ছোট গল্প
রাস্তার কুকুর
সাদেক হেদায়েত (ইরান)
অনুবাদ : শুভঙ্কর সাহা
জীবনের খিদে-তৃষ্ণার মতো আদিম চাহিদাগুলো মেটানোর জন্যই যেন ছোট ছোট দোকানগুলো সব সাজানো এই রাস্তার চারপাশে– একটা রুটির দোকান, একটা মাংসের, একটা ওষুধের, দুটো চায়ের আর একটা সেলুনের দোকান। রাস্তাটার মতোই এখানকার মানুষগুলোরও সব সূর্যের তাপে ভাজা ভাজা অবস্থা, অপেক্ষায় আছে সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাসের জন্য। কিন্তু এখন মানুষজন, পশুপাখি, গাছপালা, দোকানপাট সব কেমন চুপ করে থম মেরে আছে। তাপটা যেন গ্রামটার উপরে চেপে বসেছে আর হাল্কা ধুলোর চাদর গাড়িঘোড়ার চলার সঙ্গে সঙ্গে ঢেকে দিতে চাইছে নীল আকাশটাকে।
রাস্তার একপাশে চওড়া পাতাওয়ালা লম্বা গাছটা গোঁয়াড়ের মতো নিজের ডালপালা চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধুলোর চাদরমাখা পাতার ছায়ায় এক বিস্তীর্ণ খোলা জায়গায় দু’জন হকার বসে নানান জিনিস বিক্রি করছে। চায়ের দোকানের জল গড়িয়ে গড়িয়ে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে সামনের জায়গাটা নরক বানিয়ে তুলেছে।
এই বিবর্ণ জনপদের একমাত্র বলার মতো বাড়ি হচ্ছে ভারামিন টাওয়ার, যার ফাটলধরা চোঙার মতো শরীরটা আর উঁচু তেকোনা মাথাটা এখনও সবার চোখে পড়ে। ইটের খাঁজে খাঁজে আশ্রয় নেওয়া চড়ুই পাখিরাও সব সূর্যের তাপে ঝিমোচ্ছে। একমাত্র একটা কুকুর মাঝেমাঝেই এই নীরবতা ভেঙে দিয়ে ডেকে উঠছে, যেন তার অভিযোগ পৌঁছে দিচ্ছে সর্বশক্তিমানের কাছে।
কুকুরটা জাতে স্কটিশ। চোয়ালটা নীলচে কালো আর পিছনের পায়ের দিকে কালো ছোপ। তার ঝোলা কান, সূঁচালো লেজ, কোকড়ানো লোম সব কাদায় মাখামাখি, যেন এইমাত্র সে কাদাপুকুর মাড়িয়ে এল। ওর রংজ্বলা কপালের নিচ থেকে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ উঁকি মারছে, গভীর চোখ মানবিক কোনও বার্তা দিতে চাইছে, যদিও তা বোঝা অসম্ভব। তার চোখদুটো দেখলে মানুষের চোখের কথা মনে পড়ে– একইরকম অনুভূতির প্রকাশ। বাদামি চোখদুটো যখন ব্যথাবেদনায় ভরে ওঠে, কেউ বুঝতে পারে না ওর আসল ব্যথাটা কোথায়, ও ঠিক কী চায়। রুটির দোকানের ফাইফরমাস খাটা ছেলেটা ওকে মারে, মাংসের দোকানের ছেলেটাও পাথর ছুড়ে তাড়ায়, কোনও গাড়ির ছায়ায় বসলেও ড্রাইভার ঠিক লাথি কষাবে। অন্য সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন চালের পিঠে বিক্রি করা হকার ছেলেটা জ্বালাতন করতে উঠেপড়ে লাগে। পাথরের আঘাতে যতবার কুঁইকুঁই করে ততবার ছেলেটা খিস্তি করে। অন্যান্যরা হেসে উঠলে ছেলেটা আরও উৎসাহিত হয়। এরকম একটা নোংরা কুকুর, যার জাত-ধর্ম ঠিক নেই তাকে উত্ত্যক্ত করাটা যেন স্বাভাবিক ঘটনা। আল্লাহকে খুশি করার জন্য ওরা সবাই কুকুরটাকে পেটায়।
