ভালোবাসার শেষ চিঠি
মনিরা ইসলাম
অন্তিম
পর্ব
" নীল " অনিকে অনেক করে বোঝানোর
চেষ্টা করল রাজনীতি থেকে সরে আসার জন্য কিন্তু অনি ততদিনে আষ্টেপৃষ্টে রাজনীতির সাথে
জড়িয়ে গেছে, চাইলেও ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। ফোনের দুই প্রান্তে দু' জনই চুপচাপ, কেউ
কারো সাথে কথা বলার অবস্থানে নেই। " অনি" নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো নীল
"I love you". " নীল " কিছু বলার আগেই ফোন টা কেটে গেল।
মাস তিনেক বেশ ভালোই কাটছিল ওদের। দু' জন
দু' জনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। এর মধ্যে কলেজে ছাত্র কেবিনেট নির্বাচন। অনি বিরোধী
দলের রাজনীতির সাথে জড়িত কিন্তু কলেজের সেরা ছাত্র হওয়ার কারণে সবাই তাকে নির্বাচনে
" ভি,পি" হিসেবে পেতে চাইল। যথারীতি বিপুল ভোটে জিতেও গেল। সেদিন "
নীলের" মনে ভয় থাকলেও খুব খুশি ও হয়েছিল। প্রিয় মানুষের বিজয়, মনের মধ্যে আনন্দ
যেন ঢেউ খেলছিল। " অনি" চিঠিতে লিখেছিল কলেজের শপথ অনুষ্ঠানের পর নীলের কাছে
চলে আসবে, নীলের সাথে দেখা করবে। " নীলের " চোখে মুখে বাধভাঙ্গা আনন্দ।
" নীল " হোস্টেলে থাকা অবস্থায় টিউশন করতো। তাই কিছু টাকা জমিয়ে " অনির"
জন্য একটা হালকা নীল রঙের একটা পাঞ্জাবী কিনে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিল। এবং " অনি"
কে লিখে দিল যেদিন সে আসবে এই পাঞ্জাবীটাই যেন পরে আসে। " অনি" পাঞ্জাবী
টা পেয়ে আবেগে বলেছিল এখন যদি আমি পুলিশের গুলিতে মারাও যাই তাও আক্ষেপ থাকবে না।
" অনি" পাঞ্জাবীটা পরে একটা ছবি তুলে "নীল " কে পাঠিয়ে দিল।
"নীল " এর আগে কখনো " অনি"
কে দেখেনি। অপুর্ব সুদর্শন যুবক বলতে যা বোঝায় " অনির" মাঝে তার সব কিছুই
ছিল। নীলের চোখে মুখে উচ্ছ্বাস দু'চোখের মনি যেন ছবি টা বারবার দেখছিল আর ভাবছিল এই
তার স্বপ্নের মানুষ। আবেগে কেঁদে ফেললো নীল। দুদিন পরে অনি লিখেছিল নীল " আমাকে
তোমার পছন্দ হয়েছে? " নীল " দুষ্টমি করে বলেছিল মোটেই না। অনি লিখেছিল ঠিক
আছে হারিয়ে গেলে কিন্তু খুঁজ না। নীলের বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল এ কেমন কথা, অনি না
থাকলে নীল অচল। অনি পরের চিঠিতে লিখলো বিশেষ কি কাজে ঝামেলায় আছে, নীলের কাছে দোয়া
চেয়েছিল। হঠাৎ এক সপ্তাহ অনির কোন চিঠি নেই খোঁজ খবর নেই। নীল ভীষণ দুঃচিন্তায় পরে
গেল। প্রায় দশ দিন পর অনির চিঠি এলো,,,,, নীল ...….. ক্ষমা করে দিও। হতেও পারে এটাই
তোমাকে লেখা আমার শেষ চিঠি। তোমার কাছে আসবো বলে তোমার দেয়া পাঞ্জাবি পরে বের হয়েছিলাম।
স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই কালো পাজেরো জিপে আমাকে তুলে নিয়ে এলো থানায়। আমি এখন একা একদম
