকে হেলতে দুলতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন আমার ঘুম
ভাঙ্গল তখন দেখলাম, সেলিম আমার উপর চরম বিরক্ত হয়ে গেছে। ও বলল, শিশু ছাড়া কোন সুস্থ
মানুষ এমন ভয়ঙ্কর রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়তে পারে না। যে কোন অবস্থায় গাড়ি উল্টে যেতে পারে।
আর তুমি ঘুমাচ্ছ?
আমি বললাম, কেন জানিনা, গাড়িতে ঘুমাতে আমাকে
ভীষণ ভাল লাগে। অনেক দিন ট্রেনে, বাসে ঘুমিয়েছি। একদিন সন্ধ্যায় বহরমপুর থেকে বাসে
বাড়ি ফিরছিলাম। আমার জিয়াগঞ্জ আমাইপাড়ায় নেমে যাওয়ার কথা। বাসটি যখল লালবাগ ঢুকছে তখন
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বাসটি আমাইপাড়া পেরিয়ে জিয়াগঞ্জ ফুলতলায় গিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে
থাকল। আমার ঘুম ভাঙল না। যখন জিয়াগঞ্জ ছেড়ে অনেকটা পথ চলে গেছে ঠিক তখন আমার ঘুম ভাঙল।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমি ভগবানগোলায় পৌঁছে গেছি। কি আর করা যায়। বাস থেকে নেমে
আবার ট্রেকার ধরে বাগডহর। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে আমাইপাড়া। তারপর প্রায় রাত এগারটায়
তিন ঘণ্টা লেট করে বাড়ি ফিরলাম।
আমার কথা শুনে সেলিম আর মীর না হেসে পারল
না। তারপর সেলিম বলল, এই কারণেই তোমাদের দ্বারা কোন কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে না। এতো শিশুসুলভ
আচরণ নিয়ে মানুষ হওয়া যায়? কখনো নয়।
অবশেষে
প্রায় তিন ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আমরা নলহাটিতে পৌঁছালাম।