মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ / Murshidabad Travelling

 

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ 

আজিজুল হাকিম                

 

          স্মৃতির পাতা থেকে

    আজ ব্যক্তিগত কাজে জিয়াগঞ্জ গিয়ে ছিলাম । সেখানে যতটা সময় লাগার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক আগেই কাজটি হয়ে গেল । তাই ভাবলাম একটু লালবাগ থেকে ঘুরে আসি (বর্তমানে আমরা যাকে লালবাগ বলি সেটি হচ্ছে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার রাজধানী মুর্শিদাবাদ) । এমনিতে সময় পেলেই একা সেখানে চলে যাই । এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াই । তাছাড়া ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়ক সিরাজ-উদ-দৌল্লার এলাকা বলে কথা; আপনা আপনি ভ্রমণ পিপাসা জাগায় । আর সেই তৃষ্ণা মেটাতে ছোট বেলা থেকেই সেখানে যাতায়াত ।

       আজও সেই কারণেই সেখানে গিয়েছিলাম । কিন্তু সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম । মনে হল সেই ছোট বেলাতেই যেন আবার ফিরে এলাম । কেবল মাত্র হাজার দুয়ারীর আসেপাশে দোকানগুলি না থাকলে তেমনি মনে হত ।

       সেই আশি আর নব্বই দশকের কথা, যখন বাড়ি থেক পায়ে হেঁটে জিয়াগঞ্জ; সেখান থেকে ট্রেনে চেপে লালবাগ যেতাম কাকা বা পাড়ার বড়বড় ছেলেদের সঙ্গে । তারপর ১৯৯০ সাল থেকে সাইকেল চালিয়ে একাই লালবাগ যেতাম । হাজারদুয়ারির আসেপাশে ঘুরে বেড়াতাম । তখন লোকজনের খুব একটা দেখা পাওয়া যেত না । চারিদিকে ফাঁকা ফাঁকা মাঠ । আশেপাশে তেমন ঘর-বাড়িও ছিল না । নির্জনতা আর একাকিত্বের বিলাসিতায় হলুদ রঙের তুলির স্পর্শে সগৌরবে, আত্মমগ্নতায় দাঁড়িয়ে থাকত হাজারদুয়ারি আর সামনে শুভ্র বসনের মোড়কে উদ্ভাসিত হত ইমামবাড়া । মাঝখানে জনমনষ্যিহীন ফাঁকা ময়দান । তার চারিপাশে কোন দোকানও ছিল না । সেই ময়দান থেকে দেখা যেত ভাগীরথীর মৃদুমন্দ জলস্রোত । বিশেষ করে গ্রীষ্মের পড়ন্ত বেলায় যখন সূর্যকিরণ ছোটছোট ঢেউগুলির মাথায় পড়ত আর তার প্রতিবিম্ব ঝিলিক মারত । সে সব মনোরম দৃশ্য কেবল মাত্র বসন্ত আর গ্রীষ্মকালেই দেখা যেত । হাজারদুয়ারির পশ্চিম দিকে যে আম গাছগুলি আছে, তাদের তলায় বসে বসে সেই প্রতিবিম্বের খেলা দেখতাম । আজ সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ । ওর চারিদিকে আজ যে লোহার তারের জাল দিয়ে ঘেরা আছে, তা ছিল না । কেবল মাত্র খুঁটির মাথা দিয়ে একটি মোটা শিকলের বেড়ি সিঁড়ির এ প্রান্ত থেকে কিছুটা পশ্চিমে গিয়ে তারপর অর্ধচন্দ্রাকারে দক্ষিন, পূর্ব, উত্তরদিকে চলে গেছে । তারপর সিঁড়ির অপর প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে । সেই বেড়ির তল দিয়ে দক্ষিণের ছোট মাঠটাই প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসের গালিচায় একাকি ঘুরে বেড়াতাম (এখনো আমি একাকি ঘুরে বেড়াই) । একাই ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা । মন যেদিকে চায় সেদিকেই যাওয়া যায় । কেউ বলবে না, এদিকে না, ও দিকে চলো

       যাহোক, বাবার মুখে শুনেছিলাম, যে শিকলের বেড়িটি আছে সেখানে আরও দুটি এটির তুলনায় কম মোটা লোহার শিকলের বেড়ি ছিল । ইংরেজরা যখন এ দেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন ওই দুটিকে কেটে নিয়ে চলে যায় আর এটি বেশ মোটার জন্য কাটতে পারেনি । আসলে এগুলি গল্প মাত্র । হয়ত অন্য কেউ কেটে চুরি করে নিয়েছে । তখন তো হাজারদুয়ারির আশেপাশে কেউ বাস করত না । সেই সুযোগেই চুরি করেছিল হয়তো ।

