গল্প
ধর্ষিতা মা
জাহাঙ্গীর আলম - (সোহেল)
২য় পর্বঃ
মায়া রান্না করে
বসে আছে, সুজন আসলে দুপুরে ওকে খেতে দেয় । সুজন মায়াকেও বাধ্য করে একসাথে ভাত খেতে।
মায়াও খেয়ে নেয়, খাওয়ার পর সুজন বাহিরে চলে যায় । মায়া তখন ঘরের সব ময়লা কাপড় ধুয়ে
পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দিয়ে নিজেও গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বকুলকে ঘুম পাড়িয়ে ভেজা চুল
আঁচড়াচ্ছে । তখনি এক মেয়ে আসলো সুজনের বাসায় ।
মায়াঃ
কে আপনি ?
চাঁদনীঃ
আমি রাতের আকাশে চাঁদনী । আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা ?
মায়াঃ
আমি মায়া, কিছুদিন হলো গ্রাম থেকে এসেছি ।
চাঁদনীঃ
সুজন বিয়ে করলো আমি জানিনা ? যাকগে আমি বাহির থেকে দেখে আসলাম আপনাকে ।
তখনি
সুজন চলে আসলো ।
সুজনঃ
আরে চাঁদনী তুই ?
চাঁদনীঃ
হেরে এতো সুন্দর সংসার পাতলি আমায় দাওয়াত দিলিনা ?
সুজনঃ
তুই যা ভাবছিস আসলে তা না ।
চাঁদনীঃ
থাক থাক এতো লেকচার শুনতে আসিনি । তুই কাকে নিয়ে থাকবি তোর ব্যাপার, কথা হলো আমি তোর
টাকা দিতে এসেছি, নে ধর।
সুজনঃ
আচ্ছা ঠিক আছে, আর শোন এ মেয়েটি খুব অসহায় । কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই থাকতে দিছি
। সময় হলে আবার চলে যাবে ।
চাঁদনীঃ
আমার ওসব শুনার দরকার নেই, কাকে কতদিন রাখবি সেটা তোর ব্যাপার ।
তবে শোন একটু সাবধানে
থাকিশ । যদি শিরাজবাবু জানতে পারে তাহলে তো বুঝিস ।
সুজনঃ
নারে এ তোর লাইনের মেয়ে নয়৷
চাঁদনীঃ
আমিও কি এ লাইনে ছিলাম নাকিরে ! ঐ শিরাজইতো নিয়ে আসছে । তাই বলছি এসব মায়ার সংসার করতে
চাইলে দূরে গিয়ে কর।
সুজনঃ
হুম ভেবে দেখবো ।
চাঁদনীঃ
আচ্ছা চলিরে, চলি ভাবি ।
মায়াঃ
উনি কে ? আমারে ভাবি ডেকে গেলো ।
সুজনঃ
ওকে আপনি চিনবেন না, একদিন এ পার্কে ও মালা বিক্রি করতো ৷ তারপর একদিন শিরাজ বাবুর
নজরে পড়ে যায় । সে ওকে ওর বাংলোতে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে দেয় ।
সেখান থেকে আজো সেই
পথেই আছে । এখন রাতের বেলায় পুরুষদের মন জুগিয়ে দিন চালায়৷
মায়াঃ
তাহলে আপনার সাথে কি সম্পর্ক মেয়েটির ?