আজকে এই হকার ছেলেটার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কুকুরটা তার খিদেয় নুয়ে পড়া শরীরটা টেনে নিয়ে গেল টাওয়ারের দিকে। সেখানে একটা স্লুইস গেটের নিচে আশ্রয় নিয়ে আধো ঘুমের মধ্যে সামনের সবুজ খেতের দিকে তাকিয়ে রইল। শরীরটা ক্লান্ত, স্নায়ুগুলোও সব ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে। এই ঠান্ডা, স্যাঁতসেতে জায়গাটা এক শান্তির ছায়া বিছিয়ে দিল, ওর নাকে এসে লাগছে কিছু হারিয়ে যাওয়া গন্ধ যা এখনও কী জীবন্ত! জেগে উঠছে সেই কবেকার স্মৃতি! আস্তে আস্তে ওর অতীত দিনের কথা মনে পড়তে লাগল। এক অদ্ভুত অনুভূতি, এক কণ্ঠস্বর ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠল, ওকে বলতে লাগল– উঠে পড়ো, দৌড়াও, চারপাশটা দেখো। ও ভিতরে ভিতরে এক অবিশ্বাস্য ডাক শুনতে পারছে, ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে সামনের সবুজ খেতে লাফালাফি করতে।
এটা ওর পূর্বপুরুষের প্রবৃত্তি। আসলে স্কটল্যান্ডের সবুজ উপত্যকায় ওদের সবার জন্ম। কিন্তু তার শরীর এখন এতটাই ক্লান্ত, অবসন্ন যে একপা-ও এগোতে পারছে না। ব্যথার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে দুর্বলতা আর জড়তা, হয়তো সেজন্যই ফিরে আসছে এই অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি। একসময় তার মালিকের কথায় চলতে হত তাকে– বাড়ি পাহারা দেওয়া, পথের কুকুর তাড়ানো, অনাহুত লোকজনকে ভয় দেখানো, মালিকের ছেলের সঙ্গে খেলা করা, ঠিক সময়ে খাওয়া। এসবের বিনিময়ে ও একটু আদর চাইত, চাইত মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিক। অথচ এখন এসব বন্ধন থেকে একেবারেই মুক্ত।
বর্তমানে ও শিখে নিয়েছে কীভাবে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে হয়, কীভাবে প্রতিদিনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়, কীভাবে চিৎকার করতে হয়। চিৎকারটাই ওর একমাত্র বাঁচার উপায়। আগে ও কত সাহসী ছিল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত আর এখন যেকোনও ছোট্ট আওয়াজেও কেমন চমকে ওঠে। নিজের গলার শব্দও ওকে ভয় পাইয়ে দেয়। এই নোংরা জীবনেই ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। লোমের আড়ালে উকুন জমলেও আর ইচ্ছে করে না সেগুলো ধরতে বা চেটে চেটে গা পরিষ্কার করতে। এই নোংরা পরিবেশেরই ও একজন হয়ে উঠেছে আর ভিতরে ভিতরে কিছু একটা মরে গেছে, ভিতরের সেই উজ্জ্বল আলোটা আজ মৃত।
দুটো শীত চলে গেল এই তল্লাটে। মনে পড়ে না এরমধ্যে একদিনও পেটভরে খাবার জুটেছে কি না বা একটু শান্তির ঘুম। আবেগ-অনুভূতিগুলো সব দমবন্ধ লাগে। কেউ একটু আদর করে না, চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। এখানকার লোকজন কেউ কেউ তার মালিকের মতো দেখতে হলেও তাদের সেই আবেগ নেই, ব্যবহার নেই। সেই দিনগুলোর মানুষরা ওর মনের খুব কাছাকাছি ছিল যারা ওকে বুঝত, ওর মেজাজকে সম্মান করত।
চাল গুঁড়ো করা কাইয়ের গন্ধ ওকে ওর ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় সেই সাদা, উষ্ণ তরল যা ওর মা’র শরীর থেকে খেয়ে তৃপ্ত হত আর মা ওর শরীরটাকে চেটে দিত। মনে পড়ে যাচ্ছে ভাইয়ের কথাও। মায়ের গায়ের গন্ধ আর দুধের ওম তার স্মৃতিকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।