         হাজারদুয়ারি আর ইমামবাড়ার মাঝে যে সুবিস্তৃত ফাঁকা মাঠটি আছে তখন এই মাঠের মধ্যে কোন রকম ফুলের চাষ হতো না । কামান, মদিনা শরীফ (কথিত), আর ঘড়িঘরটা দাঁড়িয়ে থাকত জনকোলাহল থেকে একাকীত্বের নীরবতায় । বাইরের লোকজনও তেমন নজরে পড়তো না ।

       এই হাজারদুয়ারির দক্ষিণের শিকল বেষ্টিত ছোট মাঠ থেকে দক্ষিন দিকে তাকালে নিউ প্যালেস স্পষ্টভাবে দেখা যেত । আর এই দুটির মাঝে মোটা মোটা পাথরের চাঁইয়ের ছোট টিলা আছে যার উপরে একটি নিমগাছ আছে, সেই টিলার উপরে গিয়ে বারবার উঠা নামা করতাম । খুব মজা পেতাম ।

       সেই সময়য়েই হাজারদুয়ারির ভিতরে প্রথম প্রবেশ । টিকিট মূল্য পঞ্চাশ পয়সা ছিল । যাহোক, সেখানে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম । এত সুন্দর প্রাসাদে সিরাজ-উদ-দৌল্লা বাস করতেন ! কত সুন্দর কারুকার্য ! কত সুন্দর তৈলচিত্র ! নবাবদের বড়বড় ছবি । এসব দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম । তারপর যখন অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলাম তখন মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল । একটি ছোরা দেখিয়ে একজন বলে উঠল, “এই ছোরা দিয়েই মহম্মদ বেগ নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে খুন করেছিল” ।

অনেক্ষন সেই বিষাক্ত, অভিশপ্ত ছোরাটির দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে ছিলাম । কিশোর মনের নীল কল্পনায় যেন দেখতে পাচ্ছিলাম, সেই অভিশপ্ত মধ্য রাত । ঘুটঘুটে শুনশান অন্ধকার সেই রাত যেন বিষাদের অবগুণ্ঠন পড়ে মৃত্যুর ছাড়পত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে । চারিদিকে অবিরাম বৃষ্টির ধারা মুষলধারে ঝরে পড়ছে । নিরুপায় প্রকৃতিও যেন সিরাজের জন্য অঝোর ধারায় ব্যাকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে ।  মাঝেমাঝে ব্জ্রবিদ্যুতের ক্ষণজন্মা আগুনের ঝলকে নিভন্ত প্রদীপের মতোই কেঁপে কেঁপে উঠছিল মুর্শিদাবাদের আকাশ-বাতাস । অতি সাধারণ ভীষণ অন্ধকার কারাগারে বাংলা-বিহার-উরিষ্যার নবাব হাতে পায়ে শিকলের বেড়ি পরে বসে আছেন অসহায় শিশুর মতো মুক্তির প্রতীক্ষায় । চোখে মুখে ভয় আর আতঙ্কের ছাপ । বিশ্বাস ঘাতকতার অদৃশ্য তরবারির আঘাতে জর্জরিত হৃদয়, দেহ, মন । ঠিক সেই সময় প্রতারক মীরনের প্রবঞ্চনায় জল্লাদকে  পাঠিয়ে দেওয়া হল সেই কারাগারে । কারাগারের কবাট খুলতেই বাইরে থেকে ক্ষীণ আলোর আভা কারাগারে প্রবেশ করল । তার সঙ্গে প্রবেশ করল সিরাজের বিশ্বস্ত ব্যক্তি মহম্মদ বেগ । তাকে  প্রবেশ করতে দেখে অবশেষে সিরাজের মনে একটু প্রাণের সঞ্চার হল । সিরাজের কণ্ঠে বেজে উঠল মুক্তির অনেক কাকুতি মিনতি, প্রাণ ভিক্ষা । সিরাজ পুনরায় স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখালেন মহম্মদ বেগকে । কিন্তু কে শুনে ধর্মের কথা । কোন কথাই স্পর্শ করলনা মহম্মদ বেগের হৃদয়কে । অবশেষে সিরাজ এক গ্লাস পানি চাইলেন । পেশাদার জল্লাদের মতই পানির পরিবর্তে বুকে বিদ্ধ করল এই ছোরা । করুণ আর্তনাদে ছটপট করতে করতে সিরাজ পড়ে গেলেন মেঝেতে । পরের দিন ভোর বেলায় প্রচারিত হল, “সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে মীরন হত্যা করেছে” ।

তারপর মীরজাফর আর মীরনের নির্দেশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিরাজের প্রিয় হাতির পিঠে করে সিরাজের ক্ষতবিক্ষত মৃত দেহ মুর্শিদাবাদ শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো হল । সেই হাতির পিছনে চলছিল ভয়ঙ্কর বিজয় উল্লাস । সারা শহরের অবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মনে ছড়িয়ে দেওয়া হল রক্তাক্ত আতঙ্কের শিহরণ ।

হঠাৎ এক সাথীর ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম ।

                                                (চলবে)  

                           

Post a Comment

Previous Post Next Post