হৃদয় কথা

 

হৃদয় কথা

সামসুন নাহার

        মিষ্টিখানা মুখে তুলতে যাবে, এমন সময় সুদীপার মনে পড়ে গেল বুড়ো মানুষটির কথা। প্রায় নব্বই বছর বয়স হয়েছিল সুদীপার শ্বশুরমশাইয়ের ।গত দুমাস হল তিনি আর নেই।মিষ্টি খেতে প্রচন্ড ভালোবাসতেন বলে সুদীপা স্বামী অমরকে দিয়ে রসগোল্লা আনিয়ে রাখতো ।তার শিশুসুলভ আচরণে মনে হত বৌমা সুদীপাই তাঁর জন্মদাত্রী।

'মা' ডাক যেমন শিশুর প্রথম এবং প্রধান ভাষা , ঠিক তেমনি ভাবেই মানুষটির মুখের বুলিই ছিল, মা…. মাগো….

মাঝেমধ্যে অস্থির হয়ে সুদীপা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলতো, -- কি হয়েছে টা কি ?ডাকেন কেন ?

--না তেমন কিছু নয় মা।

--তাহলে এত ডাকাডাকি কেন করেন? কাজের মাঝে কি বারবার ছুটে ছুটে আসা যায় ? ঠিক সময়মতো আমি খেতে দেবো। একদম ডাকাডাকি করবেন না।

সুবোধ বালকের মতো মাথাটি নেড়ে মানুষটি বলতো, -- আচ্ছা আর ডাকবো না মা।

পেছন ঘুরতে না ঘুরতেই আবার, --মা….. মাগো…..

বাড়িতে কেউ এলে শুরু হয়ে যেতেন, তিন দিন কিছু খাইনি।এরা আমায় কিছু খেতে দেয় না।এ কথার ভিত্তিতে পাড়ায় অনেকে বলেওছে, --বুড়োটাকে ঠিক করে খেতেও দেয়না।

সুদীপা এসব কথা গায়ে মাখেনি‌ কখনো। সে কর্তব্যে বিশ্বাস করে। রাতে শ্বশুরের বিছানা তৈরি করে চলে আসছে এমন সময় বলে উঠতেন, --মাগো, খেতে দিলে না তো ?

--এই মাত্র খেলেন তো। এবার শুয়ে পড়ুন।

--মিষ্টি নেই ?

মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে সুদীপা যেই না বলেছে, --কাল মিষ্টি আনিয়ে দেব কেমন। এখন ‌ঘুমিয়ে পড়ুন । চোখে মুখে সে কি আনন্দ ফুটে উঠেছিল সেদিন মানুষটার। মাঝে মাঝে ভয়ানক দুষ্টুমিও করতেন । পটি করে দেওয়ালে, জানালায়, কাপড়ে, চোপড়ে মাখিয়ে রেখে দিতেন ।

--বাবা এসব কি করেছেন ? হয়ে গেছে যাক । তবে এভাবে মাখামাখি করে কেউ । আপনি দেখছি আমাকে আর বাঁচতে দেবেন না ।

--আমি তো কিছু করিনি, মা!

--আবার মিথ্যা কথা । মাথায় বুদ্ধি একেবারে গজ গজ করছে আপনার ।

 

রাত প্রায় আড়াইটা। সারাদিনের খাটাখাটনির শরীর।সবে ঘুমটা একটু গাঢ় হয়েছে সকলের। অমনি চিৎকার, --মা...মা...মা….মা…. মাগো….মাগো….মা…. মাগো অবিরাম ডেকেই চলেছেন।

--নাহ্, কি যন্ত্রণা !

একটুও উঠতে ইচ্ছে করছে না সুদীপার । তবুও উঠে আসতেই হল। কারন সুদীপা জানে, যতক্ষণ সে না যাবে ততক্ষণ শ্বশুর মশাই থামবেন না। আর চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ লোকের ঘুম ভেংগে যাবে।

পরেরদিন অমরের অফিস, বাচ্চাদের স্কুল।এসব‌ ভাবতে ভাবতে কোনরকম উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে আর হাই তুলতে তুলতে সুদীপা শ্বশুরের সামনে গিয়ে হাজির হল।

--কি হয়েছে,এত রাতে ডাকছেন কেন? আপনি তো সারাদিন ধরে ঘুমাবেন। আমরা কি করে বাঁচবো এত অত্যাচার করলে ?

--না অত্যাচার করব কেন মা? শুধু একটু জানতে চাই….. ক'টা বাজে ?

--কটা বাজে জেনে কি হবে ? শুয়ে পড়ুন ।

--খেতে দেবে না ? আজ তো আমি সারাদিন ভাত খাইনি ।

--উফ্….মহা মুস্কিল...কি জ্বালায় যে পড়েছি ! ঠাকুর আর কতদিন ? আর যে পারছিনা !

বলে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে সুদীপা গিয়ে আবার শুলো বটে তবে ঘুম আর হলো না। হবে কি করে? সেদিন সারা রাত ধরেই ওনার চিৎকার চলেছিল । বাড়ির বাকিরাও একে একে উঠে পড়ল ।

এরপর হঠাৎই মানুষটির শরীরটা খারাপ করল। কয়েকদিন ধরে আমাশয় হচ্ছে । খাওয়া দাওয়া করেন না। মা বলে আর ডাকেন না।সুদীপা কাজের ফাঁকে বার বার এসে দেখে যাচ্ছে । যে মানুষটি মা মা করে অতিষ্ঠ করে তুলতেন, সেই মানুষটির মুখে মা ডাক না শুনতে পেয়ে মনটা হু হু করছে সুদীপার। এই হল মেয়েদের জীবন । নিজের বাড়ি ফেলে পরের বাড়ীতে যেদিন থেকে আসে সেদিন থেকেই আস্তে আস্তে কেমন করে যেন পরের বাড়ীর মানুষগুলোর সাথে সুখে দুঃখে এক হয়ে যেতে হয় সে হদিস তারা নিজেরাই রাখেনা ।

ছোট ছেলের বায়নাতে অমর সেদিন বাড়িতে রসগোল্লা এনেছিল । সুদিপা খুব

খুশি হয়ে ভাবল, শ্বশুরকে একটা মিষ্টি খেতে দেবে । কিন্তু অমরের আপত্তি থাকায় দিতে না পেরে খুব কষ্ট পেয়েছিল সেদিন সে।

--একটা খেলে কিছু হবে না গো । সেদিন মিষ্টি মিষ্টি করে খুব কাতরেছে ।

--আচ্ছা সুস্থ হয়ে গেলে আবার এনে দেব। আজ আর দিতে হবেনা ।

 

সুদীপার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মানুষটির খাওয়ার প্রতি ঝোঁক ছিল প্রবল। যখন যা খেতে চেয়েছেন,হয় নিজে বানিয়ে তা না হলে বাজার থেকে কিনে আনিয়ে খাওয়া তো সুদীপা।

ঠিক পরদিন সকালেই মানুষটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তিনি তো পরপারে তাঁর ‌গন্তব্যে পৌঁছে গেলেন । তবে সুদীপার মনে চীরকালের জন্য একটা দাগ কেটে দিয়ে গেলেন ।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post