মায়ের দুধ পেয়ে শরীরটা তরতাজা হয়ে উঠত, শিরায় শিরায় পৌঁছে যেত নতুন শক্তি। এরচেয়ে বেশি মজা আর হতে পারে? মনে পড়ে যাচ্ছে ওদের কাঠের ঘর আর ভাইয়ের সঙ্গে খেলা সবুজ মাঠ জুড়ে। মঝেমাঝেই ও ভাইয়ের কান কামড়ে দিত। তারপর দু’জনে মিলে মাঠে গড়াগড়ি খেত। মালিকের আদরটাই বা ভুলবে কী করে, মাঝেমাঝেই চিনির দলা খেতে দিত। পরে ওই বাড়ির ছোট ছেলেটাও ওর বন্ধু হয়ে গেল। বাগানে দৌড়াদৌড়ি করে খেলত। হঠাৎ মা আর ভাই কোথায় হারিয়ে গেল ওই বাড়ি থেকে। কিন্তু ও সবার গায়ের গন্ধ, পায়ের শব্দ আলাদা করে বুঝতে পারত। খাওয়ার সময় হলে টেবিলের চারপাশে ঘুরঘুর করত। মালকিন কখনও কখনও দুই-এক টুকরো ভাল মাংস ওকে দিত। বাড়ির চাকরটা খাবার নিয়ে ডাকত ‘প্যাট, প্যাট…’।
প্যাটের খারাপ সময় শুরু হল যখন মিলনের ঋতু এল। মালিক তো চাইত না যে রাস্তার কোনও মাদির পিছনে ও দৌড়াক। এরপর একে ভাগ্যের খেলাই বলতে হবে, শরতের এক সকালে মালিক ওকে গাড়িতে তুলে নিল। এর আগেও গাড়িতে চেপেছে কিন্তু এবার যেন শরীরে কেমন এক অস্থিরতা, ছটফটানি। কয়েক ঘণ্টা পর ওরা এই ভারামিন স্কোয়ারে এসে পৌঁছল। টাওয়ারের পাশের গলি দিয়ে যাওয়ার সময় প্যাটের নাকে এসে লাগল এক মাদি কুকুরের গন্ধ, ভালবাসার আদিম প্রবৃত্তি ওর পাদুটোকে আটকে দিল। তারপর গন্ধ শুঁকে শুঁকে ও ঢুকে পড়ল স্লুইস গেটের পাশের এক বাগানে।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে এমন এক সময়ে ও আবার শুনল মালিকের গলা ওকে ডাকছে, ‘প্যাট… প্যাট!’ এটা কি ওর মালিকের গলা না কি শুধুমাত্র তার ডাকের অনুরণন কানের মধ্যে বাজছে? যে গলার আওয়াজ ওকে প্রত্যেকটা কাজে, দায়িত্বে বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে যেত, সেই ডাককে উপেক্ষা করে কী যেন এক শক্তি তাকে জোর করছে এই মাদি কুকুরটার সঙ্গে থেকে যেতে। মালিকের পৃথিবীর ডাক আর শুনবে না ওর কান। এর গন্ধ এত তীব্র, যৌন-গন্ধী যে সে পাগল হয়ে যেতে লাগল। তারপর লাঠি হাতে ক’টা লোক কখন যেন ওই বাগান থেকে ওকে তাড়িয়ে দিল।
প্যাটের কেমন একা ঝিমুনি এবং ক্লান্তি এল। কিন্তু একইসঙ্গে বেশ হাল্কা আর ফুরফুরেও লাগছিল। হতভম্ব হয়ে এবার সে তার মালিককে খুঁজতে লাগল। মালিকের গন্ধ কোথাও কোথাও একটু একটু পাচ্ছিল। সমস্ত গলি ঢুঁ মেরে বেড়াল। এমনকি গ্রামটার শেষ দেখেও এল। আস্তে আস্তে অন্য গন্ধের আড়ালে হারিয়ে যেতে লাগল মালিকের গন্ধ। তবে কি তাকে ফেলে রেখে চলে গেল? ভয় আর দুশিচন্তায় প্যাট কাবু হয়ে এল। কীভাবে বাঁচবেন প্যাট তার প্রভুকে ছাড়া? না, না, নিশ্চয় সে ফিরে আসবে, তাকে খুঁজবে। ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে প্যাট আবার সব রাস্তা চষে ফেলতে লাগল, কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল।
পরাজিত, ক্লান্ত প্যাট রাতে আবার ফিরে এল ওই ভারামিন স্কোয়ারে। আরও কয়েকবার গ্রামটাকে চক্কর কাটল কিন্তু মালিকের কোনও চিহ্ন নেই। অবশেষে সে সেই যেখানে মাদিটার দেখা পেয়েছিল সেখানে ফিরে এল। কিন্তু স্লুইস গেট বন্ধ ভারি পাথর ফেলে। মাটি খুঁড়তে লাগল ভিতরে যাবে বলে। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারল না। ক্লান্তিতে ঢুলতে ঢুলতে প্যাট সেখানেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
