ওয়াকফ বোর্ড সংশোধনী বিল কি ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ/আজিজুল হাকিম

ওয়াকফ বোর্ড সংশোধনী বিল কি ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ 

কলমে: আজিজুল হাকিম
 
কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ বোর্ডের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লক্ষ্যে ৪০টি সংশোধনী অনুমোদন নিয়ে সংসদে একটি বিল পেশ করতে চলেছে। যার কারণে অনেকে এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন।

আমাদের মনে প্রথমেই প্রশ্ন আসতে পারে "ওয়াকফ" কি?
ভারতবর্ষে 'ওয়াকফ' হল ইসলামী আইনের অধীনে ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত সম্পদ; যা কোন মুসলিম ব্যক্তি ইসলামী আইন অনুযায়ী কোন মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান বা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ীভাবে দান করেন। একবার কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে মনোনীত হয়ে গেলে, এর মালিকানা ওয়াকফ তৈরিকারী ব্যক্তির কাছ থেকে আল্লাহর কাছে স্থানান্তরিত হয়, যার ফলে উৎসর্গকৃত সম্পদ স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠে। এটি একটি চিরস্থায়ী দান, যা একবার ওয়াকফ হিসেবে ঘোষিত হলে তা বিক্রি, হস্তান্তর বা উত্তরাধিকার হিসেবে দেওয়া যায় না। এই সম্পত্তির মালিকানা আনুষ্ঠানিকভাবে আল্লাহর কাছে ন্যস্ত হয় এবং এর আয় দারিদ্র্যপীড়িত, সমাজের কল্যাণ বা ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সমস্ত সম্পদগুলি ওয়াকফ কর্তৃক নিযুক্ত একজন মুতাওয়াল্লি বা  উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হয়। ভারতে, ওয়াকফ বোর্ড রেলওয়ে এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের পরে তৃতীয় বৃহত্তম জমির মালিক।  বর্তমানে ভারতে প্রায় ৮.৭ লক্ষ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যা ৯.৪ লক্ষ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত, যার মূল্য আনুমানিক ১.২ লক্ষ কোটি টাকা।

ওয়াকফ বোর্ড কে বা কারা পরিচালনা করেন?
        ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের' হাতে। প্রতিটি রাজ্যে একটি করে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড থাকে, যা ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫-এর অধীনে গঠিত। এই বোর্ডগুলো স্থানীয় ওয়াকফ সম্পত্তির তালিকাভুক্তি, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও এর আয়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। কেন্দ্রীয় স্তরে 'কেন্দ্রীয় ওয়াকফ পরিষদ' (Central Waqf Council) রয়েছে, যা ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলোকে পরামর্শ দেয়, নীতি নির্ধারণ করে এবং তাদের কার্যক্রমের তদারকি করে। ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যরা সাধারণত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয় এবং এর প্রধান হন একজন চেয়ারপার্সন। বোর্ডের কাজে সহায়তার জন্য মুতাওয়াল্লি (তত্ত্বাবধায়ক) নিয়োগ করা হয়, যিনি নির্দিষ্ট ওয়াকফ সম্পত্তির দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা দেখেন। 
       ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, দাতব্য ইত্যাদির মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণ হয়। এর আয় দিয়ে গরিবদের শিক্ষা, খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়, যা সমাজে দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করে। ওয়াকফ একটি স্থায়ী সম্পদ হিসেবে কাজ করে, যার সুবিধা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পায়। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি সাহায্য ছাড়াই চলতে সক্ষম করে। এটি ইসলামী সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা, যা দানের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন ও সাম্য নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখে। যদিও এটি প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য, অনেক ক্ষেত্রে এর সুবিধা অমুসলিমদের জন্যও উন্মুক্ত থাকে, বিশেষ করে দাতব্য কাজে।

এবার প্রশ্ন আসতে পারে এই বোর্ড নিশ্চিহ্ন করা হলে কি ক্ষতি হতে পারে? 
      ধর্মীয় ও দাতব্য কার্যক্রমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হারাবে, যা তাদের ধর্মীয় পরিচয় ও সামাজিক কল্যাণে বড় ধাক্কা হবে।ওয়াকফের আয় থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আশ্রয়ের সুবিধা পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দারিদ্র্য বাড়াতে পারে। মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এমন কি সরকার ইচ্ছে করলে যে কোন মসজিদ, মাদ্রাসা বা কবরস্থানকে অধিগ্রহণ করে ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। 
       
        সবশেষে বলা যেতে পারে, ওয়াকফ সম্পত্তি ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যা ধর্মীয় ও সামাজিক কল্যাণে ভূমিকা রাখে। এটি ওয়াকফ বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়, যদিও এর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বোর্ড নিশ্চিহ্ন হলে স্বল্পমেয়াদে কিছু গোষ্ঠীর লাভ হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি মুসলিম সম্প্রদায় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
*******

Post a Comment

Previous Post Next Post