সুজনঃ
কোন সম্পর্ক নেই, মাঝে মাঝে আসে কথা বলে চলে যায় । কখনো টাকার দরকার হলে নেয়, আবার
দেয় ৷ এমনিতে মন ভালো, শুধু সমাজ ওকে এ পথে নামিয়ছে ।
মায়াঃ
আচ্ছা, আপনি বসেন আমি চা করে আনছি ।
এভাবেই
চলছে মায়া আর সুজনের সংসার। মায়ার খুবই খারাপ লাগে এভাবে অচেনা অজানা একটি ছেলের সাথে
একি ঘরে এতদিন রয়েছে । তবও কিছু করার নেই, মায়ার তো কপাল ভালো সুজনের মতো একটি ছেলে
ওকে আশ্রয় দিয়েছে, না হলে হয়তো চাঁদনীর মতো সেও হারিয়ে যেতো অন্ধকারে ।
প্রায়
তিন বছর পার হয়ে গেলো, ওরা একি ছাদের নিচে । সুজন কোনদিন খারাপ নজরে তাকায়নি মায়ার
দিকে, মায়া প্রথম প্রথম কয়েকমাস ভয়ে ভয়ে থাকলেও এখন ভয় নেই আর সুজনকে নিয়ে । তাছাড়া
সুজন যদি জোর করে কিছু করতেও চায় হয়তো মায়া বাঁধা দিতে পারবে না ৷ সুজন অনেক করেছে
ওর জন্য, এর জন্য একটু প্রতিদান তো দিতেই হবে ৷
মায়া মনে মনে ভালোবেসে
ফেলে সুজনকে ৷ সুজনোও ভালোবাসে, কিন্তু অন্যজনের স্ত্রী, তারপর এক বাচ্চার মা এসব ভেবে
কেনদিন বলেনি । সুজন বেশ কয়েকবার মায়াকে নিয়ে ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় ঘুরতে গেছে ।
চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক ৷ মায়া ভেবেছে হয়তো সুজন নিজ থেকে বলবে ৷ কিন্তু সুজন কোনদিন
বলেনি । মায়া ভাবে সুজন যদি ওকে বিয়ে করে নিতো তবে জীবনটা ধন্য হয়ে যেতো ।
সুজন
আর মায়ার সম্পর্ক এখন অনেক গভীর, একে অপরের অপর অধিকার খাটায় শাসন সূলভ । রাগ অভিমান
সবটাই হয়, শুধু রাত হলে দুজন দু ঘরে । যখন মায়া রাত হলে রান্নাঘরে চলে যায় শুতে, তখন
সুজন বাহিরে বসে আপন মনে কখনো বাঁশি বাজায়, কখনো কষ্টের গান গায় ৷ মায়া শুয়ে শুনে আর
চোখের পানি ফেলে ।
সুজন
একদিন দেখে মায়া পার্কে বসে থাকা কিছু কলেজের ছেলে মেয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ৷
ওরা চলে গেলে মায়া সেখানে গিয়ে ওদের পড়ে থাকা একটি বই এনে নাড়াতে থাকে । সুজন এসে বললো,
“আপনি পড়তে জানেন ?”
-
হ্যা। আমি এসএসসি খুব ভালো নাম্বার নিয়া পাশ করছিলাম ।
সুজনঃ
আমি যদি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেই তবে পড়বেন ?
কথাটা
শুনে মায়া চমকে গেলো, খুশীতে চোখ বড় বড় হয়ে উঠলো । পরক্ষনেই আবার মুখটা মলিন হয়ে গেলো,
বলে গীরবের খাওন জুগাইতেই কষ্ট হয় আবার লেখাপড়া হয় কেমনে !
সুজনঃ
আপনি পড়বেন কিনা তা বলুন ।
মায়াঃ
এহন কি হেই বয়স আছে ? তাছাড়া বকুল কার কাছে থাকবে ?
সুজনঃ
বকুলরে নিয়া কোন চিন্তা করতে হবে না, আমি বকুলরে সামলামু৷ আমি কাইলি ভর্তি করাই দিমু
আপনারে ।
মায়াঃ
আমার কাছে কোন কাগজ নাইতো ৷
সুজনঃ
আরে এসব ভাবতে হবে না, কাগজ আমি যুগাইয়া দিমু ৷ ঐ কলেজের মাষ্টার আমারে খুব ভালোবাসে,
আমি বললে নিশ্চই কিছু একটা করবে ।
মায়া
খুশী হয়ে ঘরে চলে এলো ।
মায়াকে
এক সপ্তাহ পরেই সুজন একটি মহিলা কলেজে ভর্তি করে দিলো । যাবতিয় বই কিনে দিলো ও নতুন
কিছু ড্রেস বানিয়ে দিলো ।
মায়া
যেনো সত্যিই একদম অপূর্ব সুন্দরী হয়ে গেছে । মায়াকে রিক্সা করে সুজন নামিয়ে দিয়ে এলো
। এসে বকুলকে খাইয়ে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিলো ।
এমনি
করেই চলছে ওদের জীবন, মায়াকে এখন বেশি কাজ করতে দেয়ান সুজন, সুজন নিজেই করে । বকুলকেউ
দেখাশোনা করে, মাঝেমধ্যে চাঁদনী এসে বকুলকে নিয়ে যায় বেড়াতে ।
মায়ার পরীক্ষার ফিসের
সময় চাঁদনী সুজনকে টাকা ধার দেয় । মায়া এটা শুনে খুব রাগ করে ঝগড়া করে সুজনের সাথে
। তাই মায়া ঠিক করে মায়া বিকেল বেলায় কলেজে পিঠা বানিয়ে বিক্রি করবে ।
তাই
করে । সুজন বাঁধা দিলেও শুনেনা ।
মায়া
একদিন বিকেলে পিঠা বিক্রি করছে, তখন দেখে ওর কলেজের কিছু মেয়ে বেড়াতে এসেছে ৷ মায়া
লজ্জা পেয়ে চলে আসে দৌড়ে । সুজন বিষয়টা বুঝতে পারে, আর পিঠা বিক্রি সেদিন সুজন করে
।তারপর থেকে সুজন বিকেলে পিঠা বিক্রিতে মন দেয়, বকুল পাশেই খেলা করে ।
মায়া
পড়াশুনা করে । চলে যায় দুটি বছর, সে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে ।
সে দৌড়ে আসে পাশের
খবর দিতে সুজনের কাছে । সুজন খবরটা শুনেই মায়াকে কোলে তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে ।
সুজনের
কাপড় ময়লা দেখে মায়া তারাতরি নেমে পড়ে ।
আর বলে দিলে তো কাপড়টা
নষ্ট করে !
সুজন
কথাটা শুনে বেশ আঘাত পায় এবং আড়ালে চোখের পানি মুছে বেরিয়ে পরে মিষ্টি আনার কথা বলে
।
তখন দরজার পাশে চাঁদনী
দাড়িয়ে দেখে সুজন চোখের পানি মুছছে । বিষয়টা মায়া বুঝতে পারেনা ৷ চাঁদনী এসে বলে, “বাহ্,
মায়া ! যার দেয়া কাপড় গায়ে পড়ে আছেন সে খুশীতে
একটু পাগল হয়ে ধরেছে বলে কাপড় ময়লা হয়ে গেলো ! অথচ আজকের এই খুশীর দিন দেখতে পারলেন তা সুজনের জন্য”
।
মায়া
কথাটা শুনে বেশ অপমানিত হলো এবং বললো, “আমাদের বিষয়ে নাক না গলালে খুশী হবো” ।
চাঁদনীঃ
আমিতো চলে যাচ্ছি, কিন্তু সুজন এমন একটা সহজ সরল ছেলে, যার পরশ পেলে সব মেয়েদের জীবন
ধন্য হয়ে যায় । সুজনতো আপনাকে একটু জড়িয়ে নিয়েছে, আপনার জায়গায় আমি হলে এতখনে ওর কাছে
আমি নিজেকে সপে দিতাম ।
মায়াঃ
যার তার কাছে শরীর বিলিয়ে দেওয়া আপনার কাজ হতে পারে আমার নয়৷ কথাটা বলেই মায়া ভেতরে
চলে গিয়ে কাপড় পাল্টাতে থাকে ।
এর মধ্যে বকুল “আম্মু,
আম্মু” বলে ডাকতেই বকুলকে ধমক দিয়ে ভাগতে বলে । বকুল বাহিরে গাছের নিচে বসে কাঁদতে
থাকে ।
মায়া
শুয়ে শুয়ে চাঁদনীর কথা ভাবতে লাগলো । সুজনতো কোনদিন ওকে এভাবে ছুয়ে দেখেনি ৷ সে কতবার
মনে মনে ভেবেছে, সুজন ওকে স্পর্শ করুক, একটু আদর করুক । কোনদিন করেনি । আজ খুশীতে এমন
পাগলামো করেছে, অথচ অপমান করলো ! এটা ভাবতেই মায়া কেঁদে উঠলো ।
সুজন
আসলে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবে । সে তো ওকে ভোগ করলেও ওর ঋণ শোধ হবেনা । এসব ভাবতে ভাবতে
রাত হয়ে এলো সুজন এলোনা ৷ বকুলকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে বসে রইলো দরজার পাশে ।
অনেক
রাতে সুজন এলো । মায়া অস্থির হয়ে কাছে আসতেই দেখে সুজনের মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে ।
ও মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঢুলছে । অথচ আগে কোনদিন সুজন মদ খেয়ে বাড়ি আসেনি । সুজনের মাতলামো
দেখে মায়ার মুখটা মলিন হয়ে গেলো । মায়া ধরতে যাবে তখনি সুজন বলে - আমায় ছেড়ে দাও আমার
শরীরে ভীষণ ময়লা । বলেই মায়ার হাত ছাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয় গেলো ।
মায়াও
নিরুপায় হয়ে এসে ঘুমিয়ে গেলো বকুলকে ধরে ।
রাতে
স্বপ্ন দেখে সুজন মদ খেয়ে ওকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে, মায়ার ঘুম ভেঙে যায় । মায়া তখন
সেই ছোট বেলার কথা মনে করলো, যে ওকে নষ্ট করেছিলো সেও মদ খেয়ে মাতাল ছিলো । মাতালদের
পক্ষে এমন জঘন্য কাজ করা কিছুই না ।
ওর সারারাত
ঘুমালো না ।
পরদিন
সকালে মায়া গোসল করে রান্না করছে, তখন সুজন এসে মাফ চাইলো মায়ার কাছে, গত রাতের জন্য
। মায়া বললো - ঠিক আছে কিছু মনে করিনি ।
একটু
পর দুজনেই খেতে বসলো ।
সুজন
বললো - বকুল কোথায় ? ওকে দেখছিনা !
মায়াঃ
বকুলের কাল থেকে খুব জ্বর, শুয়ে আছে ।
সুজনঃ
কি বলো ? কৈ দেখি !
মায়াঃ
থাক তুমি খাও ও ঘুমাচ্ছে।
সুজনঃ
তুমি দু বছর কি পড়লে জানিনা, ডাক্তারি পড়লেতো বকুলকে এখন চিকিৎসা করাতে পারতে ।
মায়া
কথাটা শুনে ঠোট টিপে হেসে দিলো। বললো - তখন ডাক্তারি কলেজে ভর্তি নিতো না । কিন্তু
এখন ভর্তি নিবে যদি পরিক্ষায় টিকতে পারি ।
সুজনঃ
তাহলে পরিক্ষা দিয়ে পাশ দেও, যাতে ডাক্তার হইতে পারো ।
মায়াঃ
না সুজন, এতে অনেক খরচ৷ এতো টাকা আমরা কোথায় পাবো ?
সুজনঃ
কত টাকা লাগে ?
মায়াঃ
অনেক টাকা সুজন, এতো টাকা তুমি জীবনেও চোখে দেখোনি, আর কোনদিন রোজগার করতেও পারবেনা
।
সুজনঃ
আহা বলইনা কত টাকা?
মায়াঃ
তা প্রায় ১০/১২লাখতো হবেই ।
সুজনঃ
এতো টাকা ?
মায়াঃ
কি গেলো মাথা ঘুরে?
সুজনঃ
এতো টাকাতো মেলা টাকা৷
মায়াঃ
এসব ভাবনা বাদ দিয়ে এখন খেয়ে বাজারে যাও । আমি বকুলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো ঔষধ
আনতে । আর আসার সময় ওকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো । তারপর দেখি কোথায় কোন চাকুরী মেলাতে
পারি কিনা ।
সুজনঃ
ঠিক আছে ।
সুজন
আর মায়া একসাথে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে, মায়া বকুলকে নিয়ে রিক্সা করে উল্টো দিকে গেলো,
আর সুজন উল্টো দিকে হাটতে লাগলো ।
কিছুদূর
হাটতেই চাঁদনীর সাথে দেখা ৷
চাঁদনীঃ
ঐ সুজন কোথায় যাস ?
সুজনঃ
এইতো বাজারে যাবো একটু ।
চাঁদনীঃ
আয় আমার সাথে আমিও ওদিকটায় যাচ্ছি । আর শোন তোদের ব্যাচেলার সংসার কেমন চলছে ?
সুজনঃ
মায়াকে আমি ডাক্তারি পড়াতে চাই ।
চাঁদনীঃ
তোর কি মাথা পুরাটাই খেয়েছে মেয়েটা ? ও তোকে কি দিয়েছে ? কোনদিন একটু ভালোবাসা দিয়েছে
? একটু সুখের পরশ দিয়েছে ? আরে আজকের মানুষকে পুরা শরীর দিয়েও দুটো পয়সা নিতে পারিনা,
আর তুই জীবনটাই দিয়ে দিলি পরস্ত্রীর জন্য !
সুজনঃ
থামতো, এইতো আমি এসে গেছি ৷ পরে কথা হবে ।
চাঁদনীঃ
পরে বুঝবি বলে দিলাম ।
শেষ পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে
হৃদয়ে নাড়া দেওয়ার মত একটি গল্প । লেখকের প্রতি রইল আন্তরিক অভিনন্দন ।
ReplyDelete