মাঝরাত্তিরে সে নিজেই কেঁদে উঠল জোরে জোরে। আবার সে এ গলি সে গলি ঘুরে গন্ধ শুঁকে বেড়াতে লাগল। এবার সে বুঝতে পারল তার খিদেও পেয়েছে বেশ। ফেলে দেওয়া মাংসের হাড়, নতুন তৈরি রুটির গন্ধ খিদেটাকে আরও বাড়িয়ে তুলল। আবার একই সঙ্গে একটা অপরাধবোধ– অন্যের খাবারে অনাহুতের মতো ভাগ বসাতে হবে, লোকের কাছে ভিক্ষে চাইতে হবে। হয়তো এই এলাকাটাকেই তার নিজের বানিয়ে নিতে হবে। খুঁজতে হবে তার মালিকের মতো কাউকে।
এইমাত্র যে বেকারিটা খুলেছে তার সামনে ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়াল প্যাট। হাতে রুটি ঝোলানো লোকটা তাকে ডাকল, ‘আয়… আয়।’ ডাকটা অদ্ভুত শোনাল প্যাটের কানে। দোকানি একটা টুকরো রুটি ছুড়ে দিল ওর দিকে। একটু দ্বিধার সঙ্গে রুটিটা খেয়ে লেজ নাড়তে লাগল। তারপর দোকানের বারান্দায় আর এক টুকরো দিয়ে লোকটা সাবধানে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, দু’হাত দিয়ে খুলে দিল গলাবন্ধ। আঃ মুক্তি! সমস্ত বন্ধন, দায়দায়িত্ব থেকে যেন মুক্তি পেল প্যাট। এবার সে লেজ নাড়তে নাড়তে দোকানির দিকে এগোতেই কষে এক লাথি খেল।
সেই রাত থেকে প্যাট এখানকার মানুষজনের কাছ থেকে আর অন্য কোনওরকম আপ্যায়ন পায়নি। কেউ লাথি মারে, কেউ পাথর ছোড়ে, কেউ লাঠিপেটা করে। যেন মনে হয় ও সবার শত্রু আর সবাই ওকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।
সে চিনতে পারেনি এই নতুন জগৎটাকে। কেউ ওর আবেগকে পাত্তা দেয় না। প্রথম কয়েকটা দিন ছিল বেশ কঠিন। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিল প্যাট। স্কোয়ারটার ডানপাশে সে একটা খাবারদাবারের অবশিষ্ট ফেলার ডাস্টবিন খুঁজে পেয়েছিল। দিনের বেশিরভাগটাই কাটে মাংসের দোকান আর রুটির দোকানের সামনে। কসাইয়ের হাতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কখন এক টুকরো ছুড়ে দেবে। তবে যতটা না মাংস পায়, মার খায় তার শতগুণে বেশি। আস্তে আস্তে পুরনো জীবন বিবর্ণ হতে লাগল প্যাটের জীবনে। কখনও কখনও সেই স্বর্গের স্মৃতি জেগে ওঠে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে।
যা সবচেয়ে বেশি প্যাটকে কষ্ট দিত তা হল অনাদর। শত মার, লাথি খেয়েও ওর মনটা এখনও নরম, একটা বাচ্চার মতো। এই সময়েই তো বেশি দরকার ছিল একটু আদরের। একটা ভালবাসার হাতের পরশ। তার চোখদুটো সবসময় একটু ভালবাসা ভিক্ষা চাইত, যদি কেউ ভালবাসা দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, তার জন্য সে প্রাণ দিয়ে দিতে পারে। কাউকে তার এই বার্তাটা দেওয়ার দরকার, তার এই আত্মত্যাগ, বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এমন কাউকে সে এখানে খুঁজে পায় না, সবার চোখেই লেখা থাকে শত্রুতা আর বিদ্বেষ। যত তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় ততই যেন দুর্ভাগ্য ডেকে আনে।
আজকে আবার ওই স্লুইস গেটের ওখানে ঘুমিয়ে পড়েছিল প্যাট। সারারাত কেটেছে দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে। মাঝেমাঝেই সে যন্ত্রণায় ডেকে উঠেছে। তারপর একরাশ খিদে নিয়ে তার ঘুম ভাঙল। কাবাবের গন্ধে বাতাস ভুরভুর করছে। খিদে তাকে ভুলিয়ে দিল অন্যান্য সব বেদনার কথা। কষ্ট করে উঠে সে ভারামিন স্কোয়ারের দিকে হাঁটতে লাগল।
ধুলো উড়িয়ে একটা গাড়ি ভারামিন স্কোয়ারে এসে থামল। একটা লোক গাড়ি থেকে নেমে প্যাটের দিকে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কিন্তু লোকটা তো তার মালিক না। কারণ মালিকের গন্ধ এখনও সে ভোলেনি। কিন্তু এটা কীভাবে ঘটল যে কেউ একজন এসে তাকে আদর করে গেল? ফেরার পথে লোকটা আবার তার মাথায় হাত রাখল। এবার প্যাট তার পিছু নিল। লোকটা এবার সুগন্ধে ভরা একটা খাবারের দোকানে গিয়ে বসল। গরম রুটি, তরকারি, ডিম– এসব খাবার থেকে প্যাটকেও ভাগ দিল। প্রথমে লোভীর মতো তারপর ধীরে ধীরে প্যাট সেগুলি খেয়ে নিল। নিজের অসহায়তা ও কৃতজ্ঞতা থেকে প্যাট তার গভীর দুটো বাদামি চোখে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে লেজ নাড়াতে লাগল।
এটা কি সত্যি না কি প্যাট স্বপ্ন দেখছিল? অনেকদিন পর পেটভরে খেল, কেউ তাকে জ্বালাতন করল না। তাহলে কি ও এক নতুন মালিক পেল? বাইরের তাপকে অগ্রাহ্য করেই লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে টাওয়ারের গলির কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর আবার বিভিন্ন কানাগলি দিয়ে চলতে লাগল। প্যাটও তাকে অনুসরণ করতে লাগল। তারপর তারা দু’জনেই গ্রামের শেষসীমায় এসে দাঁড়াল। লোকটা একটা ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। প্যাটের মালিকও এই বাড়িতে ঢুকেছিল। হয়তো এও কোনও নারীর গন্ধ পেয়েছে এখানে! তারপর আবার অন্য পথ ধরে তারা স্কোয়ারে ফিরে এল এবং লোকটা একটা গাড়িতে চেপে বসল। প্যাটের সাহস হল না গাড়ির মধ্যে ঢোকার। তাই বাইরে বসেই লোকটাকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ গাড়িটা চলতে শুরু করল। দ্বিধা কাটিয়ে প্যাটও গাড়ির পিছনে দৌড়াতে আরম্ভ করল। না, এবার আর লোকটাকে সে হারাতে চায় না। শরীরের ব্যথা নিয়েও সে বেশ জোরে দৌড়াচ্ছিল যদিও তার হাঁপ ধরে যাচ্ছিল। গ্রাম পেরিয়ে গাড়িটা এখন খেত-খামারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝেই পিছিয়ে পড়ছিল প্যাট। হতাশা আর ভয় থেকে প্যাট তার সর্বশক্তি ঢেলে দিচ্ছিল। যদিও গাড়িটা এখন তার থেকে বেশি জোরে ছুটছিল। সে একটা ভুল করে ফেলেছিল। আসলে তার দুর্বল আর অবসন্ন শরীর ওই গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার যোগ্যই ছিল না। সে দুর্বল ও নার্ভাস হয়ে পড়ল– তারপর সে আর একপা-ও এগোতে পারল না। সে হাঁপাতে লাগল। এতক্ষণের সব পরিশ্রম বিফলে গেল। অবশ্য সে কেন দৌড়াচ্ছিল, কোথায় যাচ্ছিল সে নিজেই জানত না। তার জিভ ঝুলে গেল, চোখের সামনেটা কেমন অন্ধকার হয়ে এল। কষ্ট করে রাস্তা থেকে পাশে সরে এসে গরম বালিতেই মুখ গুজল। সে জানত এই জায়গা ছেড়ে আর কোথাওই সে যেতে পারবে না। তার কেমন ঘুম পাচ্ছিল, স্নায়ুগুলো সব শিথিল হয়ে আসছিল। পেটের মধ্যে এক চিনচিনে ব্যথা, চোখের আলোও নিভে আসছে ক্রমে। তার হাত, পা নড়ছে না। সারাদেহে এক ঠান্ডা ঘামের স্রোত নেশার মতো জড়িয়ে ধরছে প্যাটকে, এ যেন এক শীতল আরামদায়ক অনুভূতি।
সূর্যাস্তের আগে আগে তিনটে ক্ষুধার্ত কাক উড়ে এল প্যাটের মাথার কাছে। তার গন্ধ পেয়ে গেছে ওরা। খুব সতর্কতার সঙ্গে একটা কাক খুব কাছে এসে বসল। যখন বুঝল প্যাট এখনও পুরো মরেনি সে উড়ে চলে গেল। আসলে এই তিনটে কাক প্যাটের বাদামি চোখদুটো নিতে এসেছিল।