একা একটা ছোট্ট অন্ধকার ঘরে অসহ্য গরম আর শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে তোমার মুখটা আঁকার
চেষ্টা করছি। " নীল " পৃথিবীর আলো বাতাস যদি আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায় আমাকে
যদি ছুটি দেয়া হয় তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। হয়তো কোন দিন আর তোমার সাথে আমার দেখা
হবে না, মনের না বলা কথাগুলো বলা হবে না। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে নীল। যে ছেলেটা এসি
ছাড়া ঘুমায় না, যার চারপাশে সারাক্ষণ তিন চারজন ঘিরে থাকে সে এখন একদম একা। কারো সাথে
কথা বলার সুযোগ নেই। নীল তোমাকে বলেছিলাম " রাজ শেখর" আমার খুব ভক্ত, গতরাতে
ওঁকে ও নাকি পুলিশ তুলে এনেছে। এখান কার কিছু কনস্টেবল আমার খুব ভক্ত। আমাকে যখন পাঞ্জাবিটা
খুলতে বলা হলো আমি তখন বললাম তোমাদের যা খুশি করে নাও শুধু পাঞ্জাবিটা খুলতে বল না।
এবার মনে হয় আমাকে আর পৃথিবীর আলো বাতাসে ফিরতে দিবে না। চিরকালের মতো নিঃশব্দের ঘুম
পাড়িয়ে দিবে ওরা। কনস্টেবলের চোখে মুখে আমি সেই উদ্বেগ টা দেখেছি, সাধারণ কনস্টেবল
গুলো আমাকে খুব ভালোবাসে তাই ওরা কিছু না বললেও আমি ওদের চোখের ভাষা বুঝতে পারি।"
নীল " শুধু মনে হচ্ছে আরও একটা দিন আগে কেন আমি তোমার কাছে গেলাম না। তোমার সাথে
দেখা হওয়ার পর যদি আমি ওদের অতিথি হতাম একটুও আক্ষেপ থাকতো না। নীল আজ পনের দিন আমি
আকাশ দেখিনা। প্রকৃতি দেখিনা, বাতাসে ফুলের গন্ধ পাইনা। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
আমি জানিনা এই লেখা টাও তোমার কাছে পৌছাবে কিনা। তবে কনস্টেবল কে বলেছি তোমার ঠিকানায়
পৌঁছে দিতে। নীল কষ্ট পেও না। এই জীবনে তোমার সাথে আমার নাইবা দেখা হলো পরের জন্মে
আমি তোমার অপেক্ষাতেই থাকবো যেন। " নীল " শেষ বারের মতো যদি নীল আকাশটাও
দেখতে পেতাম সেখানে আমি তোমাকে খুঁজে নিতাম। ...... " ওপারের ডাক এসেছে আমার
......... নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আলো বাতাস .......... ঘুমিয়ে যাব আমি চিরতরে
.......... যদি শুনতে পাও কাছে এস একটিবার .......... ভালোবেসে ছুয়ে দিও আমার কফিন
টারে।। নীল আর লিখতে পারছি না। ক্ষমা করে দিও আমার অপারগতা। শুধু জেনে নাও " নীল
" আমি তোমাকে ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি। আমি তোমার আকাশ হব আর তুমি সেই আকাশের নীল
হবে, রঙে রঙে আমায় ভড়িয়ে দিবে। ......................... ভালো থেক নীল।
তোমার ---
অনি ।
এরপর
আর অনির কোন চিঠি আসেনি। কি নির্মম পরিনতি অনির জীবনে এসেছিল আজও জানেনা নীল। শুধু
অনির জন্মদিনটা স্মরণ করে নীল প্রতি বছর গোলাপ আর বেলি ফুল ভাসিয়ে দেয় নদীর জলে।