শিক্ষা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা বনাম আধুনিক শিক্ষা

 

শিক্ষা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা বনাম আধুনিক শিক্ষা

রুমা পারভীনারা

        'শিক্ষা' শব্দটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। নদীর স্রোতধারা যেমন প্রাচীনকাল ধরে উৎপত্তি স্থল থেকে বহমান হয়ে আসছে তেমনি শিক্ষা ও সূদুর প্রাচীনকাল থেকে জন্ম জন্মান্তরের নাড়ির স্পন্দন - নাড়ীর সম্পর্কে চিরকালই গতিকে অব্যাহত রেখেছে। 'শিক্ষা' শব্দটি একটি তৎসম শব্দ। শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত 'শাস্' ধাতু থেকে। যার বুৎপত্তিগত গঠন হল 'শাস্ অ+ আ।এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল 'শৃঙ্খলিত করা' বা 'নিয়ন্ত্রিত করা'। গতানুগতিক অর্থে 'শিক্ষা' হলো ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা, শৃঙ্খলিত করা। আবার 'শিক্ষা 'র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত আরেকটি শব্দ হল 'বিদ্যা'। এই 'বিদ্যা' শব্দটি সংস্কৃত 'বিদ্' ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ হলো 'বিদ্যার্জন করা' বা 'জ্ঞান অর্জন করা'। অর্থাৎ 'শিক্ষা' ও 'বিদ্যা' পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।

        এই 'শিক্ষা' শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো'Education'. এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ 'Educare' থেকে।এর ইংরেজি অর্থ হল 'To lead out' অর্থাৎ শিশু ও শিক্ষার্থীর আভ্যন্তরীণ শক্তিকে বাইরে প্রস্ফূটিত করা। আবার এই 'Education' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'Educare' এর ইংরেজি অর্থ হল 'To bring up' অর্থাৎ বাংলা প্রতিশব্দ 'প্রতিপালন করা' বা প্রতিপালনের মাধ্যমে শিক্ষা দান করা। আবার 'Educo' এর ইংরেজি অর্থ হল 'Leading forth'.অর্থাৎ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।'Educatum' এর অর্থ হল নির্দেশ দান। অর্থাৎ শিশুর সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশ সাধনকে নির্দেশ করা।

এই 'শিক্ষ'র উৎপত্তি সম্পর্কে লক্ষ্যণীয় উৎস প্রস্ফূটিত হয়েছে বা হচ্ছে বর্তমান সময়েও। তেমনি একজন শিক্ষাবিদ্ Joseph Twadell Shiply তাঁর বিখ্যাত প্রতিবিধান চয়নিকা 'Dictionary of word origins' গ্রন্হে লিখেছেন 'Education' শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন 'Edex' এবং ' Ducardu' শব্দগুলো থেকে।যার বাংলা প্রতিশব্দ নির্ধারিত করা যায় 'বার করা' এবং 'পথ প্রদর্শন করা'।

        'শিক্ষা' সম্পর্কে বহু পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সমস্ত দেশেরই শিক্ষাবিদগণ তাঁদের 'শিক্ষা' সম্পর্কিত সংজ্ঞাকে প্রদর্শিত করেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে।দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা সম্পর্কিত সংজ্ঞাকে —"তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে। "গান্ধীজির সংজ্ঞানুযায়ী —' ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার সুষম বিকাশের প্রয়াস।' আবার স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা সম্পর্কীয় ধারণা ও সংজ্ঞাকে প্রতিকায়িত করা যায় এভাবেই -" মানুষের অন্তর্নিহিত বিকাশ সাধনই শিক্ষা"। প্রস্তরখন্ডে সুপ্ত অগ্নির মতো মানুষের জ্ঞানের অব্যক্ত সম্ভাবনা —"Education is the manifestation of perfection already in man like fire in the pice of a flint, knowledge exists in the mind.Suggestion is the friction which brings it out. "

পাশ্চাত্যী অ্যারিস্টটলের মতানুযায়ী শিক্ষা হল - " শিক্ষার্থীদের দেহ, মনের বিকাশ সাধন এবং তার মাধ্যমে জীবনের মাধুর্য ও সত্য উপলব্ধিকরণ। "

প্রাগৈতিহাসিককালে শিক্ষার আরম্ভ হয়েছিল প্রথমত হাতে কলমে না হলেও হাতের মাধ্যমে পাথরে পাথর ঘষে আগুন সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়ে।এ শিক্ষা পুঁথিগত না হলেও শিক্ষার অন্তরঙ্গতা হিসেবে স্বীকৃত করতে দ্বিধাবোধ নেই।তেমনি বিভিন্ন টোলের মাধ্যমে জ্ঞানী,বয়স্ক মানুষের থেকে অজ্ঞানীকে জ্ঞানী করে তোলাও শিক্ষার গুরুত্ব বহন করে।

বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের সংজ্ঞা ও ধারণা থেকে শিক্ষার বহু বৈশিষ্ট্যগুলিকে প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে -শিক্ষা হল দ্বিমুখী। যেমন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তেমনি বর্তমান যুগে ত্রিমুখী শিক্ষার দৃশ্য চোখে পড়ে। পরিকাঠামো হিসাবে দেখা যায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সমাজ।

শিক্ষা শিক্ষার্থীর আভ্যন্তরীন বেশিষ্ঠ্যগুলিকে বাহ্যিক করে তোলে।শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলে পূর্ণাঙ্গ সার্বিক শিক্ষিত মাইলফলক তুল্য পথনির্দেশক।

শিক্ষা যেমন উৎপত্তি হয়েছে সমাজে , তেমনি শিক্ষার পাশাপাশি দুটি অর্থ নিয়ে সমাজের কলুষতাকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছে এই শিক্ষা। এই শিক্ষাকে দুটি অর্থে প্রকাশ করা যায়, যথা - প্রথমত সংকীর্ণ অর্থে দ্বিতীয়ত ব্যাপক অর্থে।

সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা তাকেই বলা যায় যে শিক্ষার অর্থ সমাজ শিক্ষার্থীকে নির্দেশ দান করে। শিক্ষাবিদ ম্যাকেঞ্জীর এর মতে, "সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা হলো আমাদের জন্মগত ক্ষমতার অনুশীলন ও বিকশিত করার সচেতন প্রচেষ্টা বিশেষ।" সংকীর্ণ অর্থে মনে করা হয় শিক্ষা হলো মনের কতগুলি প্রোকোষ্ঠের সমবায় মাত্র।

ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হলো জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। যা শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এবং তার শেষ গতি হলো মৃত্যু পর্যন্ত। এই নিরন্তরব্যাপী শিক্ষার কোনও সমাপ্ততা নেই। জীবনের সদা পরিবর্তনশীল ও পরিবর্তিত জীবন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ জন ডিউএর মত অনুযায়ী "ব্যাপক অর্থে শিক্ষার অর্থ হলো সামাজিক ধারাবাহিকতা " অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তার জীবনব্যাপী অর্জিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখে এবং শিক্ষা লাভ করে।

এই শিক্ষাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে বিচার করলে যেন মিলিয়ে যায়,শিক্ষা হল জাতির মেরুদণ্ড, সামাজিক সঞ্চালনের বিশেষ হাতিয়ার এবং জাতির বিকাশের উন্নত শিখরে পৌঁছানোর চাবিকাঠি। জাতীয় পুনর্গঠন এক বৃহৎ সাফল্য যুব গোষ্ঠীর গুণগত মানের উপর নির্ভরশীল।

শিক্ষার অর্থের পাশাপাশি শিক্ষার ধরণ বা প্রকারভেদও শিক্ষার কাঠামো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই ধরণ বা প্রকারভেদকে বেশ কয়েকটি ভাবে উপস্থাপিত করাই যায়। যেমন-

আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা এমন একটি কাঠামো যেখানে ঘটে থাকে সমাজে যার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে। এক্ষেত্রে এই শিক্ষা পরিচালিত হয় যেখানে শ্রেণিকক্ষে স্কুলের প্রত্যেক বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষকের প্রয়োজন। আর প্রয়োজনকে সংগত করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পরিকল্পনামাফিক শিক্ষক নিয়োগ ও বিভিন্ন শিক্ষা সম্পর্কিত মডেলকে উপস্থাপিত করা হয়।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে পাঁচ থেকে ছয় বছরের নির্দিষ্টতাকে বজায় রেখে ভর্তি করানো হয়। ইউনেস্কো দ্বারা পরিচালিত ২০১৫ সালের মধ্যে "সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা" প্রগ্রামকে রূপদানের জন্য সচেষ্ট হচ্ছে দেশগুলো। উদাহরণস্বরূপ ভারতের চোদ্দ বছর পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

মাধ্যমিক শিক্ষা হল সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাস্তর। প্রাথমিক শিক্ষার ও উচ্চশিক্ষার মধ্যবর্তী স্তর হলো মাধ্যমিক শিক্ষা। এই শিক্ষা প্রধানত কিশোর বয়সের মধ্যে ঘটে। এই শিক্ষার একদিকে যেমন বিদ্যার্থীর উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত করে, বৃত্তি শিক্ষার পথকে প্রশস্ত করে। তেমনি অন্যদিকে জাতীয় মূল্যবোধ, জাতীয় আদর্শ ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে জাগ্রত করে তোলে।

উচ্চতর শিক্ষা হলো তৃতীয় স্তরের শিক্ষা কাঠামো। এই শিক্ষার মাধ্যমে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের চাবিকাঠি। উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করা ব্যক্তি সাধারণত সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা একাডেমীক ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়ে যায়।

শিক্ষার ধারণার পাশাপাশি শিক্ষার এইসব বিভিন্ন পর্যায়ে উপস্থাপিত করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে -প্রাক্ প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চতর শিক্ষা, বৃত্তিমূলক এবং বিশেষ ধরণমূলক শিক্ষা।

শিক্ষার বিভিন্ন ধারণা কে সামনে রেখে আজকাল 'বিকল্প' হিসেবেও শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলো। বিশেষত আমাদের ভারতবর্ষে বলে নয় সমগ্র পৃথিবীব্যাপী শিক্ষার এক অন্য মাধ্যম ঘটে গেল। বর্তমানে মারণ ব্যাধি 'করোনা'র কারণে সারা দেশে শিক্ষা ব্যবস্হার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই শিক্ষায় যথেষ্টভাবে পঠন-পাঠন ও পরীক্ষার পদ্ধতির আমূল ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। সেখানে শিক্ষা গ্রহণ বা শিক্ষাদানের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে 'অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষা। 'এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত মাধ্যমের ক্ষমতাকে দক্ষ করে যেমন তুলছে তেমনই পাশাপাশি কেড়ে নিচ্ছে পারিবারিক শান্তির সৃজনী ক্ষমতাকে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে বর্তমানে 'অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা' গ্রহণের মাধ্যমে অনেক দিন-মজুরদের, দুবেলা-দুমুঠো খেতে না পারা সংসারের চিরস্থায়ী শান্তিকে। সেখানে দেখা যায় অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষার গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার জন্য স্মার্ট ফোন কিনতে গিয়ে হয়তো কোন বাবার প্রাণ হারাতে হচ্ছে আত্মহত্যার মাধ্যমে আবার হয়তো কোনো শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে গলায় বাঁধা দড়িতে ঝুলে। বর্তমানে এই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রযুক্তিগত শিক্ষা সুফলের থেকে কুফলের মাত্রাটা যেন পৃথিবীর কাছে এক কালিমালিপ্ত অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে গরীব অসহায় শিক্ষার্থীদের কাছে। তারা হয়ে পড়েছে বঞ্চিত শিশু শিক্ষার্থী শুধুমাত্র উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন স্মার্টফোনের অভাবে।

সব দিক থেকে তবুও যেন বলতে হয় 'Save your life anytime any situation' অর্থাৎ বর্তমান সময়ে মহামারীর দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত থেকে বাঁচতে গিয়ে 'অনলাইন শিক্ষার' মাধ্যমকে বেছে নিতে হয়েছে। তবে আমার আপনার সকলের কর্তব্যবোধে সচেতন হয়ে দুর্বিপাকগ্রস্ত প্রচলিত বহমান শিক্ষার মান মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। তাই যেন বলাই যায়-

"প্রচলিত শিক্ষা কে ধরতে চাই মাগো।

বিপর্যস্ত তার মাঝে থেকেও। তোমরা যদি করো সহানুভূতি-

আমরা দুস্ত, বিপর্যস্ত শিশুরা পুনরায় হয়ে উঠি

তবে নবশিক্ষার্থী।

তবে সমস্ত দিকের বিচারেও বলতে দ্বিধাবোধ হয় না 'শিক্ষা শিক্ষায়ই' অর্থাৎ শিক্ষা তার সমস্ত পরিকাঠামোকে পরিবর্তিত করলেও তার দেহে ধারণকৃত জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনকে ঠিক সমান্তরালে এগিয়ে নিয়ে চলেই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।বিভিন্ন স্তরকে শিক্ষা যেমন অভিযোজনের মাধ্যমে মানিয়ে চলে তেমনি বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে মানিয়ে চলার শক্তি,সাহস ও সামর্থ্য পরিবেশন করিয়েই দেয় এই শিক্ষা।

সমাপ্ত

 

Post a Comment

Previous Post